আপিল বিভাগের আদেশ : ল্যাবএইডের ডাক্তার হত্যায় আমিনুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল

আগের সংবাদ

ঝুঁকি নিয়েই উঠল লকডাউন

পরের সংবাদ

এবারের ঈদ হোক মানুষ বাঁচানোর

প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঈদ একেবারেই আসন্ন। এটি ঈদুল আজহা অর্থাৎ কুরবানির ঈদ। বাঙালির ঐতিহ্য পরিবার-পরিজন এবং যতটা সম্ভব আত্মীয়স্বজন একত্রে জমা হয়ে ঈদ উদযাপন করা। মানসিকভাবে মানুষ দেশের সর্বত্র প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছেন। কে কোথায় যাবেন, কোথায় ঈদ করবেন, সাধ্যানুযায়ী কে কয়টা কুরবানি দেবেন বা কার কার সঙ্গে ভাগে কুরবানি দেবেন- এগুলোই সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। যিনি যেমন পারবেন, তিনি তেমন বাজেটও তৈরি করে ফেলেছেন।
আর একটি অংশ আছেন- যারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ভাবছেন, করোনার যে প্রকোপ এবং যানবাহনের যে দুর্দশা দেখা যাচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে তারা কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামমুখী হবেন কিনা। তবে গ্রামে ফেরার আকাক্সক্ষাই বেশি।
আরো একটি অংশ আছে, যারা চূড়ান্তভাবে তাদের মনস্থির করে ফেলেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত তারা এই ভয়াবহ মহামারি ও যাত্রা সংকটকে অগ্রাহ্য করে তারা গ্রামমুখী হবেন না। যারা যার কর্মস্থলে থেকেই তারা ঈদ উদযাপন করবেন।

এবারের ঈদের পটভূমি
আমরা জাতির উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, জুলাই মাসে এবারের ঈদ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, সেই জুলাইতেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে ২৩০ ছুঁইছুঁই। ইতোমধ্যে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে পৌঁছেছে। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, এই দুটি সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই হু হু করে বেড়েই চলেছে।

