মাহমুদুর রহমান মান্না : খালেদা জিয়া এখন তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছেন

আগের সংবাদ

ওমিক্রন ঠেকাতে চার সুপারিশ

পরের সংবাদ

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রহস্যের বাতাবরণ : তারেকের নির্দেশে নেতাদের মুখ বন্ধ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবি নিয়ে রাজপথে বিএনপি। তবে দলটির সিনিয়র নেতারা আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সন্দিহান। লন্ডনে পালিয়ে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চাপেই নামকাওয়াস্তে মাঠে আছেন তারা। নেতাদের অভিযোগ, খালেদার অসুস্থতা নিয়ে এক ধরনের রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করে রেখেছেন তারেক রহমান। তিনি চান না তার মায়ের অসুস্থতার প্রকৃত অবস্থা নেতারা জানুক। তাই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ছাড়া অন্য সিনিয়র নেতাদের হাসপাতালে দেখতে যেতে বা খালেদা জিয়ার বিষয়ে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছেন। তারেকের নির্দেশ ‘আন্দোলন করতে হবে’। কিন্তু বিএনপি যে কর্মসূচি দিয়েছে- তা দিয়ে সরকারের টনক নড়ানো যাবে, এমনটি আশা করেন না বিএনপির কোনো স্তরের নেতাকর্মীই। বরং সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে মোটেও বিচলিত নন ক্ষমতাসীনরা।
খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে- গত ১৯ নভেম্বর মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যের পর বিএনপিপ্রধানের অসুস্থতা নিয়ে দলের ভেতরে শুরু হয় তোলপাড়। জোরালো দাবি ওঠে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর। কিন্তু দলীয় চেয়ারপারসন যখন ‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা’ লড়ছেন; তখন দলের সিনিয়র নেতারা কেন

