অর্থনৈতিক অঞ্চলে সৌদিকে জমির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

আগের সংবাদ

চিকিৎসা গবেষণায় আগ্রহ কম : বরাদ্দ, অবকাঠামো সীমিত > প্রণোদনা স্বল্পতা > প্রাইভেট প্র্যাকটিসে মনোযোগ বেশি

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িকতায় ক্ষত-বিক্ষত মানবতা মনুষ্যত্ব ও সম্প্রীতি

প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি জাতিরই বর্ণাঢ্য ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। নিজেদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে ইতিহাস পাঠের বিকল্প নেই। ইতিহাস পাঠে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ব্যক্তিমাত্রকেই আত্মপরিচয়ে-দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। ইতিহাস শিক্ষা আবশ্যিক এবং অপরিহার্য বটে। জ্ঞানচর্চা-জ্ঞান বিকাশে ইতিহাস শিক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস শিক্ষার পরিধি ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে ইতিহাস অংশকে ক্রমাগত সঙ্কুচিত করা হয়েছে। ইতিহাস শিক্ষার প্রতি এই অবহেলা জাতির মানস গঠনের অন্তরায় রূপেই বিবেচনার দাবি রাখে। আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমে ইতিহাস অংশকে ছেটে-কেটে সঙ্কুচিত করার কারণে ইতিহাস শিক্ষা এখন গুরুত্বহীন এবং চরম অবহেলায় পরিণত। জাতির জন্য ক্ষতির পরিমাণটা ভয়াবহ। ইতিহাস শিক্ষার এই সঙ্কোচন জাতির মানস গঠনে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। অথচ পাকিস্তানি আমলে ইতিহাসের পরিধি ছিল অনেক বড় ও বিস্তৃত। যদিও সেই পাঠ্যক্রমের ইতিহাসে আমাদের ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাসের পরিবর্তে মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজা-বাদশা, দস্যু-দুর্বৃত্তদের স্থান ছিল সর্বাধিক। ভারতবর্ষের ইতিহাস অংশে দিল্লির সুলতানশাহী আমল; খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ, লোদি বংশ, পরাক্রম লুটেরা সুলতান মাহমুদ, তৈমুরলং এবং মোগল সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন মুসলিম বাদশাহ, নবাবদের শাসনামলকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ পর্বটি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে-উদ্দেশ্যমূলক সম্প্রদায়গত ইতিহাস শিক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিল। যার মূলে ছিল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি। পাকিস্তান সৃষ্টি প্রসঙ্গে পাঠ্যের ইতিহাসে মুসলিম লীগ, আলীগড়ের মুসলিম নেতৃত্ব এবং জিন্নাহর গুণকীর্তন ছিল সর্বাধিক। দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষাবলম্বনে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা এবং প্রয়োজনীয়তাকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। সেই ইতিহাস পাঠে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যপূর্ণ প্রকৃত ইতিহাস জানার উপায় ছিল না। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন-সংগ্রামকে কেবল পরিহারই করা হয়নি। বিকৃতভাবে উপস্থাপন পর্যন্ত করা হয়েছিল। সেই ইতিহাসে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিপক্ষরূপে ব্রিটিশদের নয়, জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু সম্প্রদায়কেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। বাস্তবে পৃথক রাষ্ট্র ভারত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কংগ্রেস এবং হিন্দু মধ্যবিত্তদের। ব্রিটিশদের দয়া-ভিক্ষার তথাকথিত স্বাধীনতা(!) প্রাপ্তিতে ব্রিটিশদের ১৯০ বছরের শোষণ-লুণ্ঠনের সুদীর্ঘ অনাচারের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল। ইতিহাসের সেই বিকৃতির মূলে ছিল ভারত ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অভিপ্রায়। