গজারিয়ায় পুকুর থেকে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

আগের সংবাদ

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অস্বস্তি

পরের সংবাদ

অদেখা সেই দীর্ঘশ্বাস : রেজাউল করিম খোকন > উপন্যাস

প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রূপার মনটা আজ ভালো নেই। কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। এফডিসির চার নম্বর ফ্লোরে একটা ছবির শুটিং চলছে। সে একজন জুনিয়র আর্টিস্ট, এক্সট্রা শিল্পী। ছোটখাটো রোলে কাজ করে। নায়িকার বান্ধবীর রোল।
মস্তবড় জমকালো সেট পড়েছে। নাচগানের সিকোয়েন্সের শুটিং। নায়িকা তার বন্ধবীদের নিয়ে নাচছে গাইছে। এমন একটি দৃশ্য। রূপা এ পর্যন্ত বিশ বাইশটি ছবিতে এ ধরনের রোলে কাজ করেছে। ইতোমধ্যে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে এ লাইনে। অভিনয়ে ও নাচে ভালো যোগ্যতা অর্জন করেছে অনেক চেষ্টা করে।
ছবির নায়িকা রেশমী অদূরে একটা ইজিচেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। একটু পরেই শট নেয়া শুরু হবে। রেশমীর দিকে তাকিয়ে আছে রূপা। জনপ্রিয়তার শীর্ষে আজ তার অবস্থান। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছেছে নায়িকা রেশমী। তার সব অতীত ইতিহাস জানে রূপা। নিজের কথা ভেবে তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চেষ্টা করলে আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সে ও রেশমীর পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। আজকাল রূপাও নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কীভাবে সফল হবে? কোন পথে এগোলে নায়িকা হবার স্বপ্ন সফল হবে ভাবতে গিয়ে সে আনমনা হয়ে পড়ে।
হঠাৎ পাশেই নিয়াজ খানকে দেখে তার স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে যায়।
নিয়াজ খান ইতোমধ্যে কয়েকটি ছবি প্রযোজনা করেছেন। তার একটি ছবিতে কাজ করেছে রূপা। সে নিজেই এগিয়ে গিয়ে সালাম দেয়।
‘কেমন আছেন, নিয়াজ ভাই?’
‘ভালো। রূপা না তুমি? তোমার ড্যান্স পারফরমেন্স কিন্তু চমৎকার। ফিগারটাও তোমার বেশ শার্প। ইয়্যু ক্যান গেট বেটার চান্স।’
মৃদু হেসে কথাগুলো বলেন নিয়াজ সাহেব।
রূপার খুব ভালোলাগে। এমন একজন বিখ্যাত চিত্র প্রযোজক তার কাজের প্রশংসা করছেন এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কী হতে পারে!
সিনেমা লাইনে জুনিয়র আর্টিস্ট থেকে নায়িকা হয়ে নামধাম করেছে, বিখ্যাত তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকেই। রূপা তেমন কিছু নায়িকার ইতিহাস জানে। সাধারণ ছোটখাটো রোলে অভিনয় আর নাচগানের দৃশ্যে সখীর রোল করতে গিয়েই অন্য নির্মাতার চোখে পড়ে গিয়েছিল তারা। তেমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে আজ তারা প্রতিষ্ঠিত নায়িকা, কত প্রভাব প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভব। নিয়াজ সাহেব যদি তাকে তেমন একটা সুযোগ দিতেন… ভাবতে গিয়ে রূপার দেহমনে এক ধরনের শিহরন ছড়িয়ে পড়ে।
তাকে সত্যি সত্যি চমকে দেন নিয়াজ সাহেব।
‘শোনো রূপা, কাল সময় করে একবার আমার বাসায় এসে দেখা করো, হয়তো তোমার কপাল খুলে যাবে। আমি তোমাকে নিয়ে একটা নতুন প্ল্যান করেছি।’
খোশ মেজাজে কথাগুলো বলেন তিনি।

দুই.
‘আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন চিত্রনায়িকা নায়লা শারমিন। নিজের জন্য পাত্র খোঁজ শুরু করেছেন।’
কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে খবরটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বড় বড় জাতীয় দৈনিকগুলোর বিনোদন পাতায়ও নায়লার গø্যামারাস ছবিসহ খবরটি ছাপা হয়েছে। এই সময়ের শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যস্ত নায়িকাদের অন্যতম একজন নায়লা শারমিনকে নিয়ে ভক্ত অনুরাগীদের মধ্যে বিশেষ উন্মাদনা রয়েছে। সবাই তার ব্যাপারে দারুণ কৌতূহলী। অভিনয়ের বাইরে নায়িকার ব্যক্তিজীবনের নানা বিষয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে ভীষণভাবে উৎসাহী। এটা শুধু তার ক্ষেত্রে নতুন নয়।
রুপালি পর্দার মানুষ যখন খ্যাতি, জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায়, তখন তাদের নিজস্ব একান্ত জীবন বলে নাকি আর কিছুই থাকে না। রুপালি পর্দার তারকারা সব সময় পাবলিক প্রপার্টির মতো হয়ে থাকেন। নিজে না চাইলেও ভক্ত অনুরাগী, সাধারণ সিনেমা দর্শক তার নিজস্ব একান্ত ভুবনে উঁকি মারতে চায় সুযোগ পেলেই। যা তাদের চরমভাবে বিরক্ত এবং বিব্রত করলেও তখন কিছুই করারও থাকে না। এটা আগেও ছিল। এখনো রয়েছে। বরং আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শুধু এ দেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই রুপালি পর্দার বিখ্যাত, জনপ্রিয় মানুষকে নিয়ে তেমন উন্মাদনা রয়েছে।
ইতোমধ্যে কয়েকটি বিয়ের কারণে নায়লাকে নিয়ে নানা রটনা চালু আছে বাজারে।
নিজের অফিস ডেস্কে বসে ল্যাপটপে নায়লার বিয়ের নতুন খবরগুলো পড়তে পড়তে এসব ভাবছিল সৌরভ। সে নিজেও একটা শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে কাজ করে। বিনোদন পাতার দায়িত্বে রয়েছে সে। দেশের একজন প্রতিশ্রæতিশীল গীতিকার, কবি, উপন্যাসিক, টিভি নাট্যকার হিসেবেও তার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। গত বছর সেরা নাট্যকার হিসেবে কয়েকটি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে সৌরভ ওমর।
ইউনিভার্সিটিতে অনেক ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনা করে খুব ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেও কেন যে ছেলেটা পত্রিকায় কাজ করতে এসেছে- অনেকেই ভেবে পায় না। চাইলেই সে বিসিএস কম্পিট করে ক্যাডার সার্ভিসে জয়েন করতে পারতো। কেউ কেউ এ বিষয়ে সৌরভকে প্রশ্ন করে জবাবে তার মুখের হাসিটাই পেয়েছে। কারো প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে কিছু না বলে শুধুই হেসেছে সে। তার মুখের হাসির মানে যে যার মতো বুঝে নিতে চেষ্টা করেছে।
‘আমি এখন যেটা করছি, তাতেই খুশি, আমার এটা করতে ভালো লাগছে। এর চেয়ে ভালো কিছু আমার দরকার নেই’। সৌরভের একগাল হাসিতেই যেন এটাই প্রকাশ পায়।
ল্যাপটপে তার সুন্দর মুখের ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সৌরভ সিদ্ধান্ত নেয়, আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার খবরটি নিয়ে নায়লা শারমিনের একটি এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ করতে হবে। সঙ্গের অন্য কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে সে নিজেই করবে কাজটা। তেমন একটি হট ইস্যুতে অন্য পত্রিকাগুলোও হয়তো নায়লার সঙ্গে কথা বলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সৌরভ চায়, গতানুগতিক ক্যাজুয়াল কিছু কথাবার্তা নয়, সত্যিকারের এক্সক্লুসিভ কিছু একটা করতে। সেখানে এই সময়ের জনপ্রিয় এই চিত্রনায়িকার জীবনের অজানা দিক তুলে ধরা যাবে। বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে আগেও কয়েকবার নায়লার মুখোমুখি হয়েছে সে। কিন্তু তার সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। ইন্ডাস্ট্রির ছোট-বড়, নবীন-প্রবীণ, প্রতিষ্ঠিত-উঠতি সবার সঙ্গেই সৌরভের চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে। চিত্রনায়িকা নায়লার সঙ্গে বিভিন্ন ফিল্মি পার্টি, অনুষ্ঠানে দেখা হলে ‘হাই’, ‘হ্যালো’ বলা হলেও কোনো সময়ে তার সঙ্গে একান্তে বসে আলাপ হয়নি। তার পত্রিকার জুনিয়র রিপোর্টাররাই মাঝে মধ্যে ইন্টারভিউ করেছে। ইন্টারভিউ করার সময় নায়লাই কৌতূহলী হয়ে তাদের বস সৌরভ ওমর সম্পর্ক নানা বিষয় জানতে চেয়েছে। বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বাঘা বাঘা সাংবাদিকরা ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ জনপ্রিয় একজন নায়িকা হিসেবে তার সঙ্গে ভাব জমাতে কত কসরত করে, নিয়মিত মোবাইলে কথা বলে ভালোমন্দ খোঁজ-খবর নেয়। অথচ সেখানে সৌরভের মধ্যে সেই ভাবটা নেই। পেশাগত ক্ষেত্রে একজন বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে ইন্ডাস্ট্রির আরো অনেক নায়িকার সঙ্গে ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠলেও খুব মাখামাখির সম্পর্ক নেই তেমন কারো সঙ্গে তার। এক ধরনের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে সে। যে কারণে তার সম্পর্কে আলাদা ও অন্যরকম ধারণা পোষণ করে অন্য সবাই। সবার সঙ্গে গড়পড়তা এক পাল্লায় মাপা যায় না তাকে। সৌরভ কাজ করে তার নিজের মতো করে। তার স্টাইলের সঙ্গে মেলানো যায় না অন্য কাউকে।

