কঠোর লকডাউন : ঘর থেকে বের হলেই ‘কঠোর শাস্তি’

আগের সংবাদ

বদলে গেছে ঢাকার দৃশ্যপট

পরের সংবাদ

রমেশচন্দ্র মজুমদারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতি

প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রমেশচন্দ্র যখন ভাইস চ্যান্সেলর হলেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনাকাল থেকেই রমেশচন্দ্র মজুমদার এমনকি তার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হিন্দু সহকর্মীদের কটু-কাটব্য শুনেও সানন্দে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। ফিলিপ হার্টগ, প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ক্যালকাটা ক্লাবে তাকে ইন্টারভিউ করেছিলেন। ‘বলা বাহুল্য চারশ টাকা থেকে একেবারে আঠারোশ টাকার গ্রেডে চাকরি পেয়ে খুব আনন্দ হলো।’ তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষকে খবরটা দিতে গেলেন তিনি বললেন ‘তুমি এবং আরো কয়েকজন ঢাকায় নিযুক্ত হয়েছ, সে কথা হার্টগ নিজেই আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন।’ যদি কোনো কারণে তার ঢাকায় থাকা সম্ভব না হয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তার জন্য খোলা থাকবে, তিনি তাকে এই আশ্বাসও দিলেন।
তিনি ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক। সাহিত্যিক, আইনজীবী এবং আইনের পণ্ডিত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট। ১৯২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দিলে রমেশচন্দ্র প্রভোস্টের দায়িত্ব নেন এবং ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার আগে পর্যন্ত। টানা ১৩ বছর প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন।
শুরুতে যেমন কথা উঠেছিল বিলেতি সাহেব কেন, ভিসি হওয়ার মতো ভারতীয় কেউ কি ছিলেন না। রমেশচন্দ্র মজুমদার ভিসি হওয়ার পরও মুসলমান নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, মুসলমান কাউকে কি পাওয়া গেল না।

তার স্মৃতিকথা থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি :
‘আমি যখন ভাইস চ্যান্সেলর ছিলাম সেই সময়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবার ঢাকায় আসেন। জিন্নাহ সাহেব তখন ভারতীয় মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা। ঢাকার মুসলমান অধিবাসীদের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান ছাত্রগণের পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য একটি সভা আহ্বান করা হয়। ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমি সেই সভার সভাপতি ছিলাম এবং সভাপতির কর্তব্য হিসেবে সভার প্রথমেই জিন্নাহ সাহেবের পরিচয়সূচক কয়েকটি কথা সংক্ষেপে বলেছিলাম। তার হাবভাব দেখে মনে হলো যে তার সংবর্ধনা সভায় একজন হিন্দু সভাপতি- এটা জিন্নাহ সাহেব পছন্দ করেননি। পরে নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের কাছে শুনেছিলাম যে, তিনি আমার ভাইস চ্যান্সেলর পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন এবং ভারতীয় হলে যে একজন মুসলমানেরই এই পদে নিযুক্ত হওয়া উচিত এ রূপ ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন। তবে এ কথা সর্বান্তকরণে স্বীকার করব যে স্থানীয় মুসলমানদের মনে এর জন্য আমার বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাইনি।’
রমেশচন্দ্র মজুমদার সাড়ে পাঁচ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন এবং তিনি অবশ্যই সফল ভাইস চ্যান্সেলরদের একজন ছিলেন।