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাক্রমে কেবল ইতিহাস শিক্ষাই উপেক্ষিত হয়নি। উপেক্ষিত এবং কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বিজ্ঞানও। সম্প্রতি হেফাজতিদের দাবির মুখে বিবর্তনবাদকে পাঠ্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একসময়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। এখন সেই আগ্রহ বাণিজ্যে। যারা বিজ্ঞান-বাণিজ্যে যোগ্য নয়, একমাত্র তারাই নিরুপায়ে মানবিকে অধ্যয়নে বাধ্য হচ্ছে। ইতিহাস মানবিকেরই অংশ। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাণিজ্যের কদর আকাশচুম্বী। বিজ্ঞানও সে তুলনায় পিছিয়ে। মানবিকের বেহাল দশা। অবজ্ঞা-তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে পরিণত। ইতিহাস শিক্ষা বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষীণ থেকেও ক্ষীণতর পর্যায়ে।
আমার বাবা প্রায়শ রসিকতা করে বলতেন, ‘আমার এ জীবনে আমি তিনটি পৃথক রাষ্ট্রের নাগরিকরূপে জীবন অতিবাহিত করছি।’ আমিও বলতাম তিনটি না হলেও দুটি পৃথক রাষ্ট্রের নাগরিক তো আমিও। ১৯৪৬-এর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী বাবার কাছেই শুনেছিলাম- সেই দাঙ্গায় বাঙালি হিন্দু-মুসলমান অংশ নেয়নি। তারা একে অপরকে রক্ষায় তৎপর ছিল। বিহারি মুসলমান এবং অবাঙালি হিন্দু-শিখ সম্প্রদায় একাট্টা হয়ে মর্মান্তিক সেই দাঙ্গা সংঘটিত করেছিল। শিখ সম্প্রদায় হিন্দু নয়; তারা কেন হিন্দুদের পক্ষে দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল? তেমন প্রশ্নে বাবা বলেছিলেন- শিখ সম্প্রদায়ের দুই প্রধান গুরুকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং আওরঙ্গজেব হত্যা করেছিলেন। সেই কারণে শিখ সম্প্রদায় বহুপূর্ব থেকেই মুসলিম বিদ্বেষী। বিহার প্রদেশের অধিবাসীদেরই বিহারি বলা হয়। ভারতবর্ষের পশ্চাৎপদ প্রদেশের অন্যতম বিহার। শিক্ষা, সংস্কৃতি বঞ্চিত এবং অর্থনৈতিকভাবে দারিদ্র্যপীড়িত প্রদেশ বিহার। পাকিস্তানি আমলে বিহারিদের দৌরাত্ম্য এবং মুক্তিযুদ্ধে বিহারিদের নৃশংস ভূমিকা দেখেছিলাম।
আমাদের স্বাধীনতার পর জেনেছি, নেতাজী সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রাসবিহারী বসুসহ স্বদেশি সশস্ত্র আন্দোলনে আত্মদানকারী কিশোর ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, বিনয়, বাদল, দীনেশ, পাঞ্জাবের ভগৎ সিং এবং চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সূর্যসেন, প্রীতিলতাসহ অসংখ্য বীর আত্মত্যাগীদের কথা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস পাঠ্যে যাদের সম্পর্কে জানার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না। দেশপ্রেমিক বীর আত্মত্যাগীদের গৌরবগাথা ইতিহাসে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিহার করা হয়েছিল। হিন্দু জমিদার, মহাজনদের কবল থেকে রক্ষার অভিপ্রায়েই পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু মোহভঙ্গে বিলম্ব হয়নি।
দ্বিজাতিতত্ত্বের আবির্ভাব এবং পাকিস্তান আন্দোলন দুই সম্প্রদায়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এবং এর মূলে ছিল উপনিবেশিক শাসকদের সুগভীর চক্রান্ত। ভারত বিভক্তিকরণের মূলেই ছিল ব্রিটিশদের শঠতার কূটচাল। পাশাপাশি ছিল ক্ষমতা প্রত্যাশী লীগ, কংগ্রেসের ক্ষমতার লিপ্সা। ব্রিটিশদের ইচ্ছাপূরণে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস দল অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করেছিল। জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলনে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। ব্রিটিশ বিরোধিতায় জাতীয় কংগ্রেস, স্বদেশি