তিন.
মোবাইলে কয়েকবার কল দিয়েও ও প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ইন্ডাস্ট্রির ব্যস্ততম জনপ্রিয় নায়িকা বলে কথা। সপ্তাহের প্রতিটি দিন বিভিন্ন পার্টিকে আগে থেকে বরাদ্দ দেয়া থাকে। এফডিসি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় শুটিং থাকে। আবার কখনো আউটডোর শুটিংয়ের জন্য ঢাকার বাইরে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার যেতে হয়। নায়লা এখন কোথায় আছে, কোন ছবির শুটিং করছে, জানে না সৌরভ। তার মোবাইল নম্বর হয়তো সেভ করা নেই যে কারণে অপরিচিত নম্বর দেখে ধরছে না। মনে মনে রাগ ধরে যায়। তাকে যেখানে টিভি-সিনেমার নায়িকাদের অনেকেই, বিজ্ঞাপন মডেলদের প্রায় সবাই সময়ে-অসময়ে ফোন করে বিরক্ত করে, তাদের নিয়ে পজিটিভ, এক্সক্লুসিভ ফিচার-ইন্টারভিউ করতে নানা ঢঙে, আহ্লাদি ভঙ্গিতে অনুরোধ জানায় সেখানে নায়লার তো ভিন্ন রকম আচরণ করার কথা নয়। তাছাড়া সহকর্মী অন্যদের কাছ থেকে সৌরভ ইতোমধ্যে জেনেছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার নায়লা শারমিন তার ব্যাপারে অনেকটাই অবগত এবং উৎসাহী। বেশ কিছু ফিল্মি পার্টিতে তাকে না দেখে অন্য অনেকের কাছে তার কথা জানতে চেয়েছে।
নায়লার ইন্টারভিউ করার জন্য বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করা যাবে না। আজকের মধ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আজ কিংবা কাল একটা সময় বের করে নিতে হবে। নইলে কাজটা পরে করে কোনো লাভ হবে না। ততদিনে অন্যান্য পত্রিকা তার ইন্টারভিউ করে ফেলবে। তখন সৌরভের ইন্টারভিউ আর এক্সক্লুসিভ মনে হবে না পত্রিকার পাঠকদের কাছে। একঘেয়ে চর্বিত চর্বন, পানসে স্বাদহীন খাবারের মতো মনে হবে।
‘আই অ্যাম সৌরভ ওমর। ওয়ান্ট টু টক ইয়্যুথ ইয়্যু’। মনে তীব্র রাগ বাসা বাঁধলেও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে সৌরভ এসএমএস করে নায়লার নম্বরে।
পরক্ষণেই তার কাছে ফোন আসে। ওটা রিসিভ করতেই ও প্রান্তে নায়লার কণ্ঠ শোনা যায়, ‘হ্যালো, আই অ্যাম সরি, আপনার ফোনটা আমার অনেক আগেই ধরা উচিত ছিল। আপনার নম্বর তো সেভ করা আছে আমার। কয়েকদিন ধরে কাজের প্রচণ্ড চাপে আর পার্সনাল বেশ কিছু ঝামেলায় একদম ঘুমোতে পারিনি। আজ আর পারছিলাম না। মোবাইলটা সাইলেন্ট করে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। এই মাত্র জেগে উঠতেই দেখি, আপনার অনেকগুলো মিসড কল আর এসএমএস। আপনি হয়তো রাগ করেছেন আমার ওপর। রাগ করারই তো কথা। আই এগেইন এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট। প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড, মিস্টার সৌরভ ওমর।
‘নো, দ্যাটস নাথিং, ইটস ওকে। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছিলাম। মানে, একটা ইন্টারভিউ করতে চাই। আজ-কালের মধ্যে সময় দেয়া কি সম্ভব হবে?’
‘এর আগে কোনো সময়ে সেভাবে কথা বলা হয়নি আপনার সঙ্গে। আজ হঠাৎ আপনি নিজেই কথা বলতে চাইছেন। আপনাকে ‘না’ বললে ভীষণ অন্যায় হবে আমার। আজ আমার শুটিং-ডাবিং কিছুই নেই। বলতে পারেন, ফ্রি আছি। আজ কি কথা বলতে চাইছেন? আমার বাসায় তাহলে চলে আসুন। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।’ নায়লার কণ্ঠে আমন্ত্রণের সুর।
‘ওকে, থ্যাংক ইয়ু। আমি আজই আসতে চাই’। সৌরভ বলে।
‘ঠিক আছে। আমি নিচে সিকিউরিটিদের জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি এসে পরিচয় দিলেই চলবে। লিফটে ফোর্থ ফ্লোরে চলে আসবেন। সিঙ্গেল অ্যাপার্টমেন্ট। মানে ফোর্থ ফ্লোরে আমি একাই থাকি।’
এরপর ও প্রান্তে লাইনটা কেটে যায়।
চার.
অফিস থেকে বেরিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দূরত্ব খুব বেশি নয়। বড়জোর পনেরো-বিশ মিনিট সময় লাগে। আজ কপালটাই খারাপ। রাস্তায় নামতেই দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামের মধ্যে পড়ে যায় সৌরভ। ফুরফুরে আরামে ঝটপট দ্রুত বসুন্ধরায় নায়লার বাসায় পৌঁছে যাবে- তেমন চিন্তাভাবনা থেকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাইড শেয়ারের- টয়োটা এলিয়ন গাড়িতে চড়েছিল।
বেশ অনেকবার কল দিয়েও তার কোনো সাড়া না পেয়ে মেজাজটা তখন থেকেই খচে আছে। যদিও পরে নায়লা এ জন্য দুঃখ-প্রকাশ করেছে। বেশ কয়েকবার ‘সরি’ বলেছে। যার জবাবে সৌরভও ‘ইটস ওকে,’ ‘দ্যাটস নাথিং’ বলেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগটা রয়ে গেছে। এখন রাস্তায় দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে নায়লার বাসার দিকে যেতে যেতে সেটা আবার চাড়া দিয়ে উঠছে।
ভোগান্তি যতটা হবে ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় সৌরভের মনটা আবার ভালো হয়ে গেল। হঠাৎ করে ট্রাফিক জ্যামটা খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যে এভাবে কেটে গিয়ে চলাচলে দারুণ সুবিধা সৃষ্টি হবে- কল্পনা করেনি সে এবং তার মতো আশপাশে বিভিন্ন গাড়ির চালক এবং যাত্রীদের কেউই। এই ঢাকা শহরে কোথাও যেতে রাস্তায় নামলে হঠাৎ হঠাৎ তেমন অলৌকিক, বিচিত্র, অকল্পনীয় ব্যাপার ঘটে যায়। সৌরভ আগেও বহুবার এটা খেয়াল করেছে। এজন্য সে মনে মনে নিজের ভাগ্যটাকে ধন্যবাদ দেয়।
নায়লাদের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যায় সৌরভ।
উর্দি পরা গার্ডের কাছে নিজের পরিচয় দিতেই লোকটা একগাল হেসে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে, ‘স্যার, আপনি নায়লা ম্যাডামের কাছে এসেছেন তো? ম্যাডাম আমাকে ফোন করে আগেই বলে রেখেছেন আপনার কথা। লিফটে করে ফোর্থ ফ্লোরে চলে যান আপনি।’
পাশাপাশি হেঁটে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেয় লোকটা তাকে।
লিফট থেকে নামতেই অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা চোখে পড়ে। দরজার সামনে একটা স্টিলের ঝকঝকে প্লেটে ইংরেজিতে ‘নায়লা’ লেখা রয়েছে। কলিং বেল টেপার আগেই দরজাটা খুলে যায়। দরজার বাইরে কারো উপস্থিতি ঘরের ভেতর থেকে টের পেল কীভাবে? হয়তো দরজার সামনে ক্যামেরা ফিট করা আছে, ভেতর থেকে বাইরের সব সবকিছ ুদেখা যায়- চিন্তাভাবনা শুরু করতেই সৌরভের খেয়াল হয়, বাইরের নিচে গেটে থাকা গার্ড ব্যাটা ইন্টারকনে নিশ্চয়ই তার আসার খবরটা জানিয়েছে।
দরজা খুলতেই ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সালোয়ার কামিজ ওড়না পরা অপরিচিত এক যুবতীকে দেখতে পায় সে। অপরিচিত হলেও সে তাকে দেখে হাসছে খুব চেনাজানা মানুষের মতো।
‘ওহ, শেষ পর্যন্ত আপনি এলেন তাহলে। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম- মেয়েটিকে হঠাৎ দেখে অপরিচিত লাগলেও পরক্ষণেই দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা নায়লা শারমিনকে সে চিনতে পারে। আশ্চর্য, এত চেনাজানা একটি মুখকে হঠাৎ দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি সৌরভ। নিজেকে এই মুহূর্তে কেমন বোকা মনে হলেও পরক্ষণে আবার প্রবোধ দেয়- এতদিন বাইরে ফটোগ্রাফারের ফ্লাশ লাইট আর শুটিংয়ের হাজার হাজার ওয়াটের ঝলমলে আলোর ঝলকানির সামনে ভারি মেকআপ নেয়া মোহনীয়া, অপরূপা সাজে যে নায়লাকে দেখে অভ্যস্ত, নিজের ঘরে একান্ত জীবনে তার আসল রূপটি তো দেখার সুযোগ হয়নি তার। বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশে খুবই সাদামাটা অতি সাধারণ সাজ-পোশাকে রুপালি পর্দার একজন মোহনীয়া সুন্দরী চিত্রনায়িকাকে এভাবে দেখার সুযোগ ক’জনেরই বা হয়। এই মুহূর্তে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় সৌরভের।
নিজেকে সামলে নিয়ে নায়লার কথার পিঠে জবাব দিতে দিতে সে বলে, ‘আচ্ছা, আপনি কী ধরে নিয়েছিলেন- আর বললেন না তো। কথাটা তো কমপ্লিট করলেন না?
‘থাক্, সে সব কথা! আপনি আমার বাসায় এসেছেন অনেক কষ্ট করে। আজ আমি কিন্তু অনেক অনেক খুশি। রিয়েলি আই অ্যাম হ্যাপি। অনেক আগে থেকেই আমি আপনাকে এক্সপেক্ট করেছি, কিন্তু; বলতে বলতে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় নায়লা। সৌরভ তাকে অনুসরণ করে ভেতরে এগিয়ে যায়।
অ্যাপার্টমেন্টে বড় একটি ড্রাইংরুম রয়েছে। সেখানে না গিয়ে একটা করিডোর পেরিয়ে আর একটু এগিয়ে বড় একটি স্পেসে বাগানের মতো করে সাজানো গোছানো লনে নিয়ে যায় তাকে। এখানে কয়েকটি চেয়ার পাতা রয়েছে। সামনে ছোট্ট টেবিলও আছে। খুব বেশি আলো জ্বালানো হয়নি। ইচ্ছে করেই যেন মায়াবি একটি পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে এখানটায়।
জায়গাটা দেখে তার মনে হয় এখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরতিহীন কথা বলা যায়, আড্ডা দেয়া যায় সারা রাত।
নায়লা সৌরভকে বসিয়ে ‘এক্সকিউজ মি, আমি এক্ষুনি আসছি। আপনি বসুন’ বলে ভেতরে চলে যায়।
খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়না সৌরভকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে নায়লা। এসেই মুখোমুখি আরেকটি চেয়ারে বসে। প্রথমেই কোনো ভূমিকা না করে সৌরভ সরাসরি প্রশ্ন করে তাকে, ‘আচ্ছা, আপনার বিয়ে নিয়ে যে নিউজগুলো হচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে। ব্যাপারটা কি সত্যি? তার মানে আবার আপনি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছেন?’
সৌরভের প্রশ্ন শুনে কাঁচভাঙা হাসিতে গড়িয়ে পড়ে নায়লা। এরপর হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আমি আবার বিয়ে করছি। আপনার তাতে কী কোনো সমস্যা আছে?’
নায়লার হঠাৎ মুডি জবাব শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তারপর কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায় সৌরভ। কী বলবে তার কথার পিঠে, ভেবে পায় না। তারপর কি মনে করে প্রশ্ন করে, ‘বিয়ের জন্য নাকি পাত্র খুঁজছেন? পেয়েছেন তেমন কাউকে? পছন্দ হয়েছে পাত্র হিসেবে কাউকে?
প্রশ্নগুলো করার পর সে নিজেই বোকা বনে যায়। এখন এখানে এই প্রশ্নগুলো করাটা ঠিক হয়নি। অন্তত তার মতো একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্ন করাটা নিতান্তই ছেলেমানুষি হয়েছে- উপলদ্ধি হয়। ছেলেমানুষি তো তাকে মানায় না। কারণ সৌরভকে সবাই একজন ইন্টেলেকচুয়্যাল মানুষ হিসেবে চেনে এবং জানে। নায়লাও তার ব্যতিক্রম নয় নিশ্চয়ই।
সৌরভের প্রশ্নগুলো শুনে কেমন যেন কৌতুকবোধ করে নায়লা। ‘আচ্ছা, আপনার কাছে কী তেমন কোনো পাত্র রয়েছে? থাকলে বলুন। পরীক্ষা-টরীক্ষা নিয়ে দেখি, কতটা যোগ্য সে বা তারা।’ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে চায় সে। তার উচ্ছাস ভরা খোলামেলা মুডি কথাবার্তা আর ক্যাজুয়াল রূপ দেখে কেমন যেন অবিষ্ট হয়ে যায় সৌরভ। অল্প সময়ের মধ্যে কাউকে মুগ্ধ, আবিষ্ট এবং দারুণভাবে আকৃষ্ট করার মতো অনেক কিছুই রয়েছে তার মধ্যে, আবিষ্কার করে সে।
পাক্কা দুঘণ্টা ধরে অনেক কথা বলে তারা দু’জন। একজন সাংবাদিকের ফর্মাল ইন্টারভিউর মুডে নয়, আড্ডা দেওয়ার ভঙ্গিতে কত ধরনের কথা হয়। সৌরভের প্রশ্নের পিঠে নায়লাও পাল্টা প্রশ্ন করে তাকে। সাধারণত এরকম ইন্টারভিউ করা হয়না সৌরভের। হঠাৎ কেন জানি জনপ্রিয় এই চিত্রনায়িকাকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করে সে। নায়লাকে খুব চেনাজানা কাছের মানুষ মনে হয়।
নায়লাও সৌরভকে খুব সহজেই আপন ভেবে নিজের জীবনের বেশ কিছু অজানা কথা বলে ফেলে। যা এর আগে কখনো কোনো ইন্টারভিউতে সাংবাদিকদের কারো কাছে বলা হয়ে ওঠেনি। যে কথাগুলো তাকে নতুনভাবে যেন পরিচিতি করে। এসব কথা বলাটা একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকার ইমেজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে- সেটা নায়লা চিন্তাভাবনা না করেই অকপটে বলে ফেলে। সৌরভের ব্যক্তিত্ব, মোহনীয় ভঙ্গিতে কথা বলা, অন্তরঙ্গতা, সারল্য সবকিছুই নায়লাকে আবিষ্ট করে তোলে।
তার সরল অকপট একান্ত কথাবার্তাগুলোকে মিডিয়ায় প্রকাশ করে নানাভাবে ফায়দা লোটার ধান্ধা করতে পারতো সৌরভ। কিন্তু নায়লাকে নিয়ে গত কিছুদিনের ফিসফাঁস গুঞ্জন, গুজবের অবসান ঘটিয়ে তাকে নিয়ে পজিটিভ একটা মনোভাব সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করে ভেতর থেকে। সৌরভের মনে সেই তাগিদ অনুভবের পেছনে কারণ কী সে জানেনা।
ইন্টারভিউ শেষ করে নায়লার ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় গড়িয়ে প্রায় মধ্যভাগে পৌঁছে যায়। এতক্ষণে ঘড়ির দিকে তাকাতে ভুলে গিয়েছিল সে। হঠাৎ কবজি উল্টে ঘড়ি দেখতেই চমকে ওঠে। ১১টা বেজে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। এত রাত পর্যন্ত একজন সাংবাদিক জনপ্রিয় নায়িকার বাসায়- ব্যাপারটা কেমন যেন হয়ে গেল নয় কী। কেউ দেখলে বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখতে চাইবে না নিশ্চয়ই।
সৌরভ ‘গুড নাইট, সি ইয়ু এগেইন’ বলে বেরিয়ে আসে ফ্ল্যাট থেকে। নায়লাও সৌজন্যতার দেয়াল অতিক্রম করে করিডোর পেরিয়ে তাকে লিফটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।
বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেতে আর ইচ্ছে করে না। আড্ডা দিতে দিতে মাঝখানে কথার ফাঁকে নায়লা সৌরভকে এটা ওটা অনেক কিছু খেতে বাধ্য করেছে। তার অনুরোধ রাখতে গিয়ে একটু একটু অল্প অল্প করে খেলেও অনেক কিছু খাওয়া হয়ে গেছে।
কাপড়-চোপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায় সে। নায়লার সঙ্গে দুই ঘণ্টারও বেশি সময়ের আলাপচারিতায় যে নতুন এক নায়লাকে আবিষ্কারের মুগ্ধতা এখনো ছড়িয়ে আছে মনজুড়ে। সেই আবেশে বিশাল এক স্টোরি তৈরি করে ফেলে। খুব বেশি সময় লাগেনা তার। রাত দুটোয়, ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে সে। কাল অফিসে গিয়েই একপাতা জুড়ে এক্সক্লুসিভ স্টোরিটা মেকআপ করতে হবে- তেমন পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করলেও একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সৌরভ।

