গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

শান্তরক্ষিত > আলো হাতে আঁধারের যাত্রী : মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান > ব্যক্তিত্ব

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলা অঞ্চলে শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, ‘শিক্ষা’ এবং ‘আত্মিক মুক্তি’ বিষয় দুটো এখানে একসঙ্গে সব সময়ই মিলে মিশে আছে। তাই কয়েক হাজার বছরের এই ঐতিহ্যের কারণে বাংলায় একবারে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত এই ধারাটি প্রতিফলিত হয়েছে বরাবরই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী যেমন বাংলায় পড়তে আসতেন তেমনি বাংলা থেকে অনেক জ্ঞানী গুণী পণ্ডিতকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নানা দেশে জ্ঞানের আলো জ¦ালাতে।
চায়নিজরা প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে ভ্রমণ সম্পর্কে বলতেন, ‘বুদ্ধের জ্ঞান অর্জনে ওয়েস্টার্ন হেভেন বা পশ্চিমের স্বর্গে যাও।’ বাংলা ছিল এই ওয়েস্টার্ন হেভেনের কেন্দ্রস্থল। এই অঞ্চলের নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর বা পাহাড়পুর, উদন্তপুর, জগদ্দল, ত্রৈকুটক, দেবিকোট, পণ্ডিত, ফুল্লবাড়িসহ বিভিন্ন মহাবিহার ও বিহার ছিল বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিহার ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখায় এত উন্নত ছিল যে বিশ্বে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে নানা দেশ থেকে বিদ্যার্থীরা বাংলায় আসতেন। চায়না, নেপাল, তিব্বত, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়া, জাভা, মধ্য এশিয়াসহ নানা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে এসব বিহারের প্রভাবে।
নালন্দার প্রখ্যাত আচার্য বা অধ্যাপক শান্তরক্ষিত ছিলেন বাংলার বিক্রমপুরের রাজবংশের সন্তান। অষ্টম শতকে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারে শান্তরক্ষিত সবচেয়ে প্রভাবশালী বৌদ্ধ পণ্ডিত হিসেবে বিবেচিত হন। পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের রাজত্বকালে শান্তরক্ষিতের জন্ম এবং দ্বিতীয় স¤্রাট ধর্মপালের সময়ে তার মৃত্যু হয়। শান্তরক্ষিত তিব্বত যাওয়ার প্রায় তিনশ বছর পর তার উত্তরসূরি শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে যান বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে। পরবর্তী সময়ে তিব্বতের ঐতিহাসিক সুম পা লেখেন, ‘শান্তরক্ষিত পূর্ববাংলার লোক ছিলেন এবং অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যে রাজ পরিবারে জন্মেছেন সেই একই পরিবারে জন্মেছিলেন শান্তরক্ষিত।’
তিব্বতের রাজা ত্রি-সং-দেউ-ৎ-সান ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তাকে আগ্রহী করে তোলেন তার মন্ত্রী সাল-নাং। মন্ত্রীর পরামর্শে রাজা নালন্দার বিখ্যাত পণ্ডিত শান্তরক্ষিতকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানান। প্রথমবার শান্তরক্ষিত চার মাসের একটি সংক্ষিপ্ত সফরে যান। রাজার পক্ষ থেকে তাকে ব্যাপক ভাবে সম্মাননা জানানো হয়। এরপর শান্তরক্ষিত নেপালে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। পরবর্তীতে সাল-নাং-এর উদ্যোগে তিনি আবার তিব্বতে যান। পনের বছর ধর্মপ্রচারের পর তিব্বতে তার প্রতিষ্ঠিত সাম-ইয়ে বিহারে আচার্য শান্তরক্ষিত মারা যান। তিনি বাংলার ওদন্তপুর বিহারের আদলে সাম-ইয়ে বিহার তৈরি করিয়েছিলেন। এটিই ছিল তিব্বতের প্রথম বৌদ্ধ বিহার। তিনি ছিলেন এই বিহারের প্রথম আচার্য। যার ফলে তাকে স্থানীয়রা ‘খেনচেন’ বা মহান অধ্যক্ষ নামে ডাকতেন। তিনশ বছর পর অতীশ দীপঙ্কর যখন সাম-ইয়ে বিহারে যান তখন সেখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির পাশেই আচার্য শান্তরক্ষিতের মূর্তি দেখতে পান। পাশে ছিল সেই সময়ের স¤্রাট ঠি-সোঙ-দে চানের মূর্তি। পূর্বপুরুষের মূর্তি দেখে অতীশ দীপঙ্কর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। সাম-ইয়ে বিহারের পূর্বদিকে পাহাড়ের কাছে শান্তরক্ষিতকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে এক দুর্ঘটনায় সমাধি স্তূপটি ভেঙে যায়। আচার্যের করোটি ও অস্থি পাঁজর বাইরে বেরিয়ে পড়লে একটি কাঁচের বক্সে ভরে বিহারের প্রধান মন্দিরে এনে রাখা হয়, যা এখনো সংরক্ষিত আছে।
তিব্বতের মানুষ আচার্য শান্তরক্ষিতকে সম্মানসূচক ‘শি-বা-ৎশো’ বা শান্তিজীব নামেও সম্বোধন করতেন। তার আরেক নাম ‘আচার্য বোধিসত্ত্ব’। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের আগে পুরো তিব্বতের প্রধান ধর্ম ছিল পোন ধর্ম। নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে শান্তরক্ষিতকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। ক্রমে পোনধর্মকে ছাড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে। পোন ধর্ম এখনো তিব্বতে প্রচালিত আছে। শান্তরক্ষিত বজ্রযানী আচার্য ছিলেন। তিনি যোগাচার-মাধ্যমিক ধারা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তিব্বতে তিনি তার জীবনের শেষ প্রান্তে যান এবং সেখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। সেগুলোর মধ্যে ‘অষ্ট তথাগত স্তোত্র’, ‘বজ্রধর সংগীত ভগবতস্তোত্র টীকা’, ‘তত্ত্বসংগ্রহকারিকা’ অন্যতম। তার আলোচিত তত্ত্বসংগ্রহকারিকা বইটিতে তিনি বৌদ্ধধর্মের অনাত্মবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।

