আপিল বিভাগের আদেশ : ল্যাবএইডের ডাক্তার হত্যায় আমিনুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল

আগের সংবাদ

ঝুঁকি নিয়েই উঠল লকডাউন

পরের সংবাদ

হেফাজতের সঙ্গে আর সমঝোতা নয়

প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া, সভা-সমিতি, বৈঠক অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে মানুষের চলাচল হয়ে পড়েছে খুবই সীমিত। কিছুদিন আগে এই কঠোর লকডাউনের মধ্যেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করে গেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। যদিও সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এই বৈঠককে সরকারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের চেষ্টা বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকটি সমঝোতা চেষ্টার অংশ কিনা তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন কেউ কেউ। সরকার ঘোষিত লকডাউনের মধ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হেফাজতের আমির কেন ঢাকা এলেন তা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। এর কারণ হচ্ছে, এমনিতেই অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের ঘটনায় চাপের মুখে রয়েছে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব। এই নেতৃবৃন্দের অনেকের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম ও তাণ্ডব-ভাঙচুরে জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার কারণে কয়েক মাস ধরে সরকারের নির্দেশে কওমি মাদ্রাসাগুলো বন্ধ রয়েছে। এসব কারণে অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে সংগঠনটিতে। সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক। তাই এই মাদ্রাসাগুলো বন্ধ থাকা মানে শক্তির জায়গাটিও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া। তদুপরি নতুন কমিটি গঠন করে এখনো কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি হেফাজত। তাই আপাতত নেতাকর্মীদের মুক্ত করে সাংগঠনিক ভিত শক্ত করার চিন্তা নিয়েই এগোচ্ছে তারা। কারণ হেফাজতের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখা এসব নেতা কারাগারে অন্তরীণ থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রমও সব স্থবির হয়ে আছে।
তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেখা করার কারণ হিসেবে কৌশলগতভাবে মাদ্রাসা খোলার ব্যাপারটিকে সামনে আনছে হেফাজত। যদিও সংগঠনটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সম্প্রতি বলেছেন, চট্টগ্রাম, হাটহাজারীসহ সারাদেশে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বহু নেতাকর্মী কারাবন্দি। তাদের মুক্ত করতে আমরা চেষ্টা করছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়ার কথা বলেছি। হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব হয়তো চাইছে আরেকবার সরকারকে ম্যানেজ করতে। এজন্য তাদের লক্ষ্য যে কোনো মূল্যে সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করা। তবে সরকারকে ভুলে গেলে চলবে না এই হেফাজতে ইসলামের মলাটেই কিছুদিন আগেও গাঁটছড়া বেঁধেছিল স্বাধীনতাবিরোধী সব শক্তি।
তদুপরি এই হেফাজত কিন্তু জামায়াতের চেয়ে কোনো অংশে কম বিষধর নয়। নাস্তিকতার ধুয়া তুলে তালিকা বানিয়ে মুক্তমনা ব্যক্তিদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার প্ররোচনা দেয়া থেকে শুরু করে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা তো তাদের বিরুদ্ধে বহু পুরনো অভিযোগ। মাত্রই গত বছর তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করে গোটা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। ওই সময় তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার স্পর্ধা দেখাতেও দুবার ভাবেনি। উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে নাশকতা চালানো, ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, নারীদের অবমাননা করা, রাষ্ট্রের মূল চেতনার বিরোধিতা করাসহ ধর্মান্ধতা-উগ্রতার বিষবাষ্প সমাজদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয়া তাদের বিরুদ্ধে বহুল চর্চিত অভিযোগ। সব অভিযোগকে বাদ দিলেও, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার দুঃসাহস যারা দেখাতে পারে আর যাই হোক তাদের চিনতে ভুল হওয়া উচিত নয়। তাছাড়া অনেকেই মনে করেন, হেফাজতের সঙ্গে আবারো কোনো সমঝোতা হলে আরো বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে। কারণ এর আগে শাপলা চত্বরের নাশকতার পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি সমঝোতা হয় বলে অনেকেই মনে করেন। তখন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের অপকৌশলী রাজনীতির কারণে সরকার হেফাজতের সঙ্গে বিরোধে না জড়ানোকেই শ্রেয় মনে করেছিল। তবে সেই সময়ে হেফাজতকে ছাড় দিতে গিয়ে এমন কিছু দাবি মেনে নেয়া হয়, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাঠ্যসূচিতে আনা হয় পরিবর্তন, পাশাপাশি কওমি সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আবেগে গদগদ হয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধি দেন।
