ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

একাত্তরের কান্না-হাসির ঈদ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেহরি খেতে বসেছি। চোখ কচলাতে কচলাতে আমার নাতনি টেবিলে বসল। নিজ জীবনের কথা মনে পড়ল। রোজা রাখতাম। অর্ধেক দিন শেষে রোজা ভাঙতে হতো। বলা হতো ছোট মানুষের রোজা হয়ে গেছে।
আর বড় হয়ে দেখতাম সহপাঠীরা চাপে পড়ে রোজা রাখছে ঠিকই, কিন্তু পুকুরে ডুব দিয়ে পানি খেয়ে নিচ্ছে। তখন কেউ ঈদুল ফেতর বলতে অভ্যস্ত ছিল না। বলত রোজার ঈদ। ঈদের দিন এক রাস্তা দিয়ে যেতাম আর একটা দিয়ে ফিরতাম। কাঁটা তারের বেড়া পার হতে হতো, মাথানত করে যেতে চাইতাম না। তাই তারের উপর দিয়ে যেতে রক্তাক্ত হতাম। অনেকটা ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।’
এই যে স্বাধীনচেতা মনোভাব তা বাবা থেকে সন্তানে সংক্রমিত হয়েছে আর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ও দীক্ষায় তা শানিত হয়েছে। পাকিস্তানের অপকর্ম, অপশাসন, নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও ইজ্জতহানির কালে তা প্রচন্ডতা পেয়েছে। এসবই ত আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে টেনে এনেছে।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে দেরাদুন থেকে পুনঃপ্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরেছি। প্রশিক্ষণকালেই যৌথ কমান্ড গঠনের ইঙ্গিত পেয়েছি। আগরতলায় নেমে দেখলাম একটি সাজ-সাজ অবস্থা। বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বানর বাহিনীর আগমন লক্ষ করলাম। আমাদের প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি তার পূর্বের অবস্থান পরিবর্তন করলেন। পূর্বে তার যৌথবাহিনী গঠনে মৃদু আপত্তি ছিল। কেননা আমাদের অঙ্গীকার ছিল যে নিজেরাই নিজের দেশটা মুক্ত করব। মনি ভাই এই প্রত্যয়ের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ নিয়ে এগোতে লাগলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করে সেখানে বাংলাদেশ সরকারকে বসিয়ে তবে যুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ শত্রæমুক্ত করবেন। উদ্যোগটি উচ্চাভিলাষী ছিল নিঃসন্দেহে কিন্তু ইতোমধ্যে যৌথবাহিনী গঠিত হয়ে গেলে তার উদ্যোগটি তেমন আর দুঃসাধ্য মনে হলো না।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মেজর জেনারেল ওবানসহ তিনি তার বিশাল গেরিলা বাহিনী নিয়ে প্রথমে মিজুরাম যাবেন, তারপর মিজুরাম থেকে সামনে যাবেন। ব্যবস্থা হলো কেউ কেউ বিমানে যাবেন বা হেলিকপ্টার থেকে অ্যায়ারড্রপ হবেন, আর কেউ কেউ স্থলপথে যাবেন।
এই সিদ্ধান্তের অন্তিম পর্বে আমিও মিজুরাম যাব বলে জেদ ধরে বসলাম। কিন্তু মনি ভাই আমাকে নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়াও অপর একটি উপাদান বাধা হয়ে দাঁড়াল। অপর উপাদানটি হলো আমি আমার বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। এসব তথ্য তিনি কেমন করে জানতেন তা বলতে পারব না। আমাদের মধ্যে মিজুরামে যাওয়া নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক হলো। আগরতলা বিমানবন্দরে সামান্য কিছু লাগেজসহ আমি গিয়েছিলাম। সেগুলো নিয়ে আবারো আগরতলার দিকে ফিরতি যাত্রার প্রাক্কালে শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে সেক্টরের দায়িত্বসহ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্ব দিলেন।
