গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

অপমৃত্যু ও অপবাদ : স্বপ্না রেজা > গল্প

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শতাব্দীর ঘুম ভেঙে যায় গলির কোলাহলে। কী নিয়ে যেন হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। প্রায়ই সকালে তার এভাবেই ঘুম ভাঙে। একদম পছন্দ নয়। খারাপ লাগায় তিক্ত হয় দেহমন। বাবা চঞ্চল চৌধুরীকে তার এই ঘুম ভাঙার বিরক্তকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে বলেছে, বাবা এই বাসায় আর না। চলো অন্য কোথাও যাই। অনেকদিন তো হলো, আর কত?
চঞ্চল চৌধুরী শতাব্দীর কথা শোনে কিন্তু তার প্রতি উত্তরে কিছু বলে না। অন্যদিকে, অন্য প্রসঙ্গে নীরবে পাড়ি জমায়। তার কারণ থাকলেও সেই কারণ সে বলেনা। শতাব্দীর জন্মের আগের থেকেই চঞ্চল চৌধুরী প্রীতিকে নিয়ে এই বাসায় তার সংসার জীবন শুরু করে। পুরান ঢাকার এই বাসায় প্রীতিকে নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে। প্রীতির চলে যাওয়ার পর এই স্মৃতিই চঞ্চল চৌধুরী রয়ে গেছে। শতাব্দীকে এতকিছু বুঝতে দেয়নি কখনো সে। মায়ের স্মৃতি শতাব্দীর কাছে ততটা পরিষ্কার নয়। কারণ, বুদ্ধি হওয়ার আগেই মা তার চলে যায়। মায়ের সাথে সন্তানদের সম্পর্ক দেখলে অবাক হয়ে শতাব্দী তা দেখে, অনুভবের চেষ্টা করে। অনুভূত হয় না তেমন কিছুই।
বিছানা ছেড়ে বাবার ঘরে উঁকি দেয় শতাব্দী। ঘরে নেই চঞ্চল চৌধুরী। এত সকালে কোথায় গেল বাবা তার, কিছুটা চিন্তাচ্ছ¡ন্ন হয়ে খোঁজ করে তিন রুমের বাসার এদিকওদিক। কোথাও বাবা নেই। বাসার মেইন দরজা হালকা করে আফসানো। নিশ্চয়ই বাবা বাইরে বের হয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ মেলে। ১০-১২ জন লোক জড়ো হয়ে আছে। উপুড় হয়ে কী যেন দেখছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘিরে আছে। বাবাকে চোখে পড়ে না।
এই বাসায় বাবা ও মেয়ে থাকে। সকালের সূর্য আকাশে পুরোপুরি জেগে উঠতে আসে গৃহকর্মী মরিয়ম। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার রান্না করা, ঘরেদোড় পরিষ্কার করে মরিয়ম চলে যায়। সে এই বাসার কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে প্রীতি থাকা অবস্থায়। মূলত, প্রীতিই তাকে এই বাসার কাজে পছন্দ করেছে। নিয়োগ দিয়েছে। বিশ বছর ধরে সে কাজ করছে। প্রীতি নেই, কিন্তু মরিয়ম আছে, রয়ে গেছে।
শতাব্দীর ইচ্ছে হলো নিচে গিয়ে বাবাকে খুঁজে বের করতে। পরনের কাপড় কোনোরকম ঠিকঠাক করে নিচে নেমে আসে। জটলা পাকানো লোকগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা চেষ্টা করে, বাবা আছে কিনা। কিন্তু চঞ্চল চৌধুরীকে পাওয়া গেল না। গলির এ মাথা, ও মাথা করেও শতাব্দী বাবাকে পেল না। অজানা এক আশঙ্কা, ভয় বুকের ভেতর জমাট বাঁধতে শুরু করে। এতো সকালে না বলে বাবা তার কোথায় গেল। বেশ কিছুক্ষণ গলিতে পায়চারী করে বাসায় ফেরে শতাব্দী। ততক্ষণে মরিয়ম চলে এসেছে।
দরজাডা খুইল্যা কই গেছিলা! এমন কইরা কেউ দরজা খুলা রাখে নাকি?
মরিয়ম খালা! বাবাকে পাচ্ছি না!
কী! কী কইলা? খুঁইজা পাওনা মানে কী!
হ্যাঁ খুঁজে পাচ্ছি না। ঘুম থেকে জেগে দেখি বাবা নেই। কোথায় গেল বাবা?
হাঁটবার গেছে বোধহয়। আজকাল তো অনেক মানুষই সকালবেলায় হাঁটতে যায়। চিন্তা কইরো না। আয়া পড়বো।