রমেশচন্দ্রের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ
রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হন, তার আগে অধ্যাপনা এবং জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট। তার বাড়ি মানে প্রভোস্টের বাড়ি। ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ রমেশচন্দ্রের স্মৃতিকথা থেকে দুটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত হচ্ছে :
বিপুল সংবর্ধনা সহকারে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার স্টেশন থেকে গাড়ি করে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। সেখানকার বড় বড় জমিদার বিশেষত ভাওয়ালের রাজকুমার এবং ঢাকার নবাব আমায় বলে পাঠালেন যে রবীন্দ্রনাথের জন্য কোনো গাড়ি দরকার হলে আমি যেন তাদের জানাতে দ্বিধা না করি। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে ঢাকায় বিপুল উদ্দীপনা; রাস্তায় বহু লোক তাকে সংবর্ধনা জানালেন। আমি তখন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং প্রভোস্টের জন্য নির্দিষ্ট বাড়িতে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা এবং অধ্যাপকদের স্ত্রী- এরা সবাই আমার বাড়িতে এসে কবিগুরুর অভ্যর্থনা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করলেন। তার আমার দিন আমার গৃহদ্বারে, সিঁড়িতে, উপরের বারান্দায় এবং ঘরে নানারকম আলপনা দেয়া হয়, দরজার সামনে মঙ্গলকলস এবং আম্রপল্লব। কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষককে নিয়ে আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম কবিগুরুকে সংবর্ধনা করার জন্য। কবি এসে পৌঁছামাত্রই তার ওপর ফুলবর্ষণ শুরু হলো। মেয়েরা শঙ্খধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানালেন। মঙ্গলকলসের মাঝে পথ দিয়ে আমরা বাড়িতে প্রবেশ করলাম।…
দোতলার যে ঘরে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন তার ঠিক সামনে একটি আমগাছ। তখন গাছটি মুকুলে ভরে গেছে। সকালে চা পানের পর রবীন্দ্রনাথ ওই ঘরের বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে বসে থাকতেন। বলতেন, এভাবে বসে থাকতে ভারি ভালো লাগে।…
আমার বড় মেয়ে- তখন তার বয়স বারো-তেরো বছর, কবিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি নাকি কবিতা লেখেন? কবি বললেন, হ্যাঁ আমার সে দুর্নাম আছে। তখন আমার ছোট মেয়ে একটা নোটবই তার সামনে বের করে বলল, আমার নামে একটা কবিতা লিখে দিন না। কবি তার নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল, ডাকমান সুষমা-ভালো নাম শান্তি। কবি তৎক্ষণাৎ ওই নোটবইতে লিখে দিলেন :
আয়রে বসন্ত হেমা, কুসুমের সুষমা জাগা রে
শান্তি স্নিগ্ধ গন্ধগকুলের হৃদয়ের নিস্তব্ধ আগারে।
ফলেরে আনিবে ডেকে
সেই লিপি যায় রেখে
সুবর্ণ তুলিকাখানি পর্ণে পর্ণে যতনে লাগা রে।

২ ফাল্গুন ১৩৩২ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থে এবং রচনাবলিতে কবিতাটি ঠাঁই পেয়েছে। সে যাত্রাতেই জগন্নাথ হলের ছেলেরা এসে অনুরোধ করায় রবীন্দ্রনাথ যে কবিতাটি লিখেছেন তাতেই হয়ে উঠেছে স্মরণীয় গান :
এই কথাটি মনে রেখো
তোমাদের এই হাসি-খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলাম
জীর্ণপাতা ঝরার বেলায়।

সে সময় রবীন্দ্রনাথের রমেশচন্দ্রের বাড়িতে থাকা ঠেকাতে ঢাকার একটি রমেশবিরোধী রবীন্দ্রভক্ত ক’জন কিছু অপপ্রচারও চালিয়েছেন। এমনকি রমেশচন্দ্রের মতে গোপালচন্দ্র রায় ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ নামক গ্রন্থে বেশকিছু অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। যেমন গোপালবাবু লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ এবং গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছামাত্রই জনসাধারণ তাকে সাদর অভ্যর্থনা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে তুরাগ নামে ঢাকার নবাবের একটি বোটে নিয়ে যায়, ঢাকায় অবস্থানকালে দিনগুলি কবি ঐ বোটেই ছিলেন, ফিরবার আগে দু’একদিন আমার (রমেশচন্দ্রের) বাড়িতে ছিলেন- এই বিবরণীটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
রবীন্দ্রনাথ রমেশচন্দ্রের আতিথ্যেই ছিলেন।
রমেশচন্দ্রের বাড়িতে শরৎচন্দ্র
রমেশচন্দ্র মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ও অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে স্যার যদুনাথ সরকার এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদানের প্রস্তাব ছিল শরৎচন্দ্র নিয়ে কিছুটা আপত্তি উঠলেও উভয় পর্ষদে শেষ পর্যন্ত তা গৃহীত হয়। দু’জন একসঙ্গেই এলেন। যদুনাথ বরাবরের মতো রমেশ মজুমদারের বাড়িতে (জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের বাড়ি) উঠলেন এবং শরৎচন্দ্র সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠলেও দিনের বেশিরভাগ এবং রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত এ বাড়িতে থাকতেন।

‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখছেন :
দিনের বেলা অনেকে তার কাছে আসত। রাত্রে খাওয়ার পর আমরা- আমি, আমার স্ত্রী ও শরৎবাবু- আমাদের বাড়ির পুকুরের ধারে সিমেন্ট-বাঁধান বেঞ্চের ওপর বসতাম। শরৎবাবুর বহু কাহিনী সেই সময় আমরা তার মুখে শুনেছি। শরৎবাবু খুব বৈঠকী লোক ছিলেন। এমন চমৎকার কথাবার্তা তিনি বলতেন যে শুনে সকলেই মুগ্ধ হতো। যে ক’দিন তিনি ঢাকায় ছিলেন এই রকম অনেক কাহিনী এবং নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। (শরৎস্মৃতি তিনি পৃথকভাবে লিখেছেন)… শরৎচন্দ্র আদৌ ভোজনপটু ছিলেন না। তার আহার ছিল খুব সামান্য। কিন্তু যদুনাথের স্বভাব ছিল বিপরীত; তিনি বেশ ভালোই খেতে পারতেন। তাতে শরৎচন্দ্র রেগে যেতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, দেখো বুড়ো খাচ্ছে কি রকম।’ আমি বললাম, ‘এটা আপনার রাগের কথা। আপনি একটি ব্যতিক্রম। আপনার সাহিত্যগুরু রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িতে ছিলেন। তিনিও বেশ খেতে পারতেন।’ শুনে শরৎবাবু অবাক হয়ে গেলেন।
রমেশচন্দ্র লিখেছেন, যখন শরৎচন্দ্রকে ডি. লিট প্ল্যানের প্রস্তাব করেন হিন্দুদের মধ্যেও একটি সাহিত্যিক দল প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন- ‘এদের মধ্যে কয়েকজন খ্যাতনামা সাহিত্যিকও ছিলেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবিভাগও আপত্তি করে।’ অন্যদিকে মুসলমানরাও জানিয়ে দেয় শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট দিতে হলে একজন মুসলমানকে ডি. লিট দিতে হবে। রমেশচন্দ্র যখন নাম প্রস্তাব করতে বললেন, তারা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে মোহাম্মদ ইকবালের নাম প্রস্তাব করলেন। তা মেনে নেয়া হলে তারা আপত্তি প্রত্যাহার করে নেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সম্মানিত করেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় এবং গৌরবজনক দায়িত্ব পালন করল। রমেশচন্দ্র মজুমদার তখন জগন্নাথ হলেন প্রভোস্ট। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসেছেন ‘মুন্সীগঞ্জে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে। সাহিত্য শাখার সভাপতি শরৎচন্দ্র আর ইতিহাস শাখার সভাপতি রমেশচন্দ্র। শরৎবাবু দিনের বেলা ঘন ঘন হুক্কা টেনে তামাক আর চা খাওয়া ছাড়া অন্যকিছু খেতেন না। সভাস্থলে যাবার জন্য শরৎবাবুসহ সকলেই যখন প্রস্তুত একটা অঘটন ঘটল। সভাপতির যে অভিভাষণ লিখে এনেছিলেন তার আর খোঁজ মিলছে না। পকেট তল্লাশি, বাক্স তল্লাশি সব সারাড় করার পরও দেখা মিলন না। সভার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, সভাস্থল থেকে আয়োজনকারীরা তাগিদ দিতে ছুটে এলেন। ব্যস্ত ও বিচলিত শরৎবাবু বললেন, ‘একটু আগে আমি এই খাটে বসে তা পড়েছি কোথায় গেল?’
রমেশচন্দ্র লিখছেন ‘তখন আমার হঠাৎ মনে পড়ল যে কিছুক্ষণ পূর্বে শরৎচন্দ্র তামাক খাবার সময় কল্কেটা গরম ছিল বলেই হোক অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক খানিকটা কাগজ হাতের মধ্যে মুঠো করে ধরে ব্যবহার করেছিলেন, পরে তামাক খাওয়া হলে তা দূরে ফেলে দিয়েছিলেন। চেয়ে দেখলাম ঘরের এক কোণে বেনের পুঁটুলির সঙ্গে সেই কাগজের মোড়কটি পড়ে আছে। আমি সেটি কুড়িয়ে এনে খুলে দেখি, খুব ছোট ছোট অক্ষরে লেখা একটি সাহিত্যিক সন্দর্ভ। আমি শরৎবাবুকে সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? তিনি আমার হাত থেকে ওটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে দেখেই বললেন, আরে, এইত আমার অভিভাষণ। কোথায় পেলে? আমি হাসতে হাসতে তাকে সব বললাম। উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলেন, কিন্তু শরৎবাবু কিছুমাত্র অপ্রতিভ হলেন না।