তখন ক্ষমতার রাজনীতির জটিল সমীকরণের মারপ্যাঁচে সরকার এবং আওয়ামী লীগ, হেফাজতের ‘হেফাজত’ করলেও গত বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় রীতিমতো ক্যু করে জুনায়েদ বাবুনগরী-মামুনুল হকরা ক্ষমতা দখল করলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আহমেদ শফীর অনুসারীদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। নতুন আমির হিসেবে নিয়ে আসা হয় আহমেদ শফী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি জুনায়েদ বাবুনগরীকে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে জড়িতদের প্রাধান্য দেয়া হয় কমিটিতে। হেফাজতে ইসলামও মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু-কিশোরের শক্তিকে পুঁজি করে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট হিসেবে পুনরায় কাজ করতে শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ আরো কয়েকজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি মুজিববর্ষকে টার্গেট করে ওয়াজ মাহফিলের নামে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে থাকে। কৌশলে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য আসে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার আস্ফালনের কথা তোলে। সরকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে পিছিয়ে এলে হেফাজতও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অতঃপর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করতে নেমে ২৬ মার্চ থেকে দেশে যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায় সেটি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, পল্টনে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবকে আবার দেশবাসীর মনে করিয়ে দেয়।
তাছাড়া আহমেদ শফীর মৃত্যুর পরে হেফাজতে ইসলামের আড়ালে ফের সক্রিয় হচ্ছিল জঙ্গিরা। নেপথ্যে এসবের কলকাঠি নেড়েছে জামায়াতে ইসলামী। গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে প্রয়াত আমির শাহ আহমেদ শফীর একদল অনুসারী দাবি করেছিলেন, সংগঠনটির নেতৃত্ব জামায়াত-বিএনপির প্রেসক্রিপশনে চলছে। তদুপরি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে ব্যাংককে বিএনপি নেতাদের গোপন বৈঠকে এবং নাশকতার ষড়যন্ত্রও ফাঁস হয়েছে। আরো জানা গেছে, ব্যাংকক ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছিল লন্ডন থেকে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হেফাজতের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহিংস সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালানো হবে। মানে বিএনপি-জামায়াত জোট যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই সরকারের পতন ঘটানো এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে হেফাজতকে। তবে এখন অবস্থা বদলেছে। তাণ্ডব-ভাঙচুরে জড়িত একাংশকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি হয়েছে। যদিও আহমেদ শফীর অনুসারীদের বলতে গেলে হেফাজত থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে সমঝোতা ও আস্কারায় এদের আসল রূপ কতটা জঘন্য হতে পারে সেটাও দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়েছে। দেশবাসী দেখেছে সুযোগ পেলে হেফাজত ছোবল দিতে কখনো দুবার ভাবে না।
দেওবন্দের ওলামারা ঐতিহ্যগতভাবে সরাসরি রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও হেফাজতের কাছে তাদের মূল পরিচয় গৌন হয়ে রাজনৈতিক অভিলাষ বড় হয়ে পড়েছিল। দেওবন্দে যারা পড়ালেখা করেন তারা ভারতে ইসলামের নামে কোনো সন্ত্রাস বা সহিংসতা সৃষ্টি না করলেও ২০১৩ সালের মে থেকে এ সংগঠনটি এতটাই উগ্র আর ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে যে, এর জন্য মানুষের মুক্তচিন্তা, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ তারা দেখিয়েছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং স্বাভাবিক জীবনের জন্য তারা কত বড় হুমকি। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের জানাজা পড়ানোকে নাজায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। অথচ বেকায়দায় পড়ে তারাই এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের আশঙ্কা থেকে যে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল সে অবস্থা থেকে পাকাপোক্তভাবে উত্তরণ ঘটাতে সরকারকে বর্তমানের কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে হবে। কারণ অনেকেই মনে করেন শাপলা চত্বরের তাণ্ডব-ভাঙচুরের পর সরকার হেফাজতের প্রতি কঠোরতা বজায় রেখে নির্মোহ অবস্থান ধরে রাখলে আজকের অবস্থানে তারা কখনোই আসতে পারত না। তাই হেফাজতে ইসলাম নামধারী সাম্প্রদায়িক শক্তিটির প্রতি সরকার যেন সহানুভূতি প্রদর্শনের ভুল আর দ্বিতীয়বার না করে প্রত্যাশা এটাই।

মর্তুজা হাসান সৈকত : কবি ও লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়