পাঁচ.
রাতে শুটিং থেকে বাসায় ফিরে রূপা বাথরুমে ঢোকে। সারাটা দিন খুব ধকল গেছে। নাচগানের শুটিংগুলোতে পরিশ্রম বেশি হয়। অনেক সময় লেগে যায় একটা গানের দৃশ্যের শুটিং করতে। সেই অনুযায়ী পেমেন্ট অনেক কম।
আজকের অনেক নামকরা নায়িকার ফিগারের চেয়ে দারুণ আকর্ষণীয় ফিগার তার নিজের। এটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে তর তর করে ওপরে চলে যাওয়া যাবে। তখন অতীত জীবনের সব গøানি, প্রতারণার দুঃখ আর থাকবে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূপা ভাবতে থাকে। শাওয়ার ছাড়ার কথাও খেয়াল থাকে না।
রূপা এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। নিজের প্রাপ্য আদায়ের ব্যাপারে বেশ কৌশলী হয়েছে। গত কয়েক বছর সমাজের বিভিন্ন ধরনের নারীপুরুষের আসল রূপ দেখেছে সে। নিজের রূপ-যৌবনের প্রশংসা শুনেছে নানাজনের কাছে।
গত দুই বছরে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে বেশক’টি সিনেমায় কাজ করেছে রূপা। এ লাইনে ভালো অভিজ্ঞতাও হয়েছে। নিজের চেষ্টায় সিনেমার নাচটা এই সময়ের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে নিয়েছে। এ কারণে অনেকেরই চোখে পড়ে গেছে সে। কয়েকজন নতুন-পুরনো পরিচালক তাকে নায়িকা করার আশ্বাসও দিয়েছেন। রূপার মনে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মেছে, নায়িকা হিসেবে একটা সুযোগ হয়তো সে পেয়ে যাবে।
কত মেয়েই তো নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সিনেমা লাইনে আসে। এখানে কিছু পেতে হলে বিনিময়ে অনেক কিছু দিতে হয়। ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা নিয়ে মেয়েদের এ পথে আসতে হয়। অনেক কিছুর বিনিময়েও শেষ পর্যন্ত নায়িকা সাজার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়, বাস্তবে রূপ লাভ করে না। রূপা জানে।
কিছু মেয়েকে সে দেখেছে, যারা নায়িকা সাজার এবং প্রতিষ্ঠিত চিত্রতারকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সিনেমা জগতে এসে শেষ পর্যন্ত তার কিছুই অর্জন করতে পারেনি। এজন্য স্বামী, সংসার, পরিবারকে ত্যাগ করেছে কেউ কেউ। নায়িকা হতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তারা কিছু ধনাঢ্য পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়েছে।