বিভিন্ন দল, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মী প্রত্যেককেই জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লীগের কাউকে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়নি। এমনকি একজন মুসলিম লীগ নেতাকর্মীকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়নি। মুসলিম লীগের জন্ম এবং দেশভাগের দাবির পেছনে মদত জুগিয়েছিল- কলকাঠি নেড়েছিল চতুর ব্রিটিশ। তাদের ভাগ কর, শোষণ কর নীতিতে। কংগ্রেসের পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান এবং প্রচারণায় মুসলমানদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা সহজ করে দিয়েছিল। মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র এবং দেশভাগে কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক নেতৃবৃন্দের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। গান্ধীর অহিংস নীতির প্রতি সমর্থন না থাকলেও, দেশভাগের মর্মান্তিক দাঙ্গায় মুসলিম সম্প্রদায় রক্ষায় গান্ধীর ভূমিকার প্রশংসার দাবি রাখে। একমাত্র গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক ভূমিকার কারণেই ভারতে অবস্থানকারী মুসলিম সম্প্রদায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল। গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক তৎপরতায় ক্ষুব্ধ হিন্দু মহাসভার কর্মীদের হাতে স্বাধীন ভারতে তাকে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল।
বাংলা ভাগ রোধে অনেকের সক্রিয় ভূমিকা ছিল কিন্তু বাংলা ভাগ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। হিন্দুমহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিতর্কিত ভূমিকায় বাংলা ভাগ নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্ত বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্নের দাবি তুলে বাংলা ভাগ অনিবার্য করেছিলেন। নেতাজী সুভাষের ভাই শরৎ বসু, মুসলিম লীগের আবুল হাসিম এমনকি সোহরাওয়ার্দী পর্যন্ত কলকাতার আবাস হারানোর আতঙ্কে বাংলা বিভক্তি রোধে চেষ্টা করেছিলেন। জিন্নাহর অতি অনুগত সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর ধমক খেয়ে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। নানা কারণেই বাংলা বিভক্তি রোধ করা যায়নি। বাংলা বিভক্তিতে রক্তাক্ত দাঙ্গা, উচ্ছেদ-বিচ্ছেদ ও উৎপাটনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গজুড়ে। পূর্ববঙ্গ থেকে প্রত্যাগত হিন্দু সম্প্রদায়ের অমানবিক দুর্দশাপূর্ণ দুরবস্থার অসংখ্য ঘটনার বিষয় জানা যায়। নতুন প্রাদেশিক সরকারের নাকাল অবস্থা হয়েছিল লাখ লাখ শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে আগমনে। নিঃস্ব-রিক্ত, সহায়-সম্বলহীন পূর্ববঙ্গ থেকে প্রত্যাগত হিন্দুদের মানবেতর অবস্থার কথা এবং শিকড় বিচ্ছিন্ন মানুষদের দুর্দশা দেখার স্মৃতিকথা অনেকেই লিখেছেন। একমাত্র সম্প্রদায় ভিন্নতায় বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় মাতৃভূমি-ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। শঠতার সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির শিকার পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু-মুসলিমদের সম্প্রদায়গত পরিচয়টিই পরস্পরের শত্রæতে পরিণত করেছিল এবং দেশত্যাগে পরস্পরকে বাধ্য করেছিল। বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতা উপমহাদেশজুড়ে আজো বিদ্যমান। কারণে-অকারণে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। রাজনীতির দাবার চালে সাম্প্রদায়িকতা বারবার হানা দেয়। ক্ষত-বিক্ষত করে মানবতা, মনুষ্যত্ব, সম্প্রীতি, দেশপ্রেম।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়