ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

ঈদ শুধু এবাদত নয় উৎসবও

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি মুসলমানের জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ। বাস্তবতা এই যে, ঈদ বর্তমানে ধর্মীয় আচার হিসেবে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, উৎসব হিসেবে ততটা নয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠে জামাতে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় এবং ভালো খাওয়া-দাওয়া ও ভালো কাপড়চোপড় পরা ছাড়া এদিনে আর উপভোগের তেমন কিছু থাকে না। সামাজিক বন্ধন অনেকটাই আলগা হয়ে যাওয়ার কারণে আগের মতো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যাওয়া হয় কম। দল বেঁধে সিনেমা হলে যাওয়ার দিনও শেষ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন দ্বারা উৎসব দীর্ঘায়িত করার উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বরং এ নিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রবণতা আছে কোথাও কোথাও। শুয়ে-বসে, টেলিভিশন দেখে ঘরেই অলস দিন কাটে বেশির ভাগ মানুষের। ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে একাংশ আবার টেলিভিশনেও চোখ রাখতে নারাজ। মসজিদ-মাদ্রাসা ও ওয়াজ মাহফিলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা সমাজে কমবেশি প্রভাব ফেলছে। ফলে ঈদোৎসবের উৎসব লঘু হচ্ছে, থাকছে শুধু এবাদত।
লেখক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখতেন। তিনি ছিলেন মুসলিম স্বাতন্ত্র্যনীতির অনুসারী। বিভাগোত্তর কালে পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি পশ্চিম বাংলার প্রভাববলয় হতে মুক্ত হয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকাশ লাভ করুক তা চাইতেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ভাষা পূর্ব বাংলায় প্রভুত্ব করুক তা চাইতেন না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারেও ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁসহ আরো অনেকেই মুসলিম স্বাতন্ত্র্যনীতির এ ধারার প্রতিভূ ছিলেন। ইসলামি তাহযিব-তমদ্দুনকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে তাদের কারো কারো অবস্থান ছিল বেশ দৃঢ়। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী এমন ধারার বিপরীতে অবশ্য ছিল আরেক ধারা, যাকে সমন্বয়বাদী ধারা ধরা যায়। সমন্বয়বাদী ধারার লেখক-চিন্তকরা ছিলেন উদার প্রকৃতির, তারা সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই ভেদবিভেদ পছন্দ করতেন না। তো এই আবুল মনসুর আহমদ ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত তার ‘পাক বাংলার কালচার’ নামক গ্রন্থে ধর্মীয় উৎসবাদি থেকে আনন্দোল্লাস হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রতিকার প্রত্যাশা করেছিলেন। তার আগে ’৪৭-এর বিভাগপূর্ব কালে সমন্বয়বাদী ধারার অন্যতম প্রবক্তা কাজী মোতাহার হোসেন তার ‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘পৃথিবীতে যদি আনন্দ-পেষা কল না দেখে থাক, তবে এস, বাংলার মুসলমান সমাজে এসে দেখে যাও’। (তথ্য : মোরশেদ শফিউল হাসানের গ্রন্থ ‘পূর্ব বাংলায় চিন্তাচর্চা, ১৯৪৭-১৯৭০, দ্ব›দ্ব ও প্রতিক্রিয়া)
আবুল মনসুর আহমদ পূর্বোক্ত গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘ধর্মোৎসবের ধর্মটুকু উৎসবের উল্লাসের নিচে চাপা পড়ার নজির আছে দুনিয়ায় অনেক। কিন্তু ধর্মের নিচে উৎসব চাপা পড়ার নজির আছে দুনিয়াতে মাত্র একটি। তা আমাদের ঈদ’। সাংস্কৃতিক উৎসবের পরিবর্তে ঈদকে একটি এবাদত হিসেবে পালন করার প্রচলিত রীতি বা প্রথার সমালোচনা করে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, ‘এবাদত ও উৎসব একত্রে চলিতে পারে না’। উৎসবের দিন না হয়ে ঈদ এবাদতের দিনে পরিণত হওয়াকে লেখক আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি ‘দুর্ঘটনা’ বলে অভিহিত করেন। তার অভিমত, ‘আসলে ঈদ ঈদই, এবাদত নয়। ঈদের জামাতে দুই রাকাত নামাজের বিধান আছে বলিয়াই ঈদের সমাবেশ প্রার্থনা-সভা হইয়া যায় নাই। … ঐ দুই রাকাত নামাজ আনন্দোৎসবকে এবাদতের পর্ব করিয়া ফেলে নাই।’ এ ব্যাপারে শরিয়তি বিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে লেখক বলেন, ‘বড় জামাতে এবাদত করিবার এমন সুযোগেও শরিয়তে ফরজ নামাজের ব্যবস্থা করা হইল না ঈদের জামাতে। এই বিধান হইতে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় ঈদ পর্বকে এবাদতের অনুষ্ঠান করা শরিয়তের অভিপ্রায় নয়। … এই দিনে আনন্দ-উল্লাস করা বাধ্যতামূলক।’ ঈদের আনন্দোৎসবকে ‘এবাদতের অনুষ্ঠানে’ পরিণত করার ফলে জাতির ‘ঘোরতর লোকসান’ হয়েছে উল্লেখ করে লেখক বলেন, ‘ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, জাতীয় জীবনেও তেমনি, অতিরিক্ত ধার্মিক হওয়া অধর্ম।’ ‘সব ব্যাপারের মতই ধর্মকার্যেও আতিশয্য খারাপ’।
মন ও মস্তিষ্ক উৎফুল্ল রাখার মতো কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যে আমাদের ঈদ-উৎসবে নেই, কেবল খাওয়া-পরার মধ্যে যে ঈদের আনন্দ সীমাবদ্ধ সে কথার উল্লেখ করে আবুল মনসুর আহমদ প্রশ্ন তোলেন, ‘শুধু পোলাও-কোর্মা আর সেমাই-জর্দা- সেমাই-জর্দা আর পোলাও-কোর্মা। এই কি আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি? আমাদের কালচার কি শেষে খানাপিনায় সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িল?’ ঈদের দিনে