মরিয়মের কথা সত্য হবার মতো কোনো সম্ভাবনা দেখে না শতাব্দী। কতক্ষণ আর হাঁটবে সে। আর তাছাড়া কখনোই সে এমন করেনি। এই শহরে তার তেমন কোনো বন্ধুবান্ধব নেই যে, তাদের সাক্ষাৎ পেয়ে সে বেমালুম শতাব্দীর কথা ভুলে যাবে, বাসার কথা ভুলে যাবে। হঠাৎ বাবার মোবাইল ফোনের কথা মনে পড়ে, কোথায় সেটা। বাবার রুমে হন্ন হন্ন হয়ে খোঁজে মোবাইল ফোন। চোখে পড়ে না। বাবার ফোনে কল দেয় শতাব্দী। রিং হয়, রিসিভ হয় না। দুশ্চিন্তা সীমা ছাড়িয়ে যায়। কী করবে বুঝে পায় না।
মরিয়ম টেবিলে নাস্তা গুছিয়ে খেতে ডাকে।
আমি কী করে খাবো বলো তো? বাবার খোঁজ না পেলে কি আর খাবার গলা দিয়ে নামবে?
দুশ্চিন্তা কইরো না। দেখবা চইলা আসবো। নাস্তা খাইয়া নাও।
বাবা তো কখনো এমন করে না।
পুরুষ মানুষ। বয়স হইছে। তার ওপর একা। হয়তো একটু বেড়াইতে বের হইছে।
মরিয়মের কথা ভালো লাগে না শতাব্দীর। মরিয়ম বলেই চলে, আমি এক বাসায় কাজ করতাম। দেখসি বাসার পুরুষ মানুষটা হুটহাট কইরা কই যেন চইল্যা যাইত। বইল্যা যাইত না। একদিন আবার ফিরা আইত। বিবিসাহেব জানতে চাইলে কইত, যেখানে ইচ্ছা গেছি। আবার যামু। তোর কী? আমার ময়নার বাপও তো মাঝেসাঝে উধাও হইয়া যায়। পুরুষ মাইনষের ইচ্ছা বুঝা কঠিন।
শতাব্দী মরিয়মকে থামাতে তার চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়।

কিশোরের কথা মনে হয়। কিশোর তার এই মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করতে পারে কিনা।
হ্যালো কিশোর।
বল।
আমি একটা ঝামেলায় পড়েছি। তুই কী আমাকে হেল্প করতে পারবি? আসবি একটু?
কী হয়েছে বলতো।
মানে বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
মানে? কখন থেকে?
ভোরে ঘুম থেকে জেগে দেখি বাবা বাসায় নেই। দরজা আফসানো। জানিস, কখনো এমন হয় না। এখন বাজে বারেটা।
ফোন আছে সাথে?
হ্যাঁ। কিন্তু কল রিসিভ করছে না। কী করি বলতো?
একটা কাজ কর, তোদের সব আত্মীয়স্বজনের বাসায় আগে খোঁজ কর। মানে ফোন দিয়ে জান।
বাবা সেসব জায়গা যাবে বলে মনে হয় না।
আহ্ করতো আগে ফোন।
তুই আসবি একটু? আমার যেন কেমন লাগছে।
আমি আসছি। এর মধ্যে তুই ফোন কর।