ছয়.
একটি টিভি চ্যানেল থেকে ঈদের জন্য বিগ বাজেটের টেলিফিল্ম তৈরি হচ্ছে। রোমান্টিক গল্পের স্ক্রিপ্ট লেখার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সৌরভেকে। ওই চ্যানেলের জন্য আগেও কয়েকটি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছে সে। দর্শকদের খুব ভালো রেসপন্স পেয়েছে প্রতিটি নাটক। ইউটিউবে ভিউর সংখ্যা কোটি ছুঁয়েছে। সৌরভ চাইলে দু’হাতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জন্য নাটক লিখতে পারে। কিন্তু সবার প্রস্তাবে সাড়া দিতে গেলে নাটকের মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটিকে গুরুত্ব দিতে চায় সে সব কাজে। ঈদের জন্য বিগ বাজেটের টেলিফিল্মটিতে জনপ্রিয় মডেল সানজানা আফরিনকে নেয়া হবে তেমন ধারণা দেয়া হয়েছে। তার কথা মাথায় রেখে যেন টেলিফিল্মটির স্ক্রিপ্টটি তৈরি করা হয়- বিশেষভাবে বলা হয়েছে সৌরভকে। সানজানার সঙ্গে বেশ ভালো জানাশোনা রয়েছে তার। যে কারণে স্ক্রিপ্টটি লিখতে তেমন কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু অফিসের কাজের ব্যস্ততায় কাজটা এগিয়ে নিতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে।
মাঝখানে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে একটানা লিখে শেষ করবে কাজটা- ভেবেছিল সে। কিন্তু একের পর এক নতুন কাজের ঝামেলায় অফিস থেকে ছুটি নেয়ার সুযোগ হচ্ছে না। ওদিকে টিভি চ্যানেলের লোকজন বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। টেলিফিল্মটির শুটিং শুরুর আগে আলাদাভাবে রিহের্সাল করাতে হবে শিল্পীদের। এ কারণে যত দ্রুত সম্ভব কমপ্লিট স্ক্রিপ্টটি চাইছেন তারা।
নায়লার এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজটি নিয়ে বসতে পারেনি সৌরভ।
সানজানার সঙ্গে নতুন টেলিফিল্মের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেছে সে। গল্পটা রোমান্টিক হলেও থ্রিলারের আমেজ রাখতে চায় সৌরভ। আজকাল স্রেফ নায়ক-নায়িকার প্রেম রোমান্স দেখে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না দর্শক। হলিউডের ছবিগুলো নিত্য নতুন গল্পের চমক নিয়ে আসছে। ওটিটির কনটেন্টগুলোতেও থ্রিল, সাসপেন্স রোমান্সের অদ্ভুত মিশেল থাকছে। দর্শক সেগুলোই বেশি পছন্দ করছে। সেরকম একটি গল্পের প্লট সাজিয়েছে সৌরভ টেলিফিল্মটির জন্য। এর প্রধান নায়িকা চরিত্রটি রূপায়ণের জন্য আগেভাগেই নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়, এ কারণে সানজানা কয়েকবার কথা বলেছে তার সঙ্গে।