রমেশচন্দ্র বাড়িতে সরোজিনী নাইডু
১৯৩৯ সালের কনভোকেশন স্পিকার হিসেবে ঢাকা আসতে সম্মত হয়েছেন কবি, রাজনীতিবিদ এবং সে সময়কার সবচেয়ে আলোচিত নারী সরোজিনী নাইডু। তার পিতৃভূমি বিক্রমপুরের লৌহজং থানার ব্রাহ্মণগাঁও (এখন পদ্মায় বিলীন)। কলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ এবং গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রমেশচন্দ্র তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়িতে তার বাড়িতে নিয়ে আসবেন। অল্পদিন আগে গান্ধীর সঙ্গে মতবিরোধের জের ধরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হলে বাংলা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যেহেতু সরোজিনী গান্ধীপন্থি ছাত্রদের সিদ্ধান্ত তাকে কালো পতাকা দেখিয়ে অপমান করবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার পথে ছ-সাত মাইল আসার পর ছাত্ররা কালো পতাকা দেখায়, শেইম শেইম ধ্বনি দেয় এবং পথ আটকায়। রমেশচন্দ্র নেমে গিয়ে ছাত্রদের বললেন, কালো পতাকা দেখে তিনি নিশ্চয়ই অপমানিত হয়েছেন, তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে। কাজেই পথ ছেড়ে দাও।
তারপর নির্বিবাদে বাসায় পৌঁছলেন। সরোজিনী নাইডু তার স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গে মিশে গেলেন। খেতে বসে বললেন, মুরগির গিলাটা তার পছন্দ, রমেশচন্দ্রের স্ত্রীকে বললেন, সেটাই চান।
ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি সরকারি চিঠি পেলেন, সরোজিনীর ভাষণের কপি দশ-বারো দিন আগে দাখিল করতে হবে। যখন ভিসি এ কথা জানাতে সরোজিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, তিনি বলে দিলেন তিনি কোথাও লিখিত বক্তৃতা দেন না। সরকার তারপর তার ভাষণের সারাংশ চাইল, তিনি তাও না বলে দিলেন।
রমেশচন্দ্র লিখেছেন : কনভোকেশন অনুষ্ঠানে তিনি যে অপূর্ব বাগ্মিতা সহকারে সুললিত ও আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা শুনে শ্রোতারা সবাই একেবারে বিস্ময়ে অভিভূত। বিশাল কার্জন হল নিস্তব্ধ, কারো মুখে কোনো সাড়া নেই। গভর্নরের স্টেনো এবং আমার স্টেনো দু’জনের প্রতিই নির্দেশ ছিল শ্রীমতী নাইডুর ভাষণ লিখে রাখার। অনুষ্ঠান শেষে তারা বলল যে, যে গতিতে তিনি বলে গেছেন তাতে তাদের সাধ্য নেই শর্টহ্যান্ডে তা লিখে রাখা, বলা বাহুল্য এরা দু’জনেই খুব দক্ষ স্টেনো ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং বাংলার গভর্নর স্যার জন উডহেড তার ভাষণ শুনে এতটাই আপ্লুত যে, তিনি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। রাজনৈতিক কারণে সরোজিনী তা প্রত্যাখ্যান করলেও তারই দেয়া শর্ত মেনে গভর্নর তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। শর্ত ছিল তার সাক্ষাতের সময় তার কোনো স্টাফ থাকতে পারবে না। গভর্নর সবাইকে সাময়িক ছুটি দিয়ে দেন, সরোজিনী যখন পানি চাইলেন, গভর্নর নিজে উঠে গিয়ে ভেতর থেকে পানি নিয়ে এলেন। সরোজিনীর অসাধারণ সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রমেশচন্দ্রের বইবীক্ষণ চরিত্রবীক্ষণ