একবারের জন্যও তাকে দেখতে হাসপাতালে গেলেন না- এ নিয়ে খোদ বিএনপিতেই শুরু হয় আলোচনা। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, তারেক রহমান স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, আমরা যেন দলীয় চেয়ারপারসনকে দেখতে হাসপাতালের ধারেকাছেও না যাই। তার বিষয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলতেও নিষেধ করে দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা সেই নির্দেশনা মেনে চলছি।
খালেদার পরিবারের সদস্যরা কোথায় : গত ১৩ নভেম্বর চতুর্থ বারের মতো খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার বড় বোন সেলিমা ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তার বোন (খালেদা জিয়া) খুবই অসুস্থ। তারা যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে চান এবং যে দেশেই অনুমতি মিলবে, সেখানেই তারা নেবেন বলে জানান সেলিমা। তবে এরপর তিনি বোনের চিকিৎসার ব্যাপারে আর কোনো কথা বলেননি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মীলা রহমান সিঁথি হাসপাতালে থেকে শাশুড়ির সেবা-যতœ করলেও তিনি কোনো বিষয়ে কথা বলেন না।
কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার অনুমতি চেয়ে তার ভাই শামীম ইস্কান্দর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করেন। জানা গেছে, আবেদন করেই তিনি আমেরিকা চলে গেছেন। এর আগে খালেদা জিয়া শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে বাসায় থাকা, এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা, বারবার আবেদন করাসহ সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করেছিলেন তিনি। কিন্তু বোনের শরীরের এমন সংকটময় পরিস্থিতে তিনি কেন দেশে ফিরছেন না- এ নিয়েও ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে আইনি জটিলতায় তারেক রহমান অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে আসতে পারবেন কিনা- তা নিয়ে নানা জটিলতা থাকলেও তার স্ত্রী এবং কন্যার আসতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। কারণ তারেকের স্ত্রী জোবায়দা রহমান গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়ার মেডিকেল টিমের প্রধান হিসেবে লন্ডন থেকে শাশুড়ির চিকিৎসার ব্যাপারে মনিটরিং করছেন। সে হিসেবে অসুস্থ খালেদা জিয়ার সেবা করতে তিনি যদি দেশে আসতে চান সে ব্যাপরে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ব্যারিস্টার মানোয়ার হোসেন বলেছেন, তারেকের পরিবার অবশ্যই আসতে পারে, সেখানে কোনো বাধা থাকবে না। তবে এখনো পর্যন্ত জোবায়দা রহমান বা জাইমা রহমান খালেদা জিয়াকে দেখতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এমন খবর পাওয়া যায়নি।
তারেকের নীরবতায় রহস্য : মা (খালেদা জিয়া) ‘ডিকম্পেনসেটেড লিভার’ রোগে ভুগছেন। তবুও এ নিয়ে রহস্যজনক নীরবতায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলো থেকে তারেকের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বললেও খালেদা জিয়া ইস্যুতে তারেক রহমানের নেই কোনো বক্তব্য বা ঘোষণা। দেশের বাইরে বসে দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললেও মা খালেদা জিয়াকে নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী কিংবা দেশ ও জাতির জন্য নেই কোনো বক্তব্য। এমন পরিস্থিতিতে দলের ভেতরে মায়ের ইস্যুতে সন্তানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খালেদা জিয়া ইস্যুতে তারেক রহমানের স্পষ্ট বক্তব্য বা ঘোষণার দাবি উঠেছে।
অন্ধকারে খোদ সিনিয়র নেতারা : দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছেন বিএনপির নেতারা। তারা নিজেরাও ভালো করে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কি জানেন না। এমনকি দলীয় প্রধানকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পারছেন না তারা। এ বিষয়ে আলাপকালে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করেন নেতারা। তারা বলেন, ইচ্ছা থাকলেও হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি নেই আমাদের। পরিবারের সদস্যরা সব কিছুর মধ্যে আমাদের জড়াতে চান না।
সূত্র জানায়, গত ২২ নভেম্বর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সামনে দলীয় প্রধানের চিকিৎসা ইস্যুতে নেতারা বলেন, খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক যে অবস্থা, তাতে আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে। এর চেয়ে মহাসচিবের নেতৃত্বে সিনিয়র নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলে হয়তো সরকার প্রধানের মন নরম হতে পারে। এমন প্রস্তাবে তারেক রহমান বলেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আপাতত আন্দোলন চালিয়ে যান।
এছাড়া সিনিয়র নেতারা কয়েক দফা হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখতে যেতে চাইলেও বলা হয়েছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে। ফলে খোদ দলের নেতাকর্মীরাই প্রকাশ্যে বলে ফেলছেন, মায়ের অসুস্থতা নিয়ে তারেক রহমান রাজনীতি করতে চাচ্ছেন। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে চাচ্ছেন তিনি। এ জন্য পরিবারকে সামনে রেখে দলকে দূরে রাখা হয়েছে।
দলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট তথ্য না থাকায় বিভ্রান্তি : খালেদা জিয়ার অসুস্থতার ধরন নিয়ে দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অনেকটাই অন্ধকারে রয়েছেন। যথাযথভাবে তথ্য সরবরাহ না করার কারণে গুঞ্জন আর গুজব ডালপালা বিস্তার করছে। কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তথ্য সেটি যাচাই করতে তখন হিমশিম খাচ্ছেন সাংবাদিকরা। গত ২০ নভেম্বর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয় এন্ডোসকোপি পরীক্ষায় খালেদা জিয়ার ‘লিভার সিরোসিস’ ধরা পড়েছে। বিএনপি প্রধানের সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল তার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, তার রোগ ও শারীরিক অবস্থার কথা প্রচার করা না হলেও আমি খোঁজ-খবর করে নিশ্চিত হয়েছি, তিনি তার পুরনো জটিল রোগগুলো ছাড়াও ডিকমপেন্স্যাটেড লিভারসিরোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন। পরের দিন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, এই খবর সঠিক নয়। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিন অনেকটা একই সুরে কথা বলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) অত্যন্ত গুরুতরভাবে অসুস্থ। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। এই কথাটাই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট কথা।
জানা গেছে, দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে মির্জা ফখরুল ছাড়া দলের অন্য কেউ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারবেন না। এ কারণে ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাও এখন সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলছেন না। এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসা আর অসুস্থতা নিয়ে প্রতি রাতেই খালেদা জিয়ার মৃত্যুর গুজব রটছে। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য- রোগীর প্রাইভেসি রক্ষা করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইনগতভাবে বাধ্য। তাই তারা এ নিয়ে কথা বলবেন না।
হাসপাতালে যেতে বাধা নেই ভিন্ন দলের নেতাদের : খালেদা জিয়াকে দেখতে হাসপাতালে যেতে সিনিয়র নেতাদের অনুমতি না মিললেও অন্যান্য ছোট দলের বড় নেতারা ঠিকই যাচ্ছেন। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, রেজা কিবরিয়া, ভিপি নূর, জোনায়েদ সাকি, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকেই খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখে এসে তার শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর ইব্রাহিমসহ ৫ জন নেতা নিজ উদ্যোগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে লিখিত আবেদন দিয়েছেন। এসব বিষয়ে বিএনপির নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আমরা রাজপথে থেকে দাবি আদায় করে যেতে চাই। কিন্তু ম্যাডামের (খালেদা জিয়ার) জন্য যে কাজগুলো আমাদের করার কথা- তা অন্য দলের নেতারা করছেন। কিন্তু আমরা সুযোগ পাচ্ছি না।
জনমত সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি : খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আট দিনের কর্মসূচি চলছে বিএনপির। পরিস্থিতির পরিবর্তনে আগামীতে কর্মসূচি যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে দলটির। ইতোমধ্যে ‘রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে’ খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে ‘জনমত সৃষ্টি’ হওয়ায় বিকল্প কোনো পথে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদেশে যেতে পারেন খালেদা জিয়া এমন চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর। বরং সরকারই নিজ দায়িত্বে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে তারা পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছেন, ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর। বরং খালেদা জিয়ার কোনো অঘটন হলে সরকারকেই এর দায় নিতে হবে। ২৩ নভেম্বর বিএনপি মহাসচিবও সাংবাদিকদের জানান, এ ধরনের (ক্ষমা চাওয়া বিষয়) কোনো চিন্তা বিএনপির নেই।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এটা শিশুরাও জানে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়। কোন বেয়াক্কল বলে এসব কথা। আমরা আবেদন করলে তো আরো আগেই করতাম। এসব বেয়াক্কলি কথাবার্তা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়