সাত.
চিত্রনায়িকা নায়লা শারিমনের এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউটা পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে হইচই পড়ে গেছে। অনেকেই ফোন করে বাহবা দিয়েছেন সৌরভকে। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, প্রশংসা করেছেন।
‘আমরা এতদিন ধরে এ লাইনে আছি। কতজনকে নিয়ে কত কী লিখছি। অথচ আমাদের হাত দিয়ে এমন কিছু বেরোলো না। কোনো নতুনত্ব নেই, চমক লাগানো কিছু নেই। গতানুগতিক, একই ধারায় লিখে যাচ্ছি। যা পাঠক, সিনেমা দর্শক, তারকাদের ভক্ত অনুরাগীদের মধ্যে আলাদা সেনসেশন সৃষ্টি করতে পারছে না মোটেও। অথচ তুমি কী সুনিপুণভাবে নায়লার সঙ্গে তোমার আলাপচারিতা তুলে ধরেছো। ছোট ভাই, তুমি সত্যি জিনিয়াস। তোমার মধ্যে অনেক কিছু আছে, যা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। তুমি জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছো। তোমাকে স্যালুট জানাই। নায়লার ফিল্মি ক্যারিয়ারে আজ পর্যন্ত তেমন ইন্টারভিউ কেউ করতে পারেনি। বলা যায়, তাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তুলে ধরেছো সবার কাছে। এতে করে তার ব্যক্তি ইমেজ অনেকটাই ব্রাইট হয়েছে’।
এতদিন ধরে নানা স্ক্যান্ডাল আর গসিপে নায়লার ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যাচ্ছিল। অনেকেই তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। আগে কয়েকটি বিয়ের পর আবার নতুন করে বিয়ে পিঁড়িতে বসার খবরে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল বাজারে। সৌরভের করা ইন্টারভিউ নায়লাকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনেছে- সবাই বলাবলি করছে। আজকাল সিনেমার নায়িকাদের তেমন ইমপ্রেসিভ, এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ ছাপা হয়না পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে।
সৌরভ নিজেও ভাবেনি তার করা ইন্টারভিউ এতটা সাড়া তুলবে। যা নায়লার জন্য অনেক আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। তাকে সবার কাছে নতুনভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। নায়লার প্রতি তার বিশেষ কোনো দুর্বলতা কিংবা অনুরাগ- আগে কোনোসময়েই ছিলনা। গভীর পেশাগত সম্পর্কও গড়ে ওঠার সুযোগও হয়নি কখনো। দূর থেকে দেখা স্রেফ একজন নায়িকা ছিল শুধু সে। হঠাৎ কী মনে করে মাথায় খেয়াল চেপেছিল। নায়লাকে নিয়ে গত কয়েকদিনের গসিপ নিউজগুলো দেখে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের তাড়না অনুভব করছিল সৌরভ। অনেক নায়িকা কতো অনুরোধ করে। নানাভাবে প্রযোজক-পরিচালক, নায়কদের দিয়ে সুপারিশ করেও তাকে দিয়ে যে কাজ করাতে পারেনি এতদিন। সেটা সে করেছে নায়লার জন্য। অথচ এ জন্য মুখ ফুটে তাকে অনুরোধ করেনি সে। অন্য কোনোভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টাও করেনি। অথচ সৌরভ সেই অসাধারণ কাজটা করেছে। তার করা ইন্টারভিউ পড়ে সবার ধারণা পাল্টে গেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে সমসাময়িক প্রতিদ্ব›দ্বী অন্যান্য নায়িকা যারা গত কয়েকদিনে নায়লার প্রতি সবার ক্রমাগত নেগেটিভ ধারণা সৃষ্টিতে উচ্ছ¡সিত হয়েছিল, তাদের সেই উচ্ছ¡াসে পানি ঢেলে দিয়েছে এই ইন্টারভিউ। কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ আড়ালে এ নিয়ে নানা কথা ছড়াতে শুরু করেছে। মনের ক্ষোভ, ঝাল ঝাড়তে আজেবাজে অশালীন মন্তব্য করতেও দ্বিধা করছে না তাদের মধ্যে অনেকেই।
‘আরে জানি না বুঝি। নায়লার যা ক্যারেক্টার। পুরুষ মানুষদের একের পর এক ঘায়েল করতে করতেই তো এতদূর এসেছে। কাকে কীভাবে ব্যবহার করে নিজের ফায়দাটা হাসিল করতে হয়, সেটা জানে সে খুব ভালোভাবেই। সৌরভ ওমরের মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট, সিনসিয়ার জার্নালিস্ট, রাইটারকেও ঘায়েল করতে সময় লাগেনি। আমরা কত বলে কয়েও আমাদের সম্পর্কে তাকে দিয়ে দু’তিন লাইন লেখাতে পারলাম না। নানা কৌশলে, নানা ছুতোয় এড়িয়ে চলেছে যে মানুষটা আমাদের। তার কাছ থেকে মেয়েটা কীভাবে এতটা ফেভার আদায় করলো, জানি না বুঝি। আরে চাইলে আমরাও তো তাই দিতাম, সে যা দিয়েছে। ওর চেয়ে আমরাও কম কীসে বরং আরো বেশিই দিতে পারতাম। সেই যোগ্যতা এবং ক্ষমতা তো আমাদেরও আছে’।
এসব কথা সৌরভের কানেও এসেছে। ভীষণ বিব্রতবোধ করেছে, লজ্জাও পেয়েছে সে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নোংরা পলিটিক্স সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। তবে এখানকার কিছু মানুষ ভেতরে ভেতরে আরো বেশি নোংরা। অন্যের ভালো কিংবা সাফল্য অথবা এগিয়ে যাওয়াটা সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। সাধারণত মেয়েরা একটু বেশি হিংসুটে, ঈর্ষাপরায়ণ হয়। শো-বিজের মেয়েদের মধ্যে এটা আরো কয়েক কাঠি বেশি দেখা যায়। প্রতিদ্ব›দ্বী সমসাময়িক নায়িকাদের মধ্যে ঠোকাঠুকি, ঝগড়া বিবাদ, বিরোধ, মনোমালিন্য লেগেই থাকে প্রায় সময়। বাইরে থেকে দেখে যা অনেক সময় বোঝা যায় না। উপরে উপরে ভালোমানুষি ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে বিষাক্ত মনোভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। অন্যের নামে কুৎসা রটাতে, খারাপ কথা ছড়াতে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করে তাদের মধ্যে কেউ কেউ।