ইতিহাস গবেষণায় রমেশচন্দ্রকে ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করতে হয়। কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও তাকে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যেতে হয়। দুটো লাইব্রেরি তাকে দুই জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও একটি ধারণা দেয়। তিনি লিখছেন, ‘ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আমি একটি ছোট অ্যাটাচি কেস সঙ্গে নিয়ে যেতাম। তার মধ্যে আমার খাতাপত্র ও অভিধান থাকত। কিন্তু আমার আসা-যাওয়ার সময় কেউ তা খুলে দেখত না। প্যারিসের লাইব্রেরিতে ঢোকা এবং ফেরার সময় অ্যাটাচি কেস খুলে কি আছে না আছে সব পরীক্ষা করা হতো। এ দেখে আমার মনে হলো লন্ডনের লোকেরা সাধারণত সৎ এবং বই চুরি করে না। প্যারিসে চুরি হয়। কেবল প্যারিসের কথা বলি কেন, আমি নিশ্চিত জানি আমাদের দেশে লন্ডনের মতো ব্যবস্থা থাকলে লাইব্রেরির বহু বই-ই অদৃশ্য হয়ে যেত। কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির অবস্থা দেখেছি। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির কথা শুনেছি। বহু কড়াকড়ি করা সত্ত্বেও প্রতি বছর অনেক বই চুরি যায়। বইয়ের মাঝের অনেক পৃষ্ঠা ছুরি বা সূ² ব্লেড দিয়ে বেমালুম কেটে নেয়া হয়।’ রমেশচন্দ্র অক্সফোর্ডের একটি কলেজ লাইব্রেরির বিবরণ দিয়েছে : সেখানে এক কলেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি যে, ছাত্ররা নিজেরা বই নিয়ে যাচ্ছে; কেবল একটি খাতায় নিজের নাম এবং বইয়ের নাম লিখে রাখছে। কে কি বই নিল বা রাখল তা দেখার জন্য কোনো কর্মচারী নেই। আমার তখনই মনে হলো ঢাকায় এ রকম ব্যবস্থা থাকলে বছরে অন্তত দু’হাজার বই যে চুরি যেত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে লাইব্রেরির জন্য বছরে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ হতো- এর দশ-পনেরো হাজার চলে যেত দারোয়ান বেয়ারা কর্মচারী নিয়োগ করে, চুরি ঠেকাতে। পুরো টাকাটা যদি বইয়ের জন্য খরচ করা যেত লাইব্রেরি অনেক সমৃদ্ধ হতো। রমেশচন্দ্র আফসোস করেছেন : ‘আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এ ধরনের নীতিজ্ঞানের বড়ই অভাব।’

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়