ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

হিজল ফুল

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হালুয়াঘাট একটি উজ্জ্বল নাম। ময়মনসিংহ জেলার সর্বোত্তরে অবস্থিত এ উপজেলা। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারত-সংলগ্ন সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এ পথে ভারতে পাড়ি জমান। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিক সমাগম দেখে পাকবাহিনীও এ অঞ্চলে অতিরিক্ত নজরদারি বাড়ায়। হালুয়াঘাটের সীমান্তে পাকবাহিনীর অনেক ক্যাম্প ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সারাদেশের মতো হালুয়াঘাটেও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার সভাপতি নির্বাচিত হন ‘সীমান্তবন্ধু’ নামে পরিচিত তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি কুদরত উল্লাহ মণ্ডল এমপি। সদস্য সচিব নির্বাচিত হন তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহ মাজহারুল হান্নান। ২৫ মার্চের ভয়াবহ কালরাত্রির হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশের মতো হালুয়াঘাটের ছাত্র, যুবক ও সাধারণ জনগণও স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৮ মার্চ নকশী ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার হাকিম, কড়ইতলীর সুবেদার জিয়াউল হক ময়মনসিংহে ইপিআর ব্যারাকে অবস্থানরত সুবেদার ফরিদের নিকট থেকে এক  জরুরি ওয়্যারলেস মেসেজ পায়। তারা তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও  ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ৩০ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, টাঙ্গাইলের আ. মান্নান ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা হালুয়াঘাটের কড়ইতলীতে অবস্থান করেই ভারতীয় বিএসএফ অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। কুদরত উল্লাহ মণ্ডল এমপি গাছুয়াপাড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
ময়মনসিংহ থেকে পাকবাহিনী ফুলপুর হয়ে ২৮ এপ্রিল হালুয়াঘাট এসে অবস্থান করে। হালুয়াঘাট প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানকার রাস্তাঘাট অনেক দুর্গম। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেন রাবনেওয়াজ ও ক্যাপ্টেন বিল্লালের নেতৃত্বে পাকবাহিনী হালুয়াঘাটের দখল নেয়। বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
হালুয়াঘাট থানার সীমান্তবর্তী এলাকা তেলিখালী। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামলাপুর সেনাঘাঁটির মতো এই তেলিখালী বিওপির অনেক গুরুত্ব ছিল। সীমান্তবর্তী গ্রাম তেলিখালী দুর্গম অনুন্নত। তেলিখালী সীমান্ত ফাঁড়ি বা বিওপি ক্যাম্প মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর একটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পায়।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সত্তরোর্ধ্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. রব দু’হাত তুলে মোনাজাত করছেন। তিনি ঐতিহাসিক তেলিখালী গণকবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার চোখ অশ্রæসজল। ৩ নভেম্বর ১৯৭১! তেলিখালী যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মম হত্যার শিকার অনেক নিরীহ সাধারণ ও মুক্তিকামী মানুষ। তারা পরিবার-পরিজনের কাছে লাশ হয়েও ফিরে যেতে পারেননি। লাশগুলোকে বিনা সৎকারে একই গর্তে বা কূপের মধ্যে ফেলে গণকবর দেয়া হয়। তেলিখালী যুদ্ধে ২৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে পরবর্তী সময়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ২৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদের মধ্যে ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম স্মৃতিসৌধে অঙ্কিত রয়েছে।
স্মৃতিসৌধের ফলকে একটি নাম পড়তে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ. রব থমকে যান। নামটি তার খুব পরিচিত, খুব আপনজনের। নামটি শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলীর। নামটি পড়তে গিয়ে আ. রবের চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে।
