মির্জা ফখরুল : করোনা নিয়ন্ত্রণে কারফিউ কোনো সমাধান নয়

আগের সংবাদ

করোনার দাপটে ডেঙ্গুর হানা : রাজধানীর হাসপাতালে দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা

পরের সংবাদ

নেশার অন্ধকার জগৎ বিপন্ন আগামী

প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

করোনাকালে জীবন-মরণ সমস্যার ভেতরেও মাদক সমস্যা চলমান। উল্টো গৃহবন্দি থাকার কুফলে ছাত্রছাত্রীসহ তারুণ্য ও কিশোর-কিশোরীরা ঝুঁকেছে মাদকের দিকে। যেটুকু সময় তারা পাচ্ছে তার বেশিরভাগই ব্যয় করছে নেশার জগতে। এ নেশা বিভিন্ন ধরনের। আছে কম্পিউটার, মোবাইল, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেটে রাত জাগা। আছে গেম খেলার নামে ভয়াবহ সব কাজ। আছে মাদকের নেশা। মাদক করোনাকে পরাজিত করে সমান তালে এগিয়ে। আর অজান্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ। সত্যি বলতে কী- এত মাদক, এত নেশা, এত সহজলভ্যতা বিদেশে দেখি না। পুরো সমাজ অন্ধকারে আর রাজনীতি বলছে সব নাকি ঠিকঠাক। আমরা নাকি পৌঁছে গেছি সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে।
ভয়াবহ সব মাদকের খবর দেখছি আজকাল। শুরুতেই বলি আর সব বিষয়ের মতো এমন অসামাজিক বিষয়ে ও টিভি মিডিয়ার আগ্রহ প্রবল। কোনো কোনো মিডিয়ার নিউজ ও প্রতিবেদন দেখে মনে হয়েছে তারাই প্রমোট করছে মাদক। আমি সিডনিতে আমার বাসগৃহে সরাসরি যেসব চ্যানেলগুলো দেখতে পাই তার প্রায় সব কটিতেই ছিল মাদক নিয়ে বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণগুলো এমন যে, আপনি নিজেও উৎসাহী হতে পারেন চেখে দেখতে। তবে এটা তাদের দোষ নয়। আজকাল রেটিং টিআরপির জোরে চলা মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তলে তলে আমাদের দেশে ও সমাজে নৈতিকতার শেষ দেয়ালও যে ভেঙে পড়ছে এটাই সত্য।
গাঁজা, হেরোইন এসব আমাদের আমলেও চলত। আমরা তরুণ বয়সে দু-এক ছিলিম গাঁজায় টান দেইনি এমন না। অনেকে সিগারেটের ভেতর পুরেও গাঁজা সেবন করত। কিন্তু এমন অঢেল সাপ্লাই বা বিতরণ কোনোটাই ছিল না। বাংলা সিনেমা প্রমোট করত মদ। এমন সিনেমা খুব কম ছিল যেখানে নায়ক-নায়িকাকে ভুল বুঝে বা অভিমান করে বাংলা মদ খেয়ে গান গাইত না। আর ভিলেন? তার কাজই ছিল দৃশ্যের পর দৃশ্যে বোতলে করে ঢকঢক মদ পান। কিন্তু তারপরও এগুলো ছিল নিয়ন্ত্রণে। আমাদের সময়কালে আমরা খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর বা চাঁদের হাট করতাম। আমাদের ছিল পাড়া-মহল্লার ক্লাব আর আসর। বলাবাহুল্য সেখানে এলাকার তরুণীরা থাকত। এদের ঘিরেই আমাদের যেটুকু প্রেম বা ভালোবাসা। ছিল নিবিড় আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক। সেখানে মদ সেবন বা গাঁজা সেবন করে যাওয়া ছিল অসম্ভব ও ঘৃণিত ব্যাপার। ফলে ভালো হওয়ার জন্য ভালো সাজার জন্যও আমরা নেশা করতে পারতাম না। সবচেয়ে বড় কথা তখন পরিবারের বন্ধন ছিল আস্ত একটা কলমালেবু। প্রতিটি কোষ জড়াজড়ি করে থাকার মতো ভাইবোনরা মিলেমিশে ঘনিষ্ঠভাবে থাকতাম। আর তাদের ওপরের চামড়া বা মুড়ে রাখত মাতা-পিতা। আজকাল সে সম্পর্ক প্রায় শেষ।
এরপর শুনলাম ইয়াবা। আচ্ছা এই যে এখন এলএসডি বা নতুন নতুন মাদক, তার আগে বলুন তো ইয়াবা বদি কোথায়? কেউ জানতে চেয়েছেন কখনো একজন মানুষ যিনি কিনা আওয়ামী নেতা আবার সংসদ সদস্যও; কেন তার নাম হয়ে গেল ইয়াবা বদি? একজন মানুষের নাম বা পরিচয় মাদকের নামে অথচ কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। উল্টো আমরা দেখলাম বাবা তুমি কানতেছোর মতো ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড। যিনি বা যে একটু প্রতিবাদী কিংবা সচেতন তার জায়গা হয়েছে হিমঘরে কিংবা কবরে। আর ইয়াবা বদি সগৌরবে নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে বেঁচে আছে। তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে?