শান্তরক্ষিতের উপস্থাপিত বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা তিব্বতের মানুষকে নতুন ভাবনার সামনে দাঁড় করায়। যার ফলে তার এই ধারাটি অষ্টম-নবম শতকের মধ্যে তিব্বতে একটি প্রভাব বিস্তারকারী মতবাদে পরিণত হয়। তিনি সেখানে ধর্মের আবশ্যকীয় তত্ত্বগুলোর তুলে ধরতেন। তিনি ছিলেন ধর্মকীর্তির একজন গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্যকার। তিব্বতে শান্তরক্ষিতের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে কয়েকজন প্রভাবশালী ভিক্ষু-কে দীক্ষা দেয়া। তিনিই সেখানে প্রথম আশ্রম ভিত্তিক সংঘ ও শিক্ষণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তার উদ্যোগে ‘লামা’ সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লামাবাদ তিব্বতে স্থায়ী আসন লাভ করে। লামা শব্দের অর্থ গুরু বা পথপ্রদর্শক। সর্বোচ্চ পদাধিকারী লামাকে বলা হয় ‘দালাই নামা’ বা প্রধান গুরু। তার নামের শুরুতে সম্মানার্থে ‘হিজ হলিনেস’ ব্যবহার করা হয়। তিব্বতে লামারা সবচেয়ে প্রভাবশালী। সারা পৃথিবীতেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতীক বা আইকনে পরিণত হয়েছেন দালাই লামা। বর্তমানে ১৪তম দালাই লামা হলেন নোবেল বিজয়ী তেনজিন গাইয়াৎসো। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সভায় এখনো গভীর কৃতজ্ঞতায় আচার্য শান্তরক্ষিত ও শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করসহ তিব্বতের বৌদ্ধ আদিগুরুদের স্মরণ করেন।
আচার্য শান্তরক্ষিতের কাজে সবচেয়ে সহযোগিতা করেন বাংলায় প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মের যোগাচার-মাধ্যমিক ধারায় দীক্ষিত তান্ত্রিক সাধক পদ্মসম্ভার। তিব্বতের মানুষ তান্ত্রিক সাধনাকে পছন্দ করতেন বলে ব্যবহারিক কাজে পদ্মসম্ভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একবার কয়েকজন চায়নিজ মহাযানী মতের বৌদ্ধ পণ্ডিত তিব্বতে তাদের মতাদর্শ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিব্বতের রাজা এ সময় একটি ধর্মীয় বিতর্কের আয়োজন করেন। মতবাদের প্রকাশ্য জ্ঞানভিত্তিক বিতর্ক তখনকার সমাজে প্রচলিত ছিল। আচার্য শান্তরক্ষিত এই বিষয়ে সহযোগিতার জন্য মগধ থেকে নালন্দা মহাবিহারের সে সময়ের যোগাচার-মাধ্যমিক ধারার প্রভাবশালী আচার্য কমলশীলকে তিব্বতে নিয়ে আসার জন্য রাজাকে অনুরোধ করেন। কমলশীল বাংলার সন্তান ছিলেন। যুক্তি উপস্থাপনার মাধ্যমে কমলশীল বিতর্কে হারিয়ে দেন চায়নিজ পণ্ডিতদের। তিব্বতের রাজা খুশি হয়ে কমলশীলকে বিজয়ী হিসেবে সম্মানজনক লরেল পাতার মুকুট পরিয়ে দেন। এরপর কমলশীল তিব্বতে থেকে যান এবং শান্তরক্ষিত প্রতিষ্ঠিত সাম-ইয়ে বিহারের আধিবিদ্যা শাখার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়