শহীদ হযরত আলীর বাড়ি ছিল ফুলপুরে। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবের বাড়িও ফুলপুরে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একই সঙ্গে তারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। তেলিখালী যুদ্ধে তার প্লাটুনের সদস্য ছিলেন শহীদ হযরত আলী।
যুদ্ধরত অবস্থায় প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবের প্রতি হযরত আলীর শেষ অনুরোধ ছিল- যদি আমি মইরা যাই, তাইলে আমারে গ্রামের বাড়িতে দাফন দিয়েন। কথা দেন ভাইসাব, আমারে কবর দিবেন আমার বাড়িতে।
কৃষক হযরত আলীকে কথা দিয়েছিলেন কিন্তু রাখতে পারেননি! সেই আক্ষেপ আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আজও তার বুকটা হাহাকার করে ওঠে! টের পান হাতের পেশিগুলো কেমন যেন দৃঢ় হয়ে উঠছে, চোয়ালগুলো কঠিন হয়ে যাচ্ছে? শুধু কি হযরত আলীর লাশ? আক্তার হোসেন (হালুয়াঘাট), শওকত আলী (সরিষাবাড়ি), আলাউদ্দিন, রঞ্জিতের লাশও তো তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি! কেন সহযোদ্ধাদের পবিত্র লাশগুলো তেলিখালী গ্রামে বিনা সৎকারে একই গর্তে রেখে গণকবর দেয়া হয়েছিল? তার উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বরে। আসুন না সবাই মিলে ঘুরে আসি সেই সময়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবের স্মৃতিচারণায়…।
মো. আব্দুর রবের বাড়ি ফুলপুরের পয়ারী গ্রামে। ১৯৭১ সালে দুরন্ত টগবগে তরুণ আব্দুর রবের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। তখন ফুলপুর ডিগ্রি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ২য় বর্ষের ছাত্র তিনি। পড়তেন কলা বিভাগে। ফুটবল খেলা ছিল তার নেশা। পয়ারি স্কুল মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন বন্ধুদের সঙ্গে। তরুণ আব্দুর রব ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিটে। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থেকে এলাকায় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। পিতা হোসেন আলী কখনোই তাকে শাসন করতেন না। লেখাপড়া করেও যদি দেশের মানুষের উপকার করা যায় তাহলে বাধা কেন? ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে সবার বড় আব্দুর রব, তাই মা মোছা. রমজানুন্নেসার খুব আদরের ছিলেন।
নেতৃত্ব দেয়ার হাতেখড়ি তিনি রপ্ত করেছিলেন কলেজ জীবন থেকেই। অসহযোগ আন্দোলনে বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। এলাকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতেন তিনি। বুঝতে পারতেন এভাবে কিছু হবে না। পাকিস্তানি শাসকরা এ দেশকে কখনোই মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেবে না। এ দেশকে শুধু একটা প্রদেশ হিসেবেই গণ্য করবে। শোষণ করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর নিজেকে তৈরি করলেন আ. রব। মানসিক প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেল। ২৫ মার্চের পর যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন। পিতা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হোসেন আলী বুঝতে পারলেন বড় ছেলে যুদ্ধে যাবেই। মে মাসের শেষের দিকে মাকে সালাম করে বিদায় নিলেন। মা রমজানুন্নেসা ৫০ টাকা হাতে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ছেলেকে বিদায় দিলেন। পিতার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।
পিতা বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, বাবা ফিরবি কিন্তু দেশ স্বাধীন করে, তার আগে নয়।
আ. রব হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ের তুরায় মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছান। সেখানে টানা ১ মাস যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তার মেধা আর সাহসিকতা দেখে তাকে বিশেষ এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিংয়ের জন্য মনোনীত করা হয়। সফলতার সঙ্গে ট্রেনিং সমাপ্ত করে সীমান্তবর্তী এসএফ ক্যাম্প ডালু নামক স্থানে অবস্থান নেন। ডালু ক্যাম্প থেকেই প্রয়োজনমতো দেশের ভেতরে বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন।