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর রাত। কিন্তু চঞ্চল চৌধুরীর কোনো খোঁজ শতাব্দী পায় না। একবার মনে হলো, কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি তো?
আমাদের কী একবার হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নেয়ার দরকার? শতাব্দীর আশঙ্কার জবাবে কিশোর বলে, যদি তিনি অ্যাকসিডেন্ট করেন তাহলে তো তোকে জানাবে, তাই না?
হয়তো বাবার সেইটুকু জানাবার ক্ষমতা আর নেই।
মানে, বলতে চাইছিস যে, তিনি আর নেই?
প্লিজ কিশোর! এ কথা শুনতে ভালো লাগার কথা নয়!
ফোন দে আবার আংকেলের ফোনে।

এবার ফোন দিতেই ফোন রিসিভ হয়। চঞ্চল চৌধুরীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
বাবা! বাবা!
শতাব্দী!
বাবা কোথায় তুমি?
আমি বলতে পারবো না কোথায় আমি।
কী বলছো তুমি? তুমি আমাকে ফোন করোনি কেন এতটা সময়ে? ফোন ধরোনি।
আমি কিছুই জানি না মা। যখন মনে হলো তোমাকে কল করি, তখন দেখি ফোনের ব্যালেন্স নেই।
বাবা! কোথায় গিয়েছো তুমি? কেন গেছো?
বললাম তো আমার কিছুই মনে নেই।

শতাব্দীর কাছ থেকে ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে নেয় কিশোর।
আংকেল, আমি কিশোর। একটু কাউকে জিজ্ঞেস করুন, জায়গাটির নাম। কিংবা কাউকে ফোনটা দিন।
এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
মানে?
আর কেউ নেই। আমি তো একটা ঘরের মধ্যে আছি। অন্ধকার ঘর। বাহির থেকে বন্ধ।
আপনাকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে তাহলে?
জানি না।
কেউ আপনার সামনে এসেছিল?
না। জানি না। আমি মনে করতে পারছি না। কিশোর, আমার ফোনের চার্জ কমে যাচ্ছে। শতাব্দীকে দাও ফোনটা।

মোবাইল ফোন চলে যায় শতাব্দীর হাতে।
বাবা!
মা!
কোথায় আছো না জানলে তোমায় আনব কী করে?
আমি একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে আছি, মা! বলেই চঞ্চল চৌধুরী কেঁদে ফেলে। বাবার কান্না শুনে শতাব্দীও কাঁদে।

বাবা শতাব্দীর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মায়ের শূন্যতায় বাবাই পূরণ করে গেছে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি প্রয়োজনে। নানা ভাবনার মাঝে বাবার অবাধ অনুপ্রবেশ। আজ তার বাবা অজানা এক রহস্যের ভেতর আটকে পড়েছে, অনুভব করতেই শরীর শিরশির করে ওঠে।

শতাব্দী! ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাবে! ফোন বন্ধ হয়ে যাবে!
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে, বাবা কোথায় আছে জানতে পারবে না, বাবাকে উদ্ধার করতে পারবে না, এমন সব মাথায় ঘুরপাক খেতেই অধীর হয়ে ওঠে শতাব্দী। কিশোর শতাব্দীর অবস্থা বুঝতে পারছে। সেও আতংকিত হয়ে পড়ছে।

শতাব্দী, আর কথা বলিস না। ওনার চার্জ থাকতে থাকতে থানায় চল। ট্র্যাকিং করে পুলিশ বুঝতে পারবে কোথায় তিনি। চল।

কিশোরের কথামতো থানায় আসে শতাব্দী। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেই। সাব-ইন্সপেক্টর আছেন। তিনি ব্যস্ত আরেকটি মামলায়। শতাব্দী ও কিশোররকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পর ফিরে তাকায় সাব-ইন্সপেক্টর।
বলুন কী সমস্যা?
শতাব্দী পুরো ঘটনা বলে। তীক্ষè চোখে শতাব্দীর কথাগুলো শোনে সাব-ইন্সপেক্টর। চাহনির ভেতর অন্যকিছুর অনুসন্ধানের আভাস তার। জানতে চায় কিশোরের পরিচয় ও তার সাথে শতাব্দীর সম্পর্ক। এই বিষয়টিই যেন সাব-ইন্সপেক্টরের ভেতর কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছে।