মন খারাপ করে সেক্টরে ফিরে এলাম। আমার কাজ দাঁড়াল সার্বিক সুপারভিশন। কে কোথায় আছে, কেমন আছে, অস্ত্রের কী পরিমাণ আছে আর সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে গেরিলাদের করণীয় কী, তার নির্দেশ দিয়ে বেড়ানো। সে সময়ের যোগাযোগব্যবস্থা আর আজকের যোগাযোগব্যবস্থার আকাশ-পাতাল ব্যবধান ছিল। একমাত্র উত্তম-মাধ্যম ছিল জিপ চড়ে বা পায়ে হেঁটে সংবাদ পৌঁছিয়ে দেয়া। আমাদের ওয়ারলেস অপারেটরা হয় মনি ভাইয়ের সঙ্গে চলে গেছে কিংবা নিজেদের ইউনিটে আটকিয়ে গেছে। তাই আমার পরিশ্রমটা বেড়ে গেল।
এই ব্যবস্থার মধ্যে কখন যে রমজানের ঈদ এসে গেল তা বলতেই পারিনি। তাই ধর্মকর্মের প্রতি অনুরক্ততা থাকলেও রোজা রাখাটি বিশেষত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় বা সীমান্তের ওপারে অসম্ভব ছিল। সম্ভবত ঈদটা ছিল ২০ নভেম্বর। আমি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে কলেজ টিলার অস্থায়ী অবস্থানে ফিরলাম। ফিরে দেখি কেনু ভাই কী যেন পাকাচ্ছে। কেনু ভাই একজন মোটর মেকানিক্স ছিলেন আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। যুদ্ধ আমাদের সমতা ও সমতটে নিয়ে এসেছে। শুধু খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে নয়, মাঝে মাঝে এক বিছানা দুজনে শেয়ার করতাম। মাত্র মাস দেড়েক আগে তার অতি মেধাবী ছোট ভাই আবু জাহেদ সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তার সঙ্গে শহীদ হয়েছেন মোজাম্মেল হক আবু ও সাইফুল ইসলাম সাফু, আহত হয়েছেন আরো অনেকেই। আরো শহীদ হয়েছেন তাহের, যিনি এমকম পড়া অবস্থায় আর্থিক সংকট কাটাতে বিয়ে করেছিলেন। তার শাহাদাতের পরে জানতে পারি যে তার মা-বোনও বিধবা ছিলেন। এতসব মৃত্যু আমাকে চঞ্চল করে তুলল। তাই আগের মতো নিজকে আমি মূল্যবান মনে করছিনে; কিন্তু মনি ভাই আমাকে মূল্যবান করেছেন বলেই সবকিছু ভুলে দায়িত্ব এগিয়ে নিতে ব্রতী ছিলাম। তাই রোজা ও ঈদের কথা প্রায়ই ভুলেই ছিলাম।
কলেজ টিলায় কেনু ভাই সেমাই পাকাচ্ছিলেন। আমি এমনি অনাকাক্সিক্ষত ব্যবস্থায় আশ্চয়ান্বিত হলাম। এমন উৎসব ভাব দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে জানলাম ‘স্যার, আজকে ঈদের দিন।’ এ কথাটি শুনেই আর আবেগ সামলে রাখতে পারলাম না। দুটো চোখ চেপে ধরে আমার কক্ষে ঢুকে ডুকরে কাঁদতে শুরু করলাম। স্মৃতি আমাকে চেপে ধরল। কেনু ভাই সে দৃশ্য দেখেনি, কেননা তিনি কিছু পোলাও পাকাচ্ছিলেন। খাবার নিয়ে এসে দেখলেন আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমরা তো এখনো বেঁচে আছি, আর সংসারের হাল ধরার মতো আমার ভাইটিও যে শহীদ হয়ে গেল। কান্নার কথা তো আমার, আর কাঁদছেন আপনি, কেউ আপনার কান্না দেখলে হতবল হবেন, একটু হাসুন।’