ফুলপুর থানা ও হালুয়াঘাট থানার প্রধান সংযোগ সড়কের উপর নাগলা বাজারের অনতিদূরে ডুগাই নদী। এই নদীর উপর ছিল নাগলা সেতুর অবস্থান। নাগলা সেতুর অবস্থান ছিল ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকায়। ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল ময়মনসিংহে। নাগলা সেতুর নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়মিত কোনো সৈনিকের অবস্থান ছিল না। সেতুর দু’পাশে মিলিশিয়া ও রাজাকার দল নিয়মিত পাহারায় নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়তোবা ধারণা ছিল সেতু আক্রান্ত হলে অনতিদূরে ফুলপুরে অবস্থানরত ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে সঙ্গে সঙ্গে রিইনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে শত্রæর মোকাবিলা সম্ভব হবে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ডালু সাব-সেক্টর কমান্ডার ডা. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের কাছ থেকে নাগলা সেতু ধ্বংসের মাধ্যমে পাকবাহিনীর চলাচলে বাধা সৃষ্টির নির্দেশ আসে।
কমান্ডার আব্দুল হকের নেতৃত্বে ৪১ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলকে নাগলা সেতু ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই দলের মধ্যে বিস্ফোরক ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আব্দুর রবও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব এবং সহমুক্তিযোদ্ধারা সেতুর উত্তর পাশে সেতুর মুখে গর্ত খুঁড়ে এক্সপ্লোসিভ বসায়। সেতুর দক্ষিণ পাশে এসে কর্ডেক্স তারের সাহায্যে ফিউজে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটান। এই বিস্ফোরণে সেতুটির সামগ্রিক ক্ষতি সাধিত হয় এবং ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। সফল অপারেশন শেষে আব্দুর রব ফিরে আসেন ডালু ক্যাম্পে। অপেক্ষায় থাকেন পরবর্তী যুদ্ধের।
নাগলা সেতু উড়িয়ে দেয়ার অপারেশন শেষে পরিচয় হয় হযরত আলীর সঙ্গে। দু’জনের গ্রামের বাড়ি ফুলপুর হওয়ায় সখ্যতা আরো গভীর হয়। ১৮ বছরের তরুণ হযরত আলী বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করে পেটের টানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। সাহসী হযরত আলী দেশ-মাতৃকার ভালোবাসায় যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলে তাকে আর কষ্ট করতে হবে না, না খেয়ে থাকতে হবে না এটাই ছিল তার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণের মিশনে ভারতে মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে ডালু ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করেন। ডালু ক্যাম্প থেকেই অংশ নেন বিভিন্ন যুদ্ধে। যুদ্ধকালীন সময়ে সুখ-দুঃখের অনেক কথাই হতো দু’জনের।
দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে হামিদাকে বিয়ে করবে এমনটাই ইচ্ছে ছিল হযরত আলীর। হামিদাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। হামিদা তার খালাতো বোন। ফুলপুর সুতারপাড় তাদের বাড়ি। হযরত আলী থেকে ৩-৪ বছরের ছোট হামিদা। হামিদা মুখে প্রকাশ না করলেও ভাবসাব দেখে আলী বুঝে নিয়েছে তার গভীর ভালোবাসার কথা। সুতারপাড় গেলে তাদের দেখা হতো নদীর পাড়ে এক হিজল গাছতলায়। গাছতলায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা দূরের নদী দেখত, নীল আকাশ দেখত! আরো কত কী যে দেখত!
হালুয়াঘাট ভুবনকুড়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রাম তেলিখালী। হালুয়াঘাট থানা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এর একটু পশ্চিমে পানিহাটা পাদ্রী মিশনের অবস্থান। ডুমনীকুড়া-ভুবনকুড়া গ্রাম হয়ে তেলিখালীতে পাকবাহিনী যাতায়াত করে। উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডালু ও গাছুয়াপাড়া ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই তেলিখালী বিওপির গুরুত্ব ছিল। আর এ কারণে পাক সেনারা শক্ত