আপনার বাবা চঞ্চল চৌধুরী অপহরণ হয়েছে তাহলে? সরাসরি প্রশ্ন। প্রশ্নের কোনো বাঁক নেই।
সেটা তো বলতে পারব কিনা। আসলে কী হয়েছে, জানা নেই। আমরা বাবাকে উদ্ধার করার জন্য আপনাদের সহায়তা পেতে এসেছি।
একটা অপহরণ মামলা করতে হবে। তাহলেই আমরা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারি।
কিন্তু কার বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করবো? আমরা তো কিছুই জানি না।
না জানলেও করতে হবে। গল্প যা শোনালেন, তাতে পরিষ্কার যে, তাকে কেউ অপহরণ করে নিয়ে গেছে। কথাটা শেষ করে একটা সাদা কাগজ ও কলম শতাব্দীর দিকে বাড়িয়ে দেয়।
এখনও পর্যন্ত কোনো কিছু আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। শতাব্দী জোর দিয়ে কথাটা বলে।
প্লিজ দেরি করবেন না। লিখুন।
কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে মামলায়? প্রশ্ন করে কিশোর।
আপনার কী মনে হয়, কার বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করা যায়?
সরি! আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। কথাটা শেষ করে শতাব্দীর দিকে তাকায় কিশোর। শতাব্দী বিব্রত। কী করবে, করা উচিত বুঝতে পারে না।
আপনি চিনেন না, ধারণা করছেন এমন কিছু অদৃশ্য মানুষের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করুন।

শতাব্দী লিখতে শুরু করে। হাত কাঁপে, মন দোলে। লেখা শেষ হয়। কাগজ বাড়িয়ে দেয় সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে।
সাব-ইন্সপেক্টর জানতে চায় মিসেস চঞ্চল চৌধুরীর কথা। মাথা নেড়ে শতাব্দী বলে, উনি নেই।
নেই মানে? মারা গেছেন?
শতাব্দীকে বাবা বলত, মা চলে গেছে। এই চলে যাওয়া মৃত্যু, নাকি অন্য কিছু তা কোনোদিনই চঞ্চল চৌধুরী শতাব্দীকে পরিষ্কার করে বলেনি। প্রীতি চৌধুরী একটা সাজানো ছবির মতো শতাব্দীর কাছে। কী করত, ভালোবাসত সেসব গল্পই যেখানে আছে। চলে যাওয়ার মানে জানা নেই শতাব্দীর। বানিয়ে কিছু বলার অভ্যাস নেই তার। সত্যটাই বলে, জানা নেই।

শতাব্দীর জবাব শুনে চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে সাব-ইন্সপেক্টর।
বলেন কী!
অনেক কথার শেষ টানা যায় না। অনেক প্রশ্নের জবাবও হয় না। আবার কোনো কোনো জবাব হাজারটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এমন পরিস্থিতি শতাব্দীর জীবনে এই প্রথম।
নিজের কৌতূহলে বেশ মত্ত সাব-ইন্সপেক্টর। অনুসন্ধান আর তদন্ত করা মানুষগুলো সম্ভবত সবকিছুতেই কারণ খোঁজে। খুঁজুক, কিন্তু এত বিব্রতভাব কেন খুঁজবে।
শতাব্দী খেয়াল করল কিশোরও বিস্মিত তার কথায়। সে শারীরিকভাবে লাফিয়ে না উঠলেও মানসিকভাবে লাফিয়ে উঠেছে, যেটা তার চোখের চাহনিতে স্পষ্ট হয়েছে।