হঠাৎ ঈদের দিনে এক হাসির কথা মনে পড়ে গেল। জোরে হেসে ফেললাম।
শুধুমাত্র ঈদের দিনেই অভয় আশ্রমে ঢোকার সুযোগটি ছিল। সেদিন পেট ভরে অমৃত ফল খেতাম। এই ফলটাকে শহরের মানুষ জামরুল বলত।
দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি যাওয়া, ভাত-পোলাও হজম করতে হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা, কুস্তি বা দৌড় প্রতিযোগিতায় নামা হতো। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বাড়ির কাজের ছেলেরা যোগ দিত। তাদেরকে চাকর বলা হলেও সম-মর্যাদাস্থ দেয়া হতো।
একবার ঈদের দিনে আমরা একটা নিষ্ঠুর তামাশা করেছিলাম। সেকালে ছবি তোলার প্রচলন তেমন ছিল না। কালা নামে আমাদের একটা কাজের লোক ছিল। হয়তো তার নাম কালাম থেকে কালা হয়েছিল। তার বড্ড শখ ছবি উঠানো। গ্রামে ও শহরতলিতে ক্যামেরা তখনও দুষ্প্রাপ্য বস্তু। তবু আমাদের বদৌলতে তার সেটা দেখেও ছবি তোলার খায়েশ হলো।
অন্য সময়ের ব্যতিক্রম হিসেবে ঈদের পর্ব শুরু হলো ছবি তোলা দিয়ে। আসলে আমাদের হাতে কোনো ক্যামেরা ছিল না, ক্যামেরার অনুরূপ কোনো একটি বস্তু হাতে নিয়ে কালাকে চেয়ারে বসতে বললাম। আমাদের মতলব ছিল তাকে চিতপটাং করে দেয়া। চেয়ারে বসতে উঠতে বলা এবং কৌশলে চেয়ারটি সরিয়ে দিয়ে তাকে চিতাফটাং করা। একজনকে ইঙ্গিত দেয়া ছিল এক ফাঁকে তার চেয়ারটা সরিয়ে নেয়ার। তারপর কালার ছবি তোলার ভানা করা হলো। এক পর্যায়ে চেয়ারের পেছনে দাঁড়ানোর ব্যক্তিটি চেয়ারটা সরিয়ে নিল। আর যায় কোথায় সে চিতপটাং হয়ে পড়ে গেল ঠিকই; কিন্তু চেয়ারের কোনায় তার মাথা লেগে বেশ গভীর ক্ষত তৈরি হলো। কালা উচ্চস্বরে কান্না শুরু করল। সবাই তখন দৃশ্যপট ছেড়ে পালাল। আমি তার রক্তপাত বন্ধ করে আমিও পালালাম। পালানোর কারণ হলো আমাদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা আমাদের এই অপকর্মের জন্য নিশ্চিত শাস্তি দেবে। আমাদের কোথায় গেল খেলাধুলা, গালগল্প, শিরনি-ফিরনি, সেমাই খাওয়া। অভুক্ত অবস্থার সারাদিন পালিয়ে কাটালাম। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে একটা প্রায় পরিত্যক্ত বাড়ির আমগাছের সব আম সাবাড় করে ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটালাম।
আম গাছের মালিক এসে গ্রামের সরদারের কাছে অভিযোগ করা মাত্র তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। ‘সবার কঠিন বিচার হবে’ বলে তিনি তারস্বরে চিৎকার করছিলেন। অভিযোগ দাতা অতি নিম্নস্বরে বললেন, ‘মিয়া ভাই, তাদের সঙ্গে আপনার ছেলে সেলিমও আছে।’ শুনেই সরদার সাহেবের কথাবার্তা বদলে গেল। তিনি বললেন, ‘আরে আনুমিয়া, তুমি কি অভিযোগ করলা, ছেলে পিলেরা একটু আম খেয়েছে তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?’ এ কথা শুনে আনুমিয়া নিঃশব্দে চলে গেলেন।
২০ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সে কথা মনে পড়ায় হাসি আর চেপে রাখতে পারলাম না। আর আমার ঈদ রূপান্তরিত হলো কান্না-হাসির ঈদ।
– অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়