ঘাঁটি করে গড়ে তোলে তেলিখালীকে। ক্যাপ্টেন খালেকের নেতৃত্বে নিয়মিত সেনা, রেঞ্জার্স ও রাজাকার মিলিয়ে ২৩৭ জন পাকসেনা এই ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। এই বিওপির পতন না হলে হালুয়াঘাট হয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর। তাই তেলিখালী বিওপি আক্রমণের জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ মুক্ত করার মূল যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে সীমান্ত-সংলগ্ন দশমাইল এলাকা শত্রæমুক্ত করার মাধ্যমে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের যে স্ট্র্যাটেজি মুক্তি ও মিত্রবাহিনী গ্রহণ করে তারই একটি অংশ ছিল এই যুদ্ধ।
মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অপারেশন প্ল্যান তৈরি করেন ব্রিগেডিয়ার গ্রিল, ব্রিগেডিয়ার শান্ত সিং বাবাজী, কর্নেল থাপা, মেজর  স্বরূপ শর্মা, আর্টিলারির অমরজিৎ, ক্যাপ্টেন তোকারাম, ক্যাপ্টেন ভারত, ক্যাপ্টেন ভূপেন্দ্র, মুক্তিবাহিনী কমান্ডার হাশেম এবং বেশ কয়েকজন জেসিও। যুদ্ধ নির্দেশের আগে যুদ্ধক্ষেত্রে রেকি করা হয়। তেলিখালী যুদ্ধক্ষেত্রে রেকিতে অংশ নেন কমান্ডার আবুল  হাশেম, হাবিব, মেজবাহ ও মিত্রবাহিনীর মেজর স্বরূপ শর্মা, মেজর রামপাল ভার্মা প্রমুখ। তাদের গাইড হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় আক্তার সরকারকে।
২৫ অক্টোবর গভীর রাতেই তাদের রেকি সম্পন্ন হয়। বিওপির চারদিকেই ছিল শক্তিশালী ৯টি বাঙ্কার। বাঙ্কারগুলোতে ছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র এবং লোকবল। অনেক উঁচু উঁচু মাটির দেয়াল তৈরি করে বিওপিটি ঘেরা ছিল। অগণিত কঞ্চি পুঁতে রাখা হয়েছিল উত্তরদিকের জায়গা জুড়ে। পুঁতে রাখা হয়েছিল মাইন ও বুবি ট্র্যাপ। আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে তেলিখালীর দূরত্ব মাত্র ১ হাজার গজ। বিওপির আশপাশের গ্রামগুলো হচ্ছে আচকিপাড়া, পানিঘাঁটি, কামারগাতি, মাঝকুড়া ও চিড়িংগাপাড়া। এই বিওপির পূর্বদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটি খাল বয়ে গেছে। খালের অপর পাড়েও ছিল তিনটি বাঙ্কার। এই বাঙ্কারটি ছিল মূলত আকচিপাড়া বাঘাইতলি রাস্তা কাভার দেয়ার জন্য।
রেকি শেষে ২৬ অক্টোবর তেলিখালী বিওপিতে যুদ্ধের জন্য নকশা তৈরি করা হয়। চূড়ান্ত আলোচনাতে সিদ্ধান্ত হয়, বিওপি আক্রমণকালে নীরবতা রক্ষা করা হবে এবং হামলা হবে অতর্কিত। মূল আক্রমণকারী বাহিনীতে থাকবে কমান্ডার হাশেমের নেতৃত্বাধীন কোম্পানি (সদস্য সংখ্যা ২০৪) ও কর্নেল রাঘবনের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় ১৩ রাজপুত রেজিমেন্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল আক্রমণকারী দলটি ৫ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারতীয় ব্যাটালিয়নের ৪টি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হবে। সঙ্গে ভারতীয় ব্যাটারি ৪৬২ ভারতের অভ্যন্তর হতে গোলাবর্ষণ করে সহায়তা প্রদান করবে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব সদস্য একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর রাত ৩টা ৩০ মিনিট পরিকল্পনা মোতাবেক মূল আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে দায়িত্বও বণ্টন করে দেয়া হয়। মূল আক্রমণে নিয়োজিত হাশেম কোম্পানির  একটি প্লাটুন ও ১৩ রাজপুত রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি যুদ্ধক্ষেত্র হতে ৩০০ ফুট দূরে রিজার্ভ হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করবে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ড করবে নুরুল ইসলাম। ১৩ রাজপুতের ডি কোম্পানি ও মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন পশ্চিমদিক অর্থাৎ রামচন্দ্রকুড়ার দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবে। এতে থাকবেন মেজর স্বরূপ শর্মা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাশেম নিজে। দক্ষিণ দিকে থাকবে