আপনি জানেন না আপনার মায়ের খবর! আই মিন তার চলে যাবার খবর! সাব-ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করতে উৎসাহিত বোধ করছে।
না। বলেছি তো না।
কী জানেন? কতটুকু জানেন?
ঐ যে বললাম, চলে গেছে।
চঞ্চল চৌধুরীর কাছে জানতে চাননি, কোথায় গেছে, কীভাবে গেছে, কেনইবা গেছে?
শতাব্দী মাথা নেড়ে না জবাব দেয়। গম্ভীর হয়ে পড়ে সাব-ইন্সপেক্টর। তার চোখ দুটো একবার শতাব্দী, আরেকবার নীরবের দিকে ছোটাছুটি করে। গম্ভীর ভাব থেকে বেরিয়ে বলে, বিষয়টি খুব জটিল। কাজ আছে অনেক। আচ্ছা আর কে কে থাকেন আপনাদের বাসায়?
আমি আর বাবা। আর আমাদের এক গৃহকর্মী মরিয়ম খালা আসেন কিছু সময়ের জন্য। কাজ করে চলে যান।
কী নাম বললেন?
মরিয়ম খালা।
মরিয়ম কতদিন ধরে আছেন?
অনেক দিন। শুনেছি আমার জন্মের আগ থেকে।
গুড! পেয়ে গেছি!
সাব-ইন্সপেক্টর এমন ভাব করল যেন সে একটা বিশাল কিছু হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে। চোখজোড়া জ¦লজ¦ল করে উঠল। ইন্টারেস্টিং গল্পের প্লট তার সামনে।
মরিয়মকে ডাকুন। আসতে বলুন থানায়। কুইক!
একটু ট্র্যাকিং করে জানুন বাবা কোথায়? বাবার তো মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
না, যাচ্ছে না। কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলল সাব-ইন্সপেক্টর। যেন সে সব জানে।
কিন্তু মরিয়মকে কী করে বলব আসতে?
নিশ্চয়ই মোবাইল ফোন আছে তার। আজকাল মানুষের খাবারের কোনো কিছু না থাকলেও একটা মোবাইল এবং তার একাধিক সিম থাকে। এটা তো জানেন যে, এ দেশের মানুষ অভাবী হলেও তার সৌখিনতার কিন্তু অভাব পড়ে না। না খেতে পেলেও হাতে তার অত্যাধুনিক কিছু একটা থাকবেই। তাই না?
সরি! আমি এতো বিশ্লেষণে যেতে চাইছি না। বাবার খোঁজটা দিন!
মিস্টার চঞ্চল চৌধুরীর জন্যই তো এতো কথার সুয়োগ তৈরি হওয়া। একটু দম নিয়ে জানতে চায় সাব-ইন্সপেক্টর,
সনি টিভির ক্রাইম পেট্রোল দেখেন?
না।
অনেকেই দেখে।
আমি দেখি না। শতাব্দী একটু জোর গলায় কথাটা বলে।
দেখলে, অনেক আইডিয়া হতো অপরাধ সম্পর্কে।

শতাব্দী বেশ বিব্রতবোধ করে।
মরিয়মকে খবর দিন।
আমার কাছে তার ফোন নম্বর নেই।
আশ্চর্য! একটা পরিবারে আপনি একজন মাত্র নারী সদস্য, অথচ আপনি আপনাদের মেইড সারভেন্টের ফোন নম্বর জানেন না!

শতাব্দী নয়, বাবাই সব সময় এসব যোগাযোগ রক্ষা করে। পরিবারের খুঁটিনাটি বাবাই দেখভাল করে। শতাব্দীকে এসবে জড়ায়নি। শতাব্দী পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে আর বন্ধুবান্ধবের সাথে গল্পগুজব করে বেড়িয়েছে। বাবার অতি আদরে বড় হওয়া একজন তরুণী। বাবাকে ফোন দিয়ে মরিয়মের নম্বর নেবার চেষ্টা করে শতাব্দী। রিং হয়, রিসিভ হয় না। বেশ ক’বার করার পর বিরতি নেয়।
কোথায় ফোন করলেন?
বাবাকে।
ফোন ধরছে না?
উঁহু।
নম্বর বলুন। সাব-ইন্সপেক্টর নিজের মোবাইল থেকে ফোন করে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ হয়।
হ্যালো, চঞ্চল চৌধুরী।
কে বলছেন?
আমি কী চঞ্চল চৌধুরীর সাথে কথা বলছি?
জ¦ী। বলুন।
আমি সাব-ইন্সপেক্টর রহমত আলী বলছি। আপনি কোথায় আছেন?
কেন বলুন তো, আমার কথা জানতে চাইছেন। আমার তো কোনো অপরাধ নেই।
এখনই কেরানীগঞ্জ থানায় আসুন।
কিন্তু কেন?
এলেই বলব। প্লিজ দেরি করবেন না। দেরি করলে কিংবা কথা না শুনলে ফোর্স পাঠানো হবে। তখন বিষয়টি অন্যদিকে মোড় নেবে। কথাটা শেষ করে ফোন কেটে দেয় সাব-ইন্সপেক্টর। বাবা ফোন ধরেছে, জানতে পেরে শতাব্দী ও কিশোর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না শতাব্দী। প্রথমটায় শতাব্দীর বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল সামনে বসা লোকটা তার সাথে ইয়ার্কি মারছে। কিংবা বাবাকে নিয়ে ফাজলামো করছে। আজকাল পুলিশ কতই না ঘটনা ঘটায়, কত রকম কথা শোনা যায় তাদের কোনো কোনো সদস্য নিয়ে। কিন্তু কথার পরের অংশে সত্য খুঁজে পায়। এদিকে সাব-ইন্সপেক্টর রহমত আলী কথা শেষ করে শতাব্দীর দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে। যেন তার একটা সুপ্ত ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে শতাব্দীর প্রতি।

