প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেডের অগ্নিকাণ্ডে বিধ্বস্ত কারখানা থেকে সর্বশেষ হতভাগ্য ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকর্মীরা। মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা। ভবনে চারতলায় সিঁড়ির গেট তালাবন্ধ থাকায় সেখানে আটকা পড়েই অধিকাংশ মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু এক জায়গা থেকেই ৪৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, মৃতদেহগুলো আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে নারী, পুরুষ কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিচয়- তাদের পক্ষে কোনো কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এটি সত্যিই একটি অত্যন্ত করুণ ও হৃদয়বিদারক আগুন দুর্ঘটনা, যা কেবল কিছু মূল্যবান জীবনই নয়, বহু স্বপ্নকেও পুড়িয়ে চুরমার করে দিয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে কারখানার ভবনটিতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগ করছে। এ পর্যন্ত যতগুলো কলকারখানা বা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সব জায়গাতেই একটা সাধারণ অভিযোগ শোনা যায় আর তা হলো- মূল গেট তালাবদ্ধ কিংবা সিঁড়ি বন্ধ। যার কারণে অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে ভেতরে আটকে থাকে এবং হতাহতের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ উঠেছে।
তবে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ধরন ও প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তাড়াহুড়ো করেই হোক আর খরচ বাঁচাতে গিয়েই হোক নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সহজেই তা থেকে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগছে। পোশাকশিল্পে আগুন লাগার ক্ষেত্রে বিশেষত যে কারণটি লক্ষ্য করা যেতে পারে তা হলো কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ধূমপান করে। যখন বিরতি দেয়া হয় তখন অনেকেই এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে ধূমপান করে। এরপর যখন ঘণ্টা বা সাইরেন বাজে কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য তখন অনেকেই হাতের সিগারেট বা বিড়ির অবশিষ্টাংশটুকু যত্রতত্র ফেলে দেয়। সেই রেখে যাওয়া সিগারেটের অল্প একটু আগুন ভেতরের তাপে আরো বেশি উত্তপ্ত হয় এবং এক সময় ভয়াবহ আগুন হিসেবে সব জ্বালিয়ে দেয়। মশার কয়েল থেকেও অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে।
২০১০ সালের জুনে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে ১২৪ জন নিহত হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেখানে কেমিক্যালের গোডাউন থাকায় আগুন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। এ অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন নিহত হন এবং আহত হন অনেকেই। এছাড়া প্রায়ই কেমিক্যালের গোডাউনগুলোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকে। নিমতলীর ঘটনার পর থেকেই পুরান ঢাকার রাসায়নিক কেমিক্যাল গোডাউন ঢাকার আশপাশে সরিয়ে নেয়ার কথা উঠলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এক সময় পাট ও তুলার গুদামে বেশ আগুন লাগার খবর পাওয়া যেত। এখন বেশি আগুন লাগে মার্কেট, কলকারখানা ও গার্মেন্টসে। তাও প্রধানত রাজধানী ও আশপাশে। এমনকি অত্যাধুনিক ও ডিজিটাল বলে দাবিদার সুপার মার্কেটেও একাধিকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে যেভাবেই আগুনের সূত্রপাত হোক না কেন, আসলে এগুলো কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এ যেন এক একটি হত্যাকাণ্ড, এক একটি স্বপ্নের মৃত্যু, যা কোনোক্রমেই কাম্য ও গ্রহণ করা যায় না। একেকটি অগ্নিকাণ্ড, এতজন মানুষের হাজারো স্বপ্নকে পুড়িয়ে ছারখার হওয়ার গল্প। নিয়মানুযায়ী প্রত্যেকটি অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে, কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট কখনো আলোর মুখ দেখে না। কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। সব কিছু অদৃশ্য শক্তির কারণে হাওয়ায় মিশে যায়, যেন কারো কোনো দায় নেই। যদি দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যেত, তবে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড বা নীরব হত্যাযজ্ঞ ঘটত না। অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ঘটলেও, অন্যরা সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি, অগ্নিকাণ্ড রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করত। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না, আর কোনো স্বপ্নের যেন অকালমৃত্যু না হয়, সে অনুযায়ী দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।