সাপোর্ট প্লাটুনের ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবের নেতৃত্বে সঙ্গে থাকবে ভারতীয় দুটি প্লাটুন। প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন এই দলটি ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল। এদের সঙ্গে ছিল দুইটি এইচএমজি, ৪টি বিএসজি, ২ ইঞ্চি  মর্টার, এমএমজি প্রভৃতি। অপরদিকে মেজর বেদীর নেতৃত্বে ভারতীয় একটি কোম্পানি ও মুক্তিযোদ্ধা আতার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন পূর্বদিক অর্থাৎ আচকিপাড়ার দিক থেকে আক্রমণ করবে। উত্তরদিক থেকে আক্রমণ করবে ১৩ রাজপুতের বি কোম্পানি, ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা এদের সহায়তা করবে। পূর্বদিকের কিছু অংশ খালি রাখা হয়। উদ্দেশ্য পাকবাহিনী এই পথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ভারতের মূল ভূখণ্ডে।
ভারতের ভেতরে কর্নেল থাপার নেতৃত্বে ৮টি হেভিগানের একটি ব্যাটারি স্থাপন করা হয় আক্রমণকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। যুদ্ধক্ষেত্র হতে ১ কিলোমিটার দূরে ক্যাপ্টেন ডা. পিল্লাই-এর নেতৃত্বে অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়। ড. মুহাম্মদ তার কোম্পানি নিয়ে তেলিখালী রামচন্দ্রকুড়ার রাস্তায় অবস্থান নেবেন এবং ১ নম্বর কাট অফ পার্টির দায়িত্ব পালন করবে। তেলিখালী কড়ইতলি বিওপি মধ্যবর্তী রাস্তায় অবস্থান নিয়ে ২ নম্বর কাট অফ পার্টির দায়িত্ব পালন করবে লে. তাহেরের কোম্পানি। আর ৩ নম্বর কাট অফ পার্টি লে. কামালের নেতৃত্বাধীন কোম্পানি অবস্থান নেবে তেলিখালী বাঘাইতলি রাস্তায়।
যুদ্ধের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রথম ধাপে প্রবেশ করে কাট অফ পার্টি। দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করে ফায়ার বেসের সৈন্যরা, তৃতীয় ধাপে প্রবেশ করে আক্রমণকারী মূল বাহিনী। পরিকল্পনামাফিক বাঙ্কারে গ্রেনেড হামলার পরিবর্তে ফায়ারের মধ্য দিয়েই যুদ্ধ শুরু হয়। দুই পক্ষে চলে প্রচণ্ড গুলি বিনিময়। ভারী অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় এই যুদ্ধে। রকেট লঞ্চার, ২ ইঞ্চি মর্টার, এইচএমজির গোলাবর্ষণে মূল রণক্ষেত্র ছিল প্রকম্পিত। আক্রমণের প্রবলতায় খুব দ্রুতই বাঙ্কার ছেড়ে মূল বিওপিতে চলে যেতে হয় পাক সেনাদের।
বিওপির দক্ষিণদিকে প্রবাহিত খালের আড়ালে অবস্থান নিয়ে কমান্ডার হাসেম ও হাবিলদার মেজবাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই সুযোগ বুঝে বাঙ্কার হোলের নিচে পৌঁছে সাহসিকতার সঙ্গে গ্রেনেড চার্জ করে হাবিলদার মেজবাহ, ল্যান্স নায়েক ওয়াজিউল্লাহ, হযরত আলী প্রমুখ। হযরত আলী অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ক্রল করে বাঙ্কার হোলের নিচে গিয়ে কয়েকটা গ্রেনেড চার্জ শুরু করে। এভাবে ১টি বাঙ্কারে সফল গ্রেনেড চার্জ করে পরবর্তী বাঙ্কারে প্রবেশ করেও গ্রেনেড চার্জ করতে থাকে। তাদের সাহসিকতা ও বিচক্ষণতায় ৪টি বাঙ্কার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা সম্ভব হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখানে শহীদ হন হযরত আলী ও ল্যান্স নায়েক ওয়াজিউল্লাহ। হযরত আলীর আর স্বাধীন দেশ দেখা হলো না।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সহযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবকে শুধু একটাই কথা বলেছিল, আমারে গ্রামের বাড়িতে কবর দিয়েন ভাইসাব।
আর কোনো কথা বলার আগেই মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন হযরত আলী। সহযোদ্ধার মৃত্যুতে আবেগতাড়িত হয়েও বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রব। এভাবে আরেকটি বাঙ্কারের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে শহীদ হন শওকত ওসমান। মুক্তিযোদ্ধাদের বেপরোয়া আক্রমণের একপর্যায়ে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী বিওপির ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। ফলে পাকসেনাদল কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিপুল উৎসাহে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এভাবেই দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমদিকের বাঙ্কারগুলো দখলে চলে আসে। এর ফলে শত্রæবাহিনী উত্তরদিকের বাঙ্কারগুলোতে আশ্রয়  নেয়। এখান থেকে কোনোমতেই তাদের সরানো যাচ্ছিল না।