আট.
দুপুরে একটা সিএনজি স্কুটার নিয়ে সোজা নিয়াজ সাহেবের বাসায় গিয়ে হাজির হয় রূপা। ড্রইরুমে লোকজনের ভিড়। লোকজনের সঙ্গে নিয়াজ সাহেব তার নতুন ছবির নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। রূপাকে দেখে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
‘ওহ রূপা, তুমি এসে গেছ? ভালোই হলো, ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই তোমাকে।’
নিয়াজ সাহেবের কণ্ঠে অনেক উচ্ছ¡াস ঝরে পড়ে।
রূপা একটা সোফায় বসে। একজন চলচ্চিত্র সাংবাদিক কিছু ছবি তোলেন রূপার। অল্পস্বল্প আলাপও হয় তার সঙ্গে। আধা ঘণ্টার মধ্যে ওরা সবাই বিদায় নেয়। নিয়াজ সাহেব ওদের বিদায় দিয়ে ফিরে আসেন।
‘রূপা, চলো ভেতরে গিয়ে বসি আমরা, তারপর কথাটথা বলি।’
‘এখানেই তো ভালো, ভেতরে আবার কেন?’ সংকুচিত হয়ে বলে রূপা।
‘আরে ভয় নেই, বাসায় আর কেউ নেই, তোমার ভাবী বাচ্চাদের নিয়ে খুলনা গেছে বেড়াতে। চলো তো ভেতরে’; বলে নিয়াজ সাহেব রূপার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে চলেন। নিয়াজ সাহেবের বাসায় আর কোনো লোকজন নেই দেখে অবাক হয় রূপা। বেডরুমে ঢুকে আরো বেশি চমকে ওঠে।
ছিমছাম সাজানো গোছানো বিছানার পাশে টেবিলে বেশ কয়েকটা মদের বোতল। নিয়াজ সাহেব গøাসে মদ ঢালতে শুরু করেন। একটা গøাস নিজে নিয়ে আরেকটা রূপার দিকে এগিয়ে দেন।
ভীষণ দ্বিধায় পড়ে যায় রূপা। কী করবে সে? খাবে কি খাবে না। এর আগে মাঝেমধ্যে বিয়ার খেয়েছে। সিনেমার লাইনে আসার আগে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গিয়ে বিয়ার খাওয়ার অভিজ্ঞতা হলেও হুইস্কি খায়নি কোনোদিন।
তার দ্বিধা দেখে নিয়াজ সাহেব হাসেন।
‘এই লাইনে নেমে এমন করলে তো চলবে না। ড্রিংক ফ্রিংক না করলে শরীরে গø্যামার বাড়াবে কিভাবে? খাও, খাও, ভয় নেই। বিষ নয়, অমৃত এগুলো। আজকাল তো প্রায় সব বড় নায়িকাই এসব হরদম খায় গø্যামার ধরে রাখার জন্য’; রূপাকে উৎসাহিত করতে বলেন।
রূপা কোনোভাবে এক চুমুক খায়। গলার মধ্যে তরল আগুন জ্বলতে জ্বলতে ক্রমেই নিচের দিকে নামতে থাকে। বমি আসতে চায়। কোনোভাবে সামলে নেয় নিজেকে। এরপর আরো কয়েক চুমুক। এবার আর বমি লাগে না। বরং ভালো লাগতে থাকে।
ওদিকে নিয়াজ সাহেব গøাসের পর গøাস শেষ করছেন। নেশা জড়ানো গলায় বলতে থাকেন, ‘রূপা তুমিই হবে আমার নতুন ছবির নায়িকা, তোমাকেই কাস্ট করলাম আমি নতুন ছবির জন্য, কি তুমি খুশি তো? আমিই তোমাকে প্রথম ব্রেক দিতে চাই নায়িকার রোলে, আমি জানি তুমি পারবে, এবার তুমি তোমার কারিশমা দেখাও। আমি দেখতে চাই, কতটা পারো তুমি?’
একসঙ্গে এতগুলো কথা বলতে বলতে লোকটার কণ্ঠ জড়িয়ে আসে।
রূপার মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। তার স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে তাহলে।
সে ঢাকা শহরে এসে অনেক চড়াই-উতরাই পথ পেরিয়ে রুপালি পর্দার নায়িকা হওয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। এখন আর তাকে কেউ অবহেলা করতে পারবে না। কেউ তাকে করুণা করবে না, বরং সম্মান করবে। আজকের প্রতিষ্ঠিত নায়িকাদের মতো তার দামি গাড়ি হবে, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট হবে, প্রভাব প্রতিপত্তি হবে। সবাই তার প্রশংসা করবে।

