শিরীন আখতার কর্মহীন মানুষের খাদ্যের দায়িত্ব সরকারের

আগের সংবাদ

ফ্রান্সের নারী নির্মাতার হাতেই এবার ‘স্বর্ণপাম’

পরের সংবাদ

ফুটবলে বর্ণবাদ এবং পরিবর্তনের দিকে ইংল্যান্ড?

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মার্কাস রাশফোর্ড বেড়ে উঠেছেন ম্যানচেস্টারের উইদিংটন এলাকায়। বয়স মাত্র ২৩ বছর। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তারকা খেলোয়াড় তিনি। ইংল্যান্ডের জাতীয় দলেও তিনি সেই তারকাই। এই তারকার শৈশব খুব একটা সুখকর নয়। সংগ্রাম দেখেছেন, কিন্তু সংগ্রামের পাশাপাশি নিজেকে গড়ে তুলেছেন অতি অল্প বয়সেই।
ব্রিটেনের স্কুলগুলোতে সরকার যখন করোনাকালীন ফান্ড স্বল্পতার অজুহাতে শিশুদের খাবারে নিয়ন্ত্রণ আনল, তখন রাশফোর্ড নিজস্ব উদ্যোগে সারাদেশের স্কুলগুলোতে মিল চালু করতে ক্যাম্পেইন শুরু করেন। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা পর্যাপ্ত খাবার পাবে না, এ ব্যাপারটা দেশের অনেক মানুষই মেনে নিতে পারেনি। রাশফোর্ড বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধেন। অর্থ জোগান দিতে থাকেন। অবশেষে সরকার অনুদান চালু করে। এবং সেজন্য তরুণ এই বয়সে তিনি ব্রিটেনের সম্মানিত এমবিই খেতাবও পেয়েছেন।
রাশফোর্ড গর্ব করেই নিজেকে উইদিংটনে বেড়ে ওঠা তরুণ হিসেবে যেমন গর্ববোধ করেন, ঠিক তেমনি তিনি তার নিজস্বতাকে না ভুলেই বলেন আমি উইদিংটনের একজন কালো মানুষ। পেনাল্টি মিস করার ‘অপরাধে’ উইদিংটনের মানুষের ভালোবাসার ম্যুরাল, যেটা একজন ফ্রান্সের লোক করেছিলেন, সেই ম্যুরালটি বিকৃত করেছিল তার পেনাল্টি মিস করার আধা ঘণ্টার মধ্যে, সেজন্য ব্যথিত হয়েছে এই শহরেরই মানুষ। পরের দিনই বিকৃত অংশটুকু মানুষ ঢেকে দেয়, যা রাশফোর্ডও আবেগের সঙ্গে তার টুইটারে শেয়ার করেন।
ইউরো কাপ জিততে না পারার হতাশা আছে দেশজুড়ে। ব্রিটেনে বড় হওয়া সাদা-কালো-বাদামি প্রত্যেকটা পরিবার সেদিন ছিল টেলিভিশন সেটের সামনে। ইন্টারনেট প্রভাইডারদের কোনো কোনো কোম্পানি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ইন্টারনেট ফ্রি করে দিয়েছিল। যারা বাইরে ছিল, গাড়িতে ছিল, তারাও মিস করেনি এ খেলাটি। ৩০.৯ মিলিয়ন মানুষ শুধু আইটিভিতেই দেখেছে খেলাটি। রাশফোর্ড-সাকার সঙ্গে কেঁদেছে ব্রিটিশ জনগোষ্ঠী, আমরা না কাঁদলেও আমাদের সন্তানদের হাহুতাশ দেখেছি। কাকতালীয় ঘটনাই ছিল সেটা। ইংল্যান্ড-ইতালির ইউরো ফাইনালে পেনাল্টি শুট মিস করেছেন যারা, তারা দুর্ভাগ্যবশত তিনজনই কৃষ্ণাঙ্গ। বর্ণবাদী ইংলিশ সমর্থকরা তো সুযোগটা লুফে নেবেই। নিয়েছেও। ইউরোর ফাইনালে ইতালির কাছে টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডের হারের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্ণবিদ্বেষের শিকার হলেন ৩ কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় মার্কাস রাশফোর্ড, জেডন সানচো এবং বুকায়ো সাকা।