ভিক্ষাবৃত্তি কালচারে পরিণত হওয়ারও সমালোচনা করেন তিনি।
আবুল মনসুর আহমদ অতঃপর প্রস্তাব করেন, ঈদ উৎসব দুটিকে একদিনে সমাপ্ত না করে মহরম কিংবা হিন্দুদের দুর্গোৎসব, ক্রিস্টানদের বড়দিন ও বৌদ্ধদের মাঘী পূর্ণিমার মতো একাধিক দিনে ব্যাপ্ত করার। তার এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই, ঈদের আনন্দ সত্যিই দীর্ঘায়িত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি, মেলা ইত্যাদি আয়োজিত হতে পারে ঈদের পরে আরো কয়েক দিনব্যাপী। এক্ষেত্রে ধর্মান্ধতার বাধা টপকাতে হতে পারে। আমাদের কৃষ্টি-সাংস্কৃতির অনেক কিছুকেই বেদাত বলে ফতোয়া দেন ধর্মগুরুদের একটা অংশ। সংগীত সম্পর্কেও তারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ ও প্রচার করেন। মাদ্রাসার বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও নিরীহ কিছু মানুষ এমন প্রচারণায় বিভ্রান্ত। এ প্রসঙ্গে মুসলিম স্বাতস্ত্র্যনীতির পরিপোষক বিশিষ্ট সাংবাদিক, রাজনীতিক, ধর্মবেত্তা ও লেখক মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর ভাষ্য স্মরণ করা যেতে পারে। সংগীত সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা দাবি করিয়া বলিতেছি- ত্রিশপারা কুরআনের মধ্যে এরূপ একটা আয়াতও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না, যাহাতে সংগীতকে নিষিদ্ধ বলিয়া ব্যবস্থা দেয়া হইয়াছে। পক্ষান্তরে হজরত রসুলে করিম সংগীত মাত্রকেই নিষিদ্ধ বা না-জায়েজ বলিয়া আদেশ প্রদান করিয়াছেন- এরূপ একটিও ছহি হাদিস আজ পর্যন্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।’ (তথ্য : মোরশেদ শফিউল হাসান, ঐ)। উল্লেখিত লেখক-গবেষক-চিন্তকগণ তাদের চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কয়েক দশক আগে। বর্তমানে এসব বিষয় নিয়ে মত প্রকাশে নীরবতাই লক্ষ্য করি। যথেষ্ট বিদ্যা-বুদ্ধি-পড়াশোনা থাকার পরও সকলেই নিশ্চুপ থাকছেন। ফলে ফাঁকা মাঠে বিরুদ্ধাচরণ গতি পাচ্ছে। এতে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংস্কৃতিই, জাতির জন্য যা মঙ্গলজনক নয়। সংস্কৃতিবিবর্জিত জাতি বদ্ধ ডোবার বাসিন্দা হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঈদের বাণিজ্যিক ভিত বর্তমানে বেশ শক্ত-পোক্ত। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেনাকাটা বাড়ছে। বাড়ছে মুনাফাকাতরতাও। ঠকাঠকির ঘটনাও ঘটছে। ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্য দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে, হোক। কিন্তু দিন পার হতে না হতেই যে উৎসব ফিকে হয়ে যাচ্ছে সেটিই আপত্তির। নানান অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে ঈদের উৎসব দীর্ঘায়িত ও বৈচিত্র্যঘন হোক- এমনটিই প্রত্যাশিত।

– মজিবর রহমান

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়