এমতাবস্থায় কর্নেল রাঘবন রিজার্ভ ও হেডকোয়ার্টার কোম্পানিকে ডানদিক ঘুরিয়ে উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে আক্রমণের নির্দেশ প্রদান করেন। উভয়পক্ষে তখন প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে যুদ্ধ চলছিল। এতে উভয়পক্ষে আহত ও নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। উত্তরদিকের বাঙ্কারগুলো লক্ষ্য করে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়ছিল বিরামহীনভাবে। পাক সৈন্যরা কার্যকরভাবে তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছিল না। কারণ, পেছন দিক থেকে তাদের ওপর চলছিল কার্যকর রকেট লঞ্চার আক্রমণ। এ সময় মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কমান্ডার হাশেম রকেট লঞ্চার আক্রমণ বন্ধে অনুরোধ জানান, যাতে বাঙ্কারগুলোতে চার্জ করা যায়। রকেট লঞ্চার আক্রমণ বন্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার হোলের নিচে পৌঁছে যায় এবং গ্রেনেড আক্রমণের মাধ্যমে বাঙ্কারগুলো ধ্বংস করে দেয়।
এদিকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ তখনো চলছিল। ফলে রিজার্ভ বাহিনীর ১৩ জন ভারতীয় সেনা নিজেদের গোলার আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রব তার অধীনের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাঙ্কার ও বিওপি ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেই যাচ্ছিল। এভাবে সব দিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একযোগে সর্বশেষ বাঙ্কার ও ক্যাম্প লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। শত্রæবাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার সব পথ ছিল রুদ্ধ। তাই ঘাঁটির মূল অবস্থানের সামনে অন্তত ৪০ জন পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর হাতাহাতি শুরু হয়। এদিকে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে অবশিষ্ট পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে। জীবিত অবস্থায় ১৩ জন পাকসেনাকে আটক করা হয়। কিন্তু উত্তেজনাবশত মাত্র ১ জনকে বাদ দিয়ে অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে। কেরামত আলী খাঁ নামের পাকি সৈন্যকে জীবিত অবস্থায় মুজিবনগর প্রেরণ করা হয়। পরদিন পাকসেনারা পুনরায় বিওপি আক্রমণ করে দখলে নেয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়।
এ যুদ্ধে নিয়মিত সেনা, রেঞ্জার্স ও রাজাকার বাহিনী মিলিয়ে ২৩৭ জন সৈন্য পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে মাত্র কেরামত আলী খাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। অপরদিকে শহীদ হয়েছিল ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ৫৬ জন সৈনিক।
যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় আনন্দ ¤øান হয়ে যায় সহযোদ্ধাদের মৃত্যুতে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! তেলিখালী বিওপি ক্যাম্পে ধ্বংসস্তূপের চারপাশে পড়ে আছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র নিথর দেহ। কোনো কোনো লাশের মাথা নেই, হাত খণ্ড-বিখণ্ড, পেট ফেটে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আছে, চোখ নেই! বীভৎস সেসব দৃশ্য। প্লাটুন কমান্ডার আ. রব, হযরত আলীর লাশ খুঁজে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না শুরু করেন। গতকালই তো একসঙ্গে খাবার খেয়েছে, কথা হয়েছে।
হযরত আলী তাকে বলেছিল, ভাইসাব, দেইখেন দেশ আমরা স্বাধীন করমুই। হারামজাদারা আমাগো মা-বোনের ওপর হাত দিছে, আমাগো ইজ্জত নিয়া খেলতাছে। আল্লাহ সইবো না, দেশ স্বাধীন হইবোই। দেশ স্বাধীন কইরা আমরা একলগে বাইত ফিরমু ভাইসাব।
কতকিছু বলত সদ্য কৈশোর পেরোনো পাগল এই ছেলেটা!
যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বলেছিল, ভাইসাব আমি মরলে দাফন কিন্তু বাইতে করবাইন।
মৃত ব্যক্তিরা জীবিত অবস্থায় শেষ সময়ে নাকি টের পায় তার মৃত্যু সম্ভাবনার ব্যাপারে। হযরত আলী কি টের পেয়েছিল এমন কিছু? তা না হলে হযরত আলীর তো বাঙ্কারে ঢুকে গ্রেনেড চার্জ করার কথা ছিল না। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বাঙ্কার লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করার জন্য। হয়তো যুদ্ধের উত্তেজনায় কিংবা শত্রæবাহিনীর প্রতি রাগ-ক্ষোভের কারণে পাকিবাহিনীকে হাতের কাছে পেয়ে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গ্রেনেড নিয়ে। বাঙ্কারে কয়েকটা পাকসেনাকে ধরাশায়ী করে বীরের মতো মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল। তাই মৃত্যুর পরও তৃপ্তির স্বস্তিদায়ক একটা হাসির আভা তার পবিত্র মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে ছিল।
প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতে এতগুলো লাশ পরিবহন করে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তাছাড়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যে কোনো সময় বিপদসংকুল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হতে পারে। তাই সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তেলিখালী যুদ্ধ প্রাঙ্গণেই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একসঙ্গে গণকবর দেয়া হয়। তাই আর বাড়ি ফিরে যাওয়া হলো না শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলীর। বিষণ্ন মন আর অশ্রæসিক্ত নয়নে তাকে চিরদিনের মতো বিদায় জানায় প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রব। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত শ্রদ্ধায় গণকবরে শায়িত করা হয় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। তারপর আব্দুর রব বাড়ি ফিরেছিলেন ময়মনসিংহ স্বাধীন করে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। কিন্তু তিনি ফিরেছিলেন একা, সঙ্গে ছিল না হযরত আলী।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর গণকবরের পাশে দাঁড়িয়ে আজও অশ্রæসিক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রব। হযরত আলীকে ঠিক কোন জায়গায় কবর দেয়া হয়েছিল, তা আজ মনে করে উঠতে পারেন না? আসলে একসঙ্গে এত লাশ কবরে নামানো হয়েছিল যে, কার অবস্থান কোথায় তা বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না। এ সময় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে! কোথা থেকে যেন একটা ‘ভাওকুমটা বাতাস’ আ. রবকে ঘিরে ধরে। ‘ভাওকুমটা বাতাস’-র ছোঁয়ায় কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। শীতল এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আব্দুর রবের মনে হয় ‘ভাওকুমটা বাতাস’ যেন বলছে, ‘ভাইসাব আমারে বাইত নিয়া গেলেন না? দেশতো স্বাধীন হইছে, আমরাতো পারছি দেশ স্বাধীন করতে।’
আর অপেক্ষা না করে বাড়ির পথ ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব। পেছনে পড়ে থাকে তেলিখালী প্রান্তর আর অকুতোভয়ী এক বীরের অসীম বীরত্বের ইতিহাস, যার নাম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হযরত আলী!
সুতারপাড় নদীর ধারের সেই হিজল গাছটা আজ মহীরূহ হয়ে উঠেছে। যখন হিজলের টকটকে লাল ফুল ফুটে তখন নদীর পাড়ের সবুজ জমিন লাল চাদরে আবৃত হয়ে যায়। হিজলের থোকা থোকা লাল ফুল নদীর ¯্রােতে ভেসে যায় অনেক দূরে। কখনো কখনো হিজলের তলায় সাদা শাড়ি পরা একজন ষাটোর্ধ্ব বয়সের বৃদ্ধাকে দেখা যায়। গৌঢ় বর্ণের সেই বৃদ্ধা দীর্ঘ সময় বসে থাকেন হিজল তলায়। তারপর মনের জানালা খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দূরের নদী দেখেন, নীল আকাশ দেখেন! আরো কত কি দেখেন কে জানে? তবে তিনি দেখেন।

– মুহাম্মদ সারোয়ার হোসেন

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়