তবে এই ফুটবলারদের উদ্দেশ্যে বর্ণবাদী মন্তব্য ঘিরে উত্তাল পুরো ইংল্যান্ড। সাকার পেনাল্টি মিসের পর তাকে সান্ত¡না দিতে ইংল্যান্ড ম্যানেজার সাউথগেটের সান্ত¡না দেয়া মনে হয়েছে, তিনি তার ১৯ বছরের সন্তানকে জড়িয়ে ধরেছেন এবং সান্ত¡না দিচ্ছেন। প্রিন্স উইলিয়াম থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পর্যন্ত এ নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেছেন। ইংলিশ ফুটবল দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। লন্ডন পুলিশ জানিয়েছে, তারা তদন্ত শুরু করেছে। বর্ণবাদী মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইংল্যান্ডের ফুটবল সমর্থকদের একটা অংশ ‘হুলিগান’ হিসেবে পরিচিত। পরাজয়কে এরা সহজে মেনে নিতে পারে না। জাতীয় টিমতো বটেই, এমনকি দেশের অভ্যন্তরে লীগ খেলায়ও সমর্থিত দল হেরে গেলে এরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। নিজেদের মাঝে বোতল ছোড়াছুড়ি, মারামারি খেলার এক ধরনের একটা সাধারণ চিত্র। আর সেজন্য বিশেষত প্রিমিয়ার লিগের খেলার সময় সমর্থিত এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা দিয়েও হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তা কর্মীদের। ইউরোপ তো বটেই, পৃথিবীতেই সেজন্য ফুটবল সমর্থক হিসেবে এ জাতির কুখ্যাতি আছে। এই কুখ্যাতিই আবারো প্রমাণ করল ইংল্যান্ড গত সপ্তাহে ইউরো ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর। ট্রাইবেকারে ইংল্যান্ড হেরে গেলে একটা বেদনার বাঁশি বাজে সারা ব্রিটেনে। এই দুঃখ আঘাত দিয়েছে এদেশে এমনকি অভিবাসিত হওয়া বেশিরভাগ মানুষকেও। কিন্তু খেলা শেষ হলে যে তাণ্ডব চালিয়েছে ইংল্যান্ড সমর্থকদের একটা অংশ, তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ইতালীয় দর্শকদের ওপর শারীরিক আক্রমণ চালিয়েছে তারা, বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন ইতালির দর্শকরা। ইতালীয় দর্শকদের হাত থেকে পতাকা কেড়ে নিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া কিংবা পতাকায় থুথু ছিটানো কিংবা পতাকা মাড়িয়ে উল্লাস করা প্রভৃতিতে মূলত ছিল না ওই দর্শকদের বেদনার কোনো ছোঁয়া, ছিল অমানবিক বিকারগ্রস্ত মানসিকতার প্রতিফলন। শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের দাপটও ছিল এ খেলায়। মার্কাস রাশফোর্ড, বুকায়ো সাকা কিংবা জেডন সানচো কিংবা স্টারলিং রাহিম অথবা অন্য কৃষ্ণাঙ্গরা ইংল্যান্ডের ফুটবল ম্যানেজার সাউথগেট কিংবা ইংল্যান্ড টিমের নীতিনির্ধারকদের মনোনীত খেলোয়াড়। ম্যানেজারেরই রিকোমেন্ডেড খেলোয়াড় হিসেবে তারা পেনাল্টি শুটে তিনজন অংশ নিয়েছিল। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারাই ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় পড়েছে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ শব্দটার ওপর। এই হুলিগানরা বর্ণবাদী আচরণে অতিষ্ঠ করে তুলেছে তাদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বর্ণবাদী আক্রমণ করছে। কিন্তু দেশ হিসেবে, জাতি হিসেবে এ আক্রমণকে মোকাবিলা করছে সরকার কিংবা ইংল্যান্ড। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রিন্স উইলিয়াম, শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এদের ‘থ্রি লায়ন্স’ হিসেবে দেখছেন। সবাই এর নিন্দায় সোচ্চার হয়েছেন। এ নিয়ে তীব্র নিন্দার ঝড় বইছে ফুটবল বিশ্বে। ইংল্যান্ড ম্যানেজার এ কুৎসিত আচরণকে ‘আনফগিবেবল’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর সেজন্যই এদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে যথাযথ পদক্ষেপ।