নয়.
নিয়াজ সাহেব বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিগারেট টানছেন তখন। লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ঘৃণা জাগে রূপার মনের মধ্যে। ওর ইচ্ছে করে লোকটার গায়ে থুথু ছিটাতে। লোকটার রুচি বলতে কিছু নেই। লোকটাকে জঘন্য প্রকৃতির একটা পশু মনে হয় রূপার। অথচ বাইরে থেকে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
নিয়াজ সাহেব এতক্ষণ তার ওপর বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন প্রচণ্ডভাবে, এটা বুঝতে পারে রূপা। পাশের ওয়ারড্রোবের ওপরে রাখা জামাকাপড় নিয়ে সে এটাচড বাথরুমটাতে ঢোকে। দরজা বন্ধ করে দাঁড়ায় লাইফ সাইজ আয়নাটার সামনে। চোখে মুখে প্রচণ্ড ক্লান্তি আর বেদনার ছাপ। এই মুহূর্তে আয়নায় নিজের শরীরটা আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। কিন্তু কোনো শিহরণ জাগে না। মনে কোনো ভাবান্তর ঘটে না। কেমন অপরিচিত, অচেনা মনে হয় নিজেকে। হঠাৎ তার ধারালো ফিগারের শরীরটার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জাগে। আজ এই শরীরটাকে পুঁজি করে অনেক ওপরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই শরীরটাকে বিভিন্ন পুরুষের খেলার পুতুল হিসেবে অবাধে ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে। যার বিনিময়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ির সন্ধান করছে সে। এতসব ভাবতে ভাবতে মনটা তার এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়।
কাপড় চোপড় পরে বাইরে এসে রূপা দেখে নিয়াজ সাহেব আবারও মদের গøাস নিয়ে বসেছেন। তাকে দেখে হাসেন বিশ্রীভাবে। তারপর বলেন, আমার নতুন ছবিতে কনফার্ম হয়ে গেলে তুমি, নেক্সট ছবির কাজ শুরু করব সামনের মাসেই। এর মধ্যে তুমি আমার অফিসে দেখা করো, তোমার রোলটা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে, ড্যান্স পারফরমেন্স তোমার এমনিতেই সুন্দর, প্রথম সিনেমাতেই তোমাকে সুপারহিট হিরোইন করে ছাড়বো। তুমি পারবে। আমার বিশ্বাস, আজকের অনেক নামিদামি নায়িকাকে টেক্কা দিতে পারবে তুমি। তেমন কনফিডেন্স আছে আমার।’
কথাগুলো শুনে অন্য সময় হলে খুব ভালো লাগত রূপার, কিন্তু এই মুহূর্তে কেমন বিরক্ত লাগে তার। কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রকাশ পেতে দেয় না সে। মোহনীয় হাসি ছড়িয়ে রূপা বলে, ‘নিয়াজ ভাই আপনার অবদানের কথা চিরদিন মনে রাখব, নায়িকা হিসেবে আমাকে যে চান্স দিয়েছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ, আমার মতো সাধারণ একজন শিল্পীকে নায়িকার সুযোগ দিয়েছেন- আমি আপনার প্রেস্টিজ রাখতে পারব ইনশাল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
‘ঠিক আছে। আমার ডিরেক্টর সুজনকে বলে দেবো আজই। তুমি ওর সঙ্গে দেখা করবে আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে। তোমাকে ক্যারেকক্টার এবং গল্প বোঝাতে হবে তো। এজন্য সময় লাগবে কয়েক দিন, তুমি অন্যান্য ছবির কাজের ফাঁকে সময় বের করে নায়িকা হওয়ার জন্য প্রিপারেশন নিতে থাকো’। বলেন নিয়াজ সাহেব।

দশ.
নিয়াজ সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে রূপা। তখন সন্ধ্যে নেমেছে শহরে। রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে।
এখান থেকে ওর বাসা অনেক দূরে। হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তবুও কী মনে করে হাঁটতে থাকে রূপা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার কেন জানি মনে পড়ে যায় সেই দিনটির কথা। ঢাকা শহরে প্রথমদিন পা রাখার পর পুলিশের হেফাজতে কাটাতে হয়েছিল। তারপর থানা থেকে ছাড়া পেয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে শুরু করেছিল। ক্ষুধায় পিপাসায় তার পা সেদিন চলতে চাইছিল না। কেবল জড়িয়ে আসছিল।
আজো রূপার পা দুটো জড়িয়ে আসছে। কিছুক্ষণ আগে নিয়াজ সাহেবের ওখানে কয়েক পেগ হুইস্কি খেয়েছে। নেশার ভাবটা এখনো কাটেনি পুরোপরি।
ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে। কোনদিকে হাঁটছে রূপা খেয়াল করতে পারে না। তখনই পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়। হঠাৎ করে অন্ধকার যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা পৃথিবীতে। পথ চলতে গিয়ে ধাক্কা খায় কয়েকজনের সঙ্গে। আজ এই মুহূর্তে তার মনটা তেমন উদাস হয়ে যায়। নির্জন অন্ধকার রাস্তার ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে গিয়ে কোনোরকম ভয় বা সংকোচভাব জড়িয়ে ধরে না ওকে। নিয়াজ সাহেব তার আগামী ছবিতে নায়িকা করবেন- কথা পাকা হয়ে গেছে। তার মানে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নায়লা শারমিন, সামিরা খান, রেশমীদের মতো রূপাকে নায়িকা হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে। ডায়লগ বলতে হবে নায়কের সঙ্গে, প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে- ভাবতে গিয়ে কোথায় যে সে হারিয়ে যায় নিজেই বুঝতে পারে না রূপা।
তাকে দেখে একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব এসে দাঁড়ায় ফুটপাত ঘেঁষে। ড্রাইভার ভেতর থেকে রূপাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ম্যাডাম, কই যাইবেন-’
ট্যাক্সিক্যাবে চড়ার পর রূপা বলে, ‘মিরপুর সাত নম্বর চলেন।’
হোটেল শেরাটন ক্রসিংয়ে গাড়ি থামলে ছোট্ট একটা মেয়ে বেলিফুলের মালা এনে জানালার কাছে দাঁড়ায়।
‘আপা, একটা মালা নেন, দাম মাত্র ৫ টাকা,’ মেয়েটার কণ্ঠে অনেক অনুনয় ঝরে পড়ে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। আট নয় বছর বয়স হবে মেয়েটার। কচি নিষ্পাপ একটা মুখ। তার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে থাকে রূপা।
এই মেয়েটিও কি বড় হয়ে একদিন তার মতো হবে, একই পথে পা বাড়াবে? নিজেকে প্রশ্ন করে সে।
‘আপা, কী ভাবতাছেন, দাম তো খুব বেশি না, মাত্র পাঁচ টাকা। একটা মালা কিনলে গরিব হইবেন না।’
রূপা তাড়াতাড়ি পার্স খুলে একটা কড়কড়ে নতুন পাঁচশ’ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় মেয়েটার দিকে।
মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, ‘আপা, ভাংতি দিতে পারুম না। আমার কাছে তো এতো টাকা নাই…’
‘ভাংতি দেওন লাগব না, তোর সব মালা আমারে দে, সবগুলোর দাম এই পুরা পাঁচশ’ টাকা দিলাম। নে, কি চলবো না?’ বলে মেয়েটির হাতে নোটটা গুঁজে দেয়। অন্য হাতে মালাগুলো নিয়ে নেয়।
ট্রাফিক অপেক্ষমাণ গাড়িগুলোকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। সারি সারি গাড়িগুলো চলতে শুরু করেছে। রূপার ট্যাক্সিক্যাবটাও চলতে শুরু করেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখে সে। ফুলওয়ালি ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে পাঁচশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে রূপাকে বহনকারী গাড়িটির দিকে।
রূপা সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। ভীষণ কান্না পায় ওর।
চোখ দুটো ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে।