এখন পরিস্থিতি কেমন তার একটা ঘটনা জানি তবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এই মাদক সেবনের পর নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন। ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা এই মাদকের বিষয়টি জানতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মাদকের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটা এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। ফলে এটা সেবনের পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন একজন মানুষ যা খুশি তাই করতে পারেন। এমনকি উঁচু ভবন থেকে লাফ দিতেও দ্বিধা করে না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, সব মাদকই ক্ষতিকর। কিন্তু এলএসডির সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটা সেবনের ফলে দৃষ্টি বিভ্রম বা হেলুসিনেশন হয়ে থাকে। এখন কেউ যদি খুব খুশিতে থেকে এই ড্রাগ নেয় তাহলে তার মধ্যে রঙিন চিন্তা আসে। আর কেউ যদি খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকে এই ড্রাগ নেয় তাহলে খারাপ জিনিসগুলো তাকে ভর করে। সে তখন যা খুশি তাই করতে পারে। এমনকি আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারে, উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে। ফলে এটা সরবরাহের রুটটা আগে বন্ধ করতে হবে। এটা অন্য মাদকের চেয়ে দামি। যারা নিয়মিত মাদক সেবন করে তারা সবসময়ই নতুন নতুন মাদক খোঁজে। এই মাদকের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশি সম্পৃক্ততা দেখছি আমরা। এটি কোনোভাবেই যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খেয়াল করতে হবে।
জেনে অবাক হবেন না এখন এসব মাদকসেবী যেমন নারীরা; তেমনি তারা সাপ্লাইয়ারও। এই মৌচক্র বা মৌমাছি চক্র মাদক ও নারীসঙ্গ একসঙ্গে সেবন করায়। করোনাকালে যখন মানুষ একা নিঃসঙ্গ আর কর্মহীন তখন এগুলো ধারণ করছে মহামারির আকার। আপনি, আমি সবাই জানি ঢাকায় সবচেয়ে সস্তা হলো মাদক আর নারীসঙ্গ। সমাজের এই দিকটায় কোটিপতি, হাজার কোটিপতি থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত সবাই জড়িত। বাহ্যত কারণ যাই হোক, মূলত অপরিমেয় যৌন চাহিদা আর দিকভ্রান্ত বলে নেশার দরকার আজ বেশি। এবং সাপ্লাই চ্যানেলে যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরের লোকজন আছে কাজেই বন্ধ হবে না। সরকারের শীর্ষ মহলের উদ্বেগ বা টেনশন থাকলেও অন্যমহলে কোনো সাড়া নেই।
একমাত্র পরিবার আর সমাজ সচেতনতাই পারে এর আগ্রাসন রুখতে। মনে রাখা ভালো রাজনীতি এখন মৃতপ্রায়। মানুষের আশার ধারে-কাছেও নেই নেতারা। নাটক-সিনেমা-থিয়েটার আদর্শহীন স্তাবকতার বলি। এই বন্ধ্যা সময়ও সমাজে বাকি আছে দুই বিনোদন। নিজেকে রঙিন করার মাদক আর যৌনতা। এবং এ দুটি এমনভাবে জড়াবে একটা আরেকটা ছাড়া থাকতেই পারে না। এর ফাঁকে গড়ে উঠছে বিকলাঙ্গ আর বিপথগামী এক তারুণ্য। যারা না পারবে কোনো ভালো কাজ করতে, না আসবে দেশের কাজে। এই ভয়াবহ মাদক কথা বলে আর কথিত কিছু সংগঠনের কাজে দূর হবে না। যেমন হয়নি সিগারেট। সমাজে পরিবারে বন্ধন আর ভালোবাসা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করা প্রয়োজন। আর একটা কথা বলা দরকার, সবকিছু এককেন্দ্রিক না করে সবাইকে কথা বলতে দিতে হবে। এর ভেতর একটা চাপা আক্রোশ আর বেদনা থাকে। তখন সমাজ পথ হারাতে বাধ্য। সোজা কথায় সবকিছু তার আপন প্রবাহে চললেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। নয়তো হতাশা-অনিয়ম দীর্ঘ সময় কাজ-কর্মহীন, লেখাপড়াহীন জীবন থেকে মাদক দূর হবে না।
বাংলাদেশে ভয়াবহ মাদকাসক্তি আমরা দূরদেশ থেকেও টের পাই। অথচ সরকার বা কর্তারা নাকের কাছে থেকেও গন্ধ পায় না। তাহলে গোড়ায় হাত দেবে কে? আর মাদক যাবেই বা কীভাবে?

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়