বুকায়ো সাকার একটা বিবৃতি সারা ব্রিটেনে এখন আলোচনায় নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। সাকাদের প্রতি বর্ণবাদী উচ্চারণগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে ডালপালা বিস্তার করেছে। অথচ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আপত্তিকর উচ্চারণগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মুছে দিতে পারেনি। সত্যি কথা হলো, ফেসবুক কিংবা অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমও কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে মাঝে মাঝে ফুটেজ মুছে ফেলে, কখনো বা কারো কারো আইডিই মুছে দেয়, অথচ বর্ণবাদী উচ্চারণগুলো ওইদিন ক্রমশ বেড়েছে, বিশ্বব্যাপী ব্রিটেন হয়ে উঠেছে কতিপয় বর্ণবাদীদের অভয়ারণ্য হিসেবে। অথচ এই গালিগালাজপূর্ণ কথাগুলো তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডে স্পর্শ করেনি। সে হিসাবে সাকার এই টুইট এ সময়ে খুবই গুরুত্ব বহন করছে। এবং এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে চাপও বাড়তে পারে।
ফুটবল ইতিহাসে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ শিরোপা অর্জন ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ বিজয়। এ বিজয়ের পর ইংল্যান্ডের জন্য ইউরো ফাইনালে যাওয়া ছিল এক বিশাল অর্জন। কিন্তু ট্রাইবেকার নামক বাজিতে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড হেরে গেল। তারপরও ৫৫ বছর পর এই অর্জনকে কেউই ছোট করে দেখছে না। ইংল্যান্ডের এই অর্জনের পেছনে আছে দলের কোচ টিম এবং ম্যানেজার সাউথগেটের প্রাণপণ প্রচেষ্টা। আর সেজন্য প্রধানমন্ত্রী এখনো সময় খোঁজছেন কখন এ দলকে তিনি কীভাবে সম্মাননা দিতে পারেন আনুষ্ঠানিকভাবে। যদিও ইংল্যান্ড বিজয় হলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত একদিনের সরকারি ছুটি এখন আর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে সাউথগেটের ব্যাপারে যে আলোচনা উঠেছিল, ব্রিটেনের সবচেয়ে সম্মানিত খেতাব (দুর্লভ) নাইটহুড তিনি পাচ্ছেন, সেটি এখনো আলোচনায় আছে। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের পরাজয়েও সাউথগেটের অবদানকে খাটো করে দেখা হচ্ছে না। উল্লেখ্য, এই সম্মাননাটি পেয়েছিলেন এল্ফ রামজি ১৯৬৬-এর বিশ্বকাপ জয়ের পর।
ফুটবলে বর্ণবাদী কথাবার্তা উচ্চারিত হয় মাঝে মাঝে। এগুলো কিছুদিন পর মিইয়ে যায়। কিন্তু এবারে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ নিয়ে কঠিন সব কথা বলা হচ্ছে। এবং এটা বলতেই হবে। কারণ আমেরিকার একজন জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার’ হঠাৎ করেই সারা বিশ্বকে যখন কাঁপিয়ে তুলেছিল, তখন সে ঢেউ ইংল্যান্ডেও লেগেছিল। এবং সেজন্যই শত বছর থেকে শোভাবর্ধন করা অনেক নামিদামি মানুষের মূর্তি টেনেহিঁচড়ে ভেঙে দেয়া হয়েছে সে সময়। কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। বলাত যায় না, কখন কী ঘটে তাই এবারে পরিবর্তন আসবেই হয়তো। ইংল্যান্ডের এ খেলা অন্তত তাদের কিছুটা হলেও বদলে দিতে পারে এবার।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়