এগারো.
অফিসে পৌঁছে নিজের ডেস্কে বসতেই মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। এই সময়ের আলোচিত প্রযোজক নিয়াজ খান ফোন করেছেন। লোকটার অনেক ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। শোনা যায়, নানা ধরনের অবৈধ উপায় অবলম্বন করেই প্রচুর বিত্তভৈবের মালিক হয়েছেন তিনি। সামাজিকভাবে নিজেকে শক্তিশালী দাপুটে অবস্থানে নিয়ে যেতে রাজনীতিতেও জড়িয়েছেন। সেখানে নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণে টাকা-পয়সা খরচ করে বেশ ভালো পদও বাগিয়ে নিয়েছেন। সিনেমা প্রযোজনার পাশাপাশি আজকাল টিভি নাটক, ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্ম তৈরিতেও টাকা ঢালছেন দেদারসে। মোটকথা, বিনোদন শিল্পে নিজেকে একজন মহারথি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অকাতরে টাকা ঢালছেন মানুষটা। এ কাজে বেশ অনেকটাই সফল বলা যায় তাকে। এ লাইনে এখন সবাই এক নামে চেনে তাকে। ইন্ডাস্ট্রির অনেক কিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন তার মতো কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের হাতে। তাদের কথায় এখানে রাতারাতি অনেক কিছু ঘটে যায়।
লোকটাকে সৌরভ মোটেও পছন্দ করেনা। সিনেমা-নাটকে দেখানো সমাজবিরোধী, অসৎ, কুৎসিত চরিত্রের মন্দ মানুষদের মতো একজন মনে হয় তাকে। কারণ লোকটির প্রভাবশালী ক্ষমতাধর নেতৃস্থানীয় রূপটির আড়ালে থাকা আসল মানুষটি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে তার। সে পছন্দ না করলেও নিয়াজ খান সৌরভকে বেশ গুরুত্ব দেন। নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন, ফোনে কথা বলেন। তার কাছ থেকে নানা, বুদ্ধি-পরামর্শ নেন। প্রায়ই বড় বড় পার্টির আয়োজন করেন তিনি। যেখানে শো-বিজের নামিদামি সেলিব্রেটিদের উপস্থিতি থাকে বেশি। এর বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনের হোমরা-চোমড়া, সরকারি আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী, বিজনেস এলিটদের আনাগোনা থাকে সেই পার্টিগুলোতে। কখনো গুলশান ক্লাব, আবার কখনো উত্তরা বোট ক্লাব আবার কখনো শহরের পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেলে মধ্যরাত পর্যন্ত জমজমাট থাকে পার্টিও আয়োজন। পেশাগত কারণে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে সৌরভকে প্রায়ই যেতে হয় তেমন ফিল্মি পার্টিগুলোতে। ইচ্ছা না করলেও তাকে যেতে হয় নিতান্তই পেশার খাতিরে। কোনো পার্টি আয়োজন করলে সৌরভকে না ডেকে পারে না নিয়াজ। তার প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা, শ্রদ্ধা কিংবা আন্তরিকতা না থাকলেও মাঝে মধ্যে হাজিরা দিতে হয় সেখানে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পেশাগত কারণে এমন অনেক কিছুই করতে হয় তাকে আজকাল।
সৌরভকে কয়েকদিন আগে এক দুপুরে নিজের অফিসে ডেকে নিয়েছিলেন নিয়াজ সাহেব। নতুন একটি ছবিতে নতুন নায়িকা ব্রেক দিচ্ছেন তিনি। প্রথমে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়ে পরে নতুন ছবির নতুন নায়িকার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা বলেন। আজকাল রুপালি পর্দায় লাঞ্চিংয়ের আগে সিনেমার প্রযোজক পরিচালকরা নতুন নায়িকাদের মিডিয়ায় লাঞ্চিংটাকে বেশ গুরুত্ব দেন। পত্রপত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে নানাভাবে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে লাইম লাইটে নিয়ে আসতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। অভিনীত সিনেমা পর্দায় আসার আগেই সেই নতুন মুখের নায়িকাটি যাতে সবার আগ্রহ কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় সে লক্ষ্যে কত ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হয়, তার হিসাব থাকে না। সৌরভ তার গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় এসব কৌশল সম্পর্কে বিচিত্র ধারণা লাভ করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভদ্রতা, সৌজন্যতা, শিষ্টতা, শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করে যায়। যা নোংরামির পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও কিছুই যেন করার থাকে না। এতসব দেখতে দেখতে মাঝেমাঝে মনটা বিষিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ জাগে মনে। শিল্পচর্চা, সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য যে মানুষগুলো কাজ করছে সেই জগৎটার ভেতরে অসুন্দর, কুরুচি আর লোভ লাম্পট্যের চর্চা চলে নিত্যদিন। যে কারণে বাইরে থেকে অনেকেই এ জগৎ সম্পর্কে সুন্দর ধারণা পোষণ করতে পারে না। এক ধরনের বিরূপ ধারণা লালন করে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করে তারা। অথচ শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে অসুন্দর, রুচিহীনতা, অশালীনতা কোনোভাবেই চলতে পারে না। তবে এ লাইনের সবাই যে একই রকম তা কিন্তু নয়। মাত্র গুটিকতক মানুষের জন্য পুরো জগৎটা সম্পর্কে নোংরা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়াজ খানের আমন্ত্রণে তার বনানীর অফিসে ঢুকতেই বেশ হইচই করে উচ্ছ¡াস ভরা মেজাজে সৌরভকে সম্ভাষণ জানান তিনি। বোধ হয় তার অপেক্ষাতেই রিসিপশন লাউঞ্জে বসেছিলেন।
আরে, আমার ওস্তাদ সৌরভ ভাই আসছে। যার অপেক্ষায় এতক্ষণ ধরে বসে আছি। কী ভাই, এত লেট হলো! পথে জ্যামে পড়েছিলেন বুঝি, ওদিকে আপনার জন্য লাঞ্চ-টাঞ্চ সব রেডি কইরা বসে আছি। আর যার জন্য আপনাকে ডাকা সেই নতুন হিরোইনকেও এনে বসিয়ে রাখছি। চলেন, চলেন ভাই, বলে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেন নিজের গর্জিয়াসভাবে সাজানো চেম্বারের দিকে।
লোকটাকে তার মোটেও ভালো লাগে না। তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য রীতিমতো অপছন্দ করে। তবে পেশাগত কারণে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না সৌরভ। আসলে রাস্তায় জ্যামট্যাম কিছুই নয়, ইচ্ছা করেই দেরি করে রওনা দিয়ে এখানে এসেছে সে।
নিয়াজ খান এখন টাকার কুমির বনে গেছেন। যে ব্যবসায় হাত দিচ্ছেন সেটাই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। তরতর করে এগিয়ে চলেছে। সিনেমার ব্যবসা আজকাল আগের মতো রমরমা অবস্থায় না থাকলেও তার প্রযোজিত প্রায় সব ছবিই চমৎকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। এর বাইরেও অন্যান্য সব ব্যবসা-বাণিজ্যেও ল²ীর আশীর্বাদ লেগে আছে। নিজের বিশাল আয়তনের অফিসটাকে সাজিয়েছেন তেমন জমকালো ভাবেই। ফুল এয়ারকন্ডিশনাড অফিসের ইন্টেরিওর ডেকোরেশনে কার্পণ্য করেননি। তার নিজের চেম্বারে ঢুকতেই দুর্দান্ত এক সৌরভ এসে নাকে লাগে। মুহূর্তেই কেমন শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে দেহমনে। এটা কী রুম ফ্রেশনার, নাকি দামি অচেনা সৌরভের বিদেশি কোনো পারফিউম- ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
বিশাল চেম্বারের একপ

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়