স্মরণীয় বরণীয় যাদের হারিয়েছি
প্রায় দেড় বছর হলো করোনা ভাইরাস সারা পৃথিবীকে এক প্রচণ্ড অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। কবে কে বিদায় নেবেন, সেই চিন্তায় বিশ্বব্যাপী মানুষ অস্থির। এই ভাইরাসের বিষাক্ত আঘাতে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ দেশের স্মরণীয়-বরণীয় অনেককে ইতোমধ্যেই হারিয়েছি। যেন আবারো হয়তো আরো একটা ১৪ ডিসেম্বর বা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস করোনা উত্তরকালে ঘোষণার অপেক্ষায় গোটা জাতি। যাদের আজতক হারিয়েছি, তাদের মধ্যে যাদের নাম স্মরণে আছে তারা হলেন- অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান (আমার বাল্যবন্ধু এবং সাবেক সহকর্মীও বটেন); প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাবেক সভাপতি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, বন্ধু ও সহযোদ্ধা কামাল লোহানী, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক জনপ্রিয় অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকর্মী মাহবুবে আলম, সেক্টর কমান্ডার (মুক্তিযুদ্ধের) জেনারেল সি আর দত্ত, প্রখ্যাত সাংবাদিক রাহাত খান, গীতিকার আলাউদ্দিন আলী, বিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী আসগর, ভাষাসৈনিক মুর্তজা বশির, নারীনেত্রী রাখীদাস পুরকায়স্থ, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, ভাষাসৈনিক জননেতা এম এ রকিব, স্থপতি মৃণাল হক, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ। এ ক্ষতি জাতীয় ক্ষতি এবং তা পূরণ হওয়ার নয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, করোনার রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সারাদেশে এ পর্যন্ত শত শত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকেও হারিয়েছি; হারিয়েছি আরো বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, কর্তব্যরত পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স চালক প্রমুখকে।
শহরের কত দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক, দোকানদার, ব্যবসায়ী, হোটেল কর্মী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গ্রামাঞ্চলের কৃষক-খেতমজুর ও রিকশাওয়ালা-ভ্যানওয়ালা হারিয়েছি এবং হারাচ্ছি সে পরিসংখ্যান কোথাও নেই। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশেই শুধু নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই।
সরকার গত ১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে অফিস-আদালত, গাড়ি-ঘোড়া, দোকানপাট, পথেঘাটে বিনা প্রয়োজনে লোক চলাচল কড়াকড়িভাবে তা প্রয়োগও করছে। এ ধরনের লকডাউন পুরো জুলাই মাস পর্যন্ত কড়াকড়িভাবে চালু রাখা এবং ৩১ জুলাই পর্যন্ত তা বর্ধিত করা দরকার। বর্তমানে চালু রাখা কলকারখানা, হোটেল, বিমান সার্ভিসগুলোও এই সময়কাল পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়াও প্রয়োজন।
সর্বশেষ জানতে পারলাম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান বিধিনিষেধ ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। ২৩ জুলাই থেকে ফের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে ২৩ জুলাই থেকে ফের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হবে। মানুষ বাঁচানোর স্বার্থে সব ধরনের আবেগ মুক্ত হয়েই জাতির কল্যাণ কামনাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে আলোচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
প্রথমেই উল্লেখ করি, বিগত তিনটি ঈদের (করোনাকালের) অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতেই হবে। সেই করুণ অভিজ্ঞতা হলো- লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ও অন্যান্য কর্মস্থল থেকে সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে গ্রামাঞ্চলে ছুটেছেন ঈদ তিনটির দিন দশেক আগে থেকেই, আবার ঈদ অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুরূপভাবে লাখ লাখ মানুষ কর্মস্থলে ফিরেছেন। প্রতিবারই এই ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণের প্রায় দুই সপ্তাহ পর থেকে করোনায় আক্রান্ত এবং তাতে করুণ মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এবারকার আসন্ন ঈদেও যদি ওই একই প্রকারের লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ছুটতে থাকেন- সংক্রমণ ও মৃত্যু আরো বাড়বে। হতে পারে দৈনিক মৃত্যু ২৫০ ছাড়িয়ে যাবে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, হজ উপলক্ষে এবং অন্য কারণে কোনো বিদেশিকেই সৌদি আরবে ঢুকতে দেবে না সৌদি সরকার। গতবারও তারা হজব্রত পালনে কাউকে যেতে দেননি সে দেশে। এই কঠোরতা শুধু করোনার কারণেই।
যারা লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি বা তা চালু রাখার বিরোধিতা করছেন তাদের মধ্যে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, হোটেল মালিক-কর্মচারীরা প্রধান। গার্মেন্টস মালিক ও বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স বলতে শুরু করেছে, লকডাউনে কোনো সমাধান হবে না। কিন্তু তারা কি বলতে পারবেন করোনার কারণে পৃথিবীর নানা দেশে আরো কঠোর এবং দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন ঘোষণা করছে? কোথাও কোথাও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছে আবার কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইনও জারি করছে। ওইসব দেশ তাতে ফলও পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কোনো মৃত্যু নয়, মাত্র কয়েকজন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় দুই সপ্তাহের জন্য কড়া লকডাউন ঘোষণা করে বাড়ির বাইরে বেরোনো পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং মানুষ তা নির্বিবাদে মেনে চলেছে। ফলে করোনা সেখানে নিয়ন্ত্রণে আছে। রোগটি মারাত্মক রকমের ছোঁয়াছে বলেই যত বেশি সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কোনো মৃত্যু নেই দীর্ঘদিন- ৪ জুলাই বিকালে সিডনি থেকে বড় ছেলে জানাল বিগত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে।
হ্যাঁ, এ কথা ঠিক- চিরকালের জন্য কোনো দেশেই লকডাউন দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। যাতে সংক্রমণ না বেড়ে ক্রমে কমে আসে তার জন্য ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিনেশন প্রয়োজন। সংসদে সম্প্রতি ভাষণ দিতে গিয়ে সংসদ নেতা জানিয়েছেন, মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগকে টিকার আওতায় আনা হবে। এই দাবি সত্যে পরিণত হোক এবং তার জন্য দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনানুযায়ী ভ্যাকসিন পৃথিবীর নানাদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করা।
এ কথা অনেকেরই জানা যে, এই পৃথিবীর মধ্যে করোনা চিকিৎসার ব্যাপারে আমেরিকার কোলে বসে থাকা সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা সর্বাধিক অগ্রসর। সেখানে সংক্রমণ ও মৃত্যু অত্যন্ত কম। তারা বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন নিজেরা প্রস্তুত করেছে, যার ব্যবহারও তারা ব্যাপকভাবে করছে। বাংলাদেশ সরকার দ্রুত কিউবার সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে যথেষ্ট ইতিবাচক ফল ফলবে বলে মনে হয়। এছাড়া চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশও করোনা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের কাছ থেকেও আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি- কেউ কেউ ভ্যাকসিনও সরবরাহ করবে যদি আমরা যথাযথভাবে চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলি।
করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন, ব্যাপক ভ্যাকসিনেশন ছাড়াও দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পিসি আর ল্যাব স্থাপন, প্রতি জেলায় কমপক্ষে ২০টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন ও যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পালন করতেই হবে। ৪ জুলাই ‘সমকালে’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রায় দেড় বছর হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ৩৫টি জেলার সরকারি হাসপাতালে আজো আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। এমন অবস্থা আর কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না।
ঈদ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখন গ্রামাঞ্চলেও করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতার বিকল্প নেই। ঈদকে সামনে রেখে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। আমি বলব, পশুর হাটে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে কুরবানি পশুর হাট নয়- অনলাইনে তা কেনাবেচা, কাঁচাবাজার এবং অন্য বাজারগুলো ছোট ছোট আকারে ভাগ করে বিভিন্ন মাঠে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। ঈদের জামাত কোনো মাঠে নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তা দফায় দফায় মসজিদগুলোতে আয়োজন করতে পারে। এভাবেই আমরা এবারের ঈদকে মানুষ বাঁচানোর ঈদে পরিণত করতে পারি- আর কোনো বিকল্প পথ নেই।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়