বুঝতে পারলেন কিছু? ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে সাব-ইন্সপেক্টর জানতে চায়।
সব বিষয় বোঝা যেমন যায় না, বুঝতে চাওয়াও বোকামি হয়। পুলিশের অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে আর যাই-ই হোক নিজের বাবাকে বুঝতে চায় না শতাব্দী। কিশোর হতভম্ব। কী বলে শতাব্দীর সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া যায়, তা তার নাগালে নেই। শতাব্দীর সাথে তার পরিচয় প্রায় সাত বছর। কোনোদিন শতাব্দীর মায়ের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি। অজ¯্র গল্পের মাঝে শতাব্দী কোনো একটা গল্প তার মাকে নিয়ে করেনি। সত্যি তো কেনইবা শতাব্দী করেনি, এতোদিন পর প্রশ্নটা মনে উঁকি দেয় কিশোরের।
অনেক ক্ষিদে পেয়েছে আমার। আপনারা চট করে খেয়ে আসুন। চঞ্চল চৌধুরী আসতে কিছুটা সময় নেবে।
একরকম গলা ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দেয়ার মতো। খেতে মন না চাইলেও এই পুলিশটাকে খাবারের সুযোগ দিতে হবে। সৌজন্যবোধ দেখানো দরকার। কিশোর শতাব্দীকে নিয়ে রুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়।

চল কিছু একটা খেয়ে আসি।
ইচ্ছে করছে না।
সব ঠিক হয়ে যাবে। চল খেয়ে আসি।
না। ঠিক হবে না।
কী বলছিস?
কিশোর, বলতো কেন আমি কোনোদিন বাবার কাছে মায়ের খবর নিইনি? বাবা বলেছে চলে গেছে, কেন আমি সেই চলে যাবার গল্পটা শুনিনি।
দ্যাখ, এটা তোর সমস্যা না। আংকেল হয়তো চায়নি তোকে সেটা জানাতে।
কিন্তু তাই বলে আমি আমার মাকে জানতে চাইবো না! জানবো না! এ কেমন কথা কিশোর? আর তাছাড়া বাবা এখন কোথায়? কেনইবা সে আমাকে সেই কথা বলতে পারল না? রহমত আলী তো তাকে থানায় আসতে বললো।
আমরা অপেক্ষা করতে পারি সেই পর্যন্ত। তিনি আসুক। আগের থেকে সাতপাঁচ নাই-ই ভাবি।
থানার সামনে একটা টি-স্টলে বসে এক কাপ চা ও একটা বিস্কুট মুখে দেয় শতাব্দী। কিশোর অনেক জোর করে খাওয়ার জন্য। কিশোরের কাছে নিজেকে অনেক ছোট লাগে শতাব্দীর। অসম্পূর্ণ লাগে। কিশোর একটু দূরে গিয়ে সিগারেট ধরায়।
চঞ্চল চৌধুরী প্রীতি চৌধুরীর কোনো ছবি বাসায় টাঙায়নি। মায়ের ছবি কেন বাসায় টাঙায়নি, এতোদিন মনে প্রশ্নটা উঁকি না দিলেও আজ দিচ্ছে এবং সেটা নানান জটিলতায় প্রবলভাবে, অনেক সন্দেহ নিয়ে। একবার মরিয়ম খালা মায়ের গল্প বলা শুরু করলে বাবা তাকে থামিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। আর শোনা হয়নি। এখন মনে হচ্ছে মাকে নিয়ে এক মস্ত রহস্য রয়েছে। কিশোরের কাছে সিগারেট চায় শতাব্দী।
একটা দে। টানি।
মানে!
টানবো।
পাগল হলি?
হয়নি। হবো।
অন্য কিছু দেই?
না। সিগারেট দে।
তোর অভ্যাস নেই।
তুই না দিলে আমি তো দোকান থেকে নিতে পারি।

কথা না বাড়িয়ে কিশোর সিগারেট বাড়িয়ে দেয়। সিগারেট টানে যেন শতাব্দী অভ্যস্ত, কিশোরের কাছে তেমনই লাগে। মুহূর্তের মধ্যে বদলে যাচ্ছে তার চিরচেনা শতাব্দী। বদলে যাবার প্রেক্ষাপট লাগে। শতাব্দীর জীবনে তেমন একটা প্রেক্ষাপট দৃশ্যমান হয়েছে। অন্ধকারের ভেতর শতাব্দীর ঠোঁটে ধরা সিগারেটের আগুনই যেন আলোর অস্তিত্ব দিচ্ছে। একটা প্রাইভেট কার থানার ভেতর প্রবেশ করল। চোখে দেখতে না পেলেও মন বলল, গাড়িতে বসে চঞ্চল চৌধুরী থানায় ঢুকলো। টেলিপ্যাথি যাকে বলে। সিগারেটে লম্বা শেষ টান দিয়ে কিশোরকে নিয়ে শতাব্দী থানায় প্রবেশ করে।

ধারণা ঠিক। সাব-ইন্সপেক্টরের সামনে বাবা বসে। পাশে একজন নারী। বাবা কথা বলছে সাব-ইন্সপেক্টরের সাথে। হয়তো ইতিমধ্যে যা বলার তা বলা হয়ে গেছে। শতাব্দীকে দেখে পুলিশ ব্যক্তিটি বসতে আহ্বান করে। জীবনে কতকিছুই না দেখেছে শতাব্দী, কতকিছুই না তার বাবা তাকে দেখিয়েছে, কিন্তু আজ যা দেখছে তা কখনোই দেখেনি, বাবা দেখায়নি, যেমন দেখায়নি বাবা তার মাকে ভুলেও।
প্রতিটি মানুষের নিজের ভেতর সম্ভবত এক ধরনের আড়ষ্টতা, যা জীবনের চূড়ান্ত ক্ষণে অনুভব করা যায়। কোন শর্ত, যুক্তি, আবেগ কিংবা আকর্ষণে সেই আড়ষ্টতা দূর হয় না, দূর করা যায় না। শতাব্দীর ভেতর সেই আড়ষ্টতা আজ বাবার দিকে তাকাতে দেয় না। যে বাবার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল, সেই বাবাকে তার অচেনা লাগে, বড্ড অচেনা।

চঞ্চল চৌধুরী অপহৃত নয়। স্বেচ্ছায় চলে গেছে প্রেমিকার কাছে। প্রীতি চৌধুরীকে এই জগৎ থেকে চিরতরে সরিয়ে একটা মস্ত অপবাদ লেপ্টে দেয়া হয়েছে যে, প্রীতি সংসার ছেড়ে চলে গেছে। এই চলে যাওয়া অনেক গল্পের জন্ম দেয়া হয়েছে, যা অশ্রদ্ধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবকিছুর নেপথ্যে স্বয়ং চঞ্চল চৌধুরী। মরিয়ম খালা সব কিছুর নীরব সাক্ষী। বাড়তি অর্থ দিয়ে তাকে পোষে চঞ্চল চৌধুরী।
শতাব্দী নিজেকে বদলে দেয় সময়ের পাখায় চড়ে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়