ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

চরে সমাধি

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘তুমি মইরা গেলে আমি কেমনে খাইয়া পইরা বাঁচুম? আমার জন্য তো কিচ্চু রাইখা গেলে না। তোমার বউ হয়ে কিছুই পেলাম না।’
‘আমি মইরা গেলে তো দেহটা থাকব। দেহের মাংস কসাইয়ের কাছে বেচবি। ওরা মাংসের ভেত্তর ভেজাল দিয়ে চালিয়ে দেবে। আর তা না পারলে তুই আমার শরীরের মাংস খেয়ে যতদিন বেঁচে থাকতে পারিস ততদিন খাবি।’
খাওয়া-পরা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রায় প্রতিনিয়ত ঝগড়া বাধে। অভাবের সংসার। ওরা চরে বাস করে। স্ত্রী রাহেলা প্রতিবন্ধী। এক পা কাটা। অন্য পায়ে জোর নেই। কোনো মতে লাঠি ভর দিয়ে চলাফেরা করতে পারে। স্বামী রাশেদ যমুনার পূর্বপাড় থেকে নৌকায় উঠে সিরাজগঞ্জ শহরে গিয়ে কাজ করে। একদিন নৌকা থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়। তারও পা ভেঙে যায়। আর কাজে যেতে পারে না। কোনো কোনো দিন একবেলা খেয়ে দিন পার করে তারা। এক পর্যায়ে পায়ে ইনফেকশন হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা নিতে পারে না। বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। যমুনার পাড়ে যেটুকু জায়গা-জমি ছিল, তা বিক্রি করে চিকিৎসা করেছে। সে জন্য নিঃস্ব হয়েছে। সন্তানও নেই তাদের। তাই চরে এসে ঘর তৈরি করে থাকে।
ওরা কাছের আত্মীয়স্বজনের কাজ থেকে ধারদেনা করে চলেছে কিছু দিন। এখন আর কারও কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। একজনের কাছে টাকা আর কতবার চাওয়া যায়। তাদের সংসার আছে।
কষ্ট আর সহ্য না করতে পেরে স্ত্রী রাহেলা তার স্বামীকে বলল, ‘চর থেকে চলো চলে যাই। শহরে যাইয়া ভিক্ষা করুম।’
স্বামী রাশেদ বলল, ‘নিজের শরীর লাশ হয়ে যমুনাতে ভাগিয়ে দিমু। তবু ভিক্ষা করতে যামু না।’
‘আমরা কি তাহলে চরে না খেয়েই মরে যামু?’
‘প্রয়োজনে তাই করুম। আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি পড়বে। সে পানি খামু। আর যমুনা থেকে মাছ ধরুম। চরে শাকপাতা যা হয় তা দিয়ে জ¦ালিয়ে খামু। আমাদের তো আর জি¦বার সুস্বাদ গ্রহণ করার দরকার নেই। পেট ভরলেই হয়।’
ওদের অসুস্থ শরীর। বেঁচে থাকার স্বপ্ন তাদের নেই। তবুও এই চরের মায়ায় পড়ে আছে। যমুনার পানি বৃদ্ধি পেলে ওরা কী করবে। হয়তো ভেবে দেখেছে, যমুনার পানিতে সমাধি হয়ে যাবে।
হঠাৎ একটা শিশুর কান্নার শব্দ পেল রাহেলা। এদিকওদিক তাকায় কিন্তু কোনো শিশু দেখতে পায় না। তবুও সে লাঠি ভর করে এদিকওদিক তাকায় দেখা মেলে না। কিন্তু কান্নার শব্দ সে শুনতে পায় ঠিকই। সে নিশ্চিত হয় এটা শিশুর কান্না। এদিয়ে যেতে থাকে। রাহেলা ভাবে, আল্লাহ আমার গর্ভে সন্তান দেয়নি। হয়তো আল্লাহ দেবদূত পাঠিয়েছেন আমার কাছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারি না। ওকে রেখে কি খাওয়াব!
রাহেলার এদিয়ে যাওয়া দেখে রাশেদ এগিয়ে আসে। বলল, ‘কোনো পাশে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছ।’
‘উত্তর পাশে।’
‘চলো এগিয়ে যাই।’
ওরা এগিয়ে যেতে থাকে। গিয়ে দেখে শিশু না। একটা শিয়াল আঘাত পেয়ে শিশুর মতো করে কান্না করে ডাকছে। শিয়াল দেখা মাত্র রাহেলার মা ডাক শোনোর স্বপ্ন দেখছিল। সেটা আর পূরণ হলো না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। পানি চরের বালির ভেতর পড়া মাত্র শুষে নিল। কিন্তু যমুনার পানির মতো চলমান দুঃখবেদনার কষ্ট তার দেহ সব সময় চলমান। তার চোখের পানির মুহূর্তে চরের বালি যেমন শুষে নিল, ঠিক তেমনি যদি তার জীবনের কষ্টের মুহূর্ত চলে যেত, তাহলে তো জীবন আনন্দময় থাকত সব সময়।
স্ত্রীর চুপচাপ থাকা দেখে রাশেদ বলল, ‘তোমার আমার স্বপ্ন আর এই জীবনে পূরণ হবে না। জীবন থেকে সব আশা পূরণ হওয়ার কথা বাদ দাও। এই শিয়াল আমাদের মাংস খাবে কিনা, সেই চিন্তায় আছি। কৌশলে কি শিয়াল আমাদের ডেকে নিয়ে এলো। চলে এখন থেকে চলে যাই। ওরা পণ্ডিত। ওরা কিন্তু দলবল নিয়ে এসে হাজির হতে পারে। আমাদের খাওয়ার জন্য।’
স্ত্রী বলল, ‘কী সব বল।’
‘হ্যাঁ। চর দখলের একদল আরের দলের ওপরে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠিক সেভাবে শিয়াল আমাদের উপরে ঝাপিয়ে পড়বে। চলো তো।’
‘তাই কী! শিয়াল তো আহত।’
‘আর রে কইলাম না। আঘাতপ্রাপ্ত শিয়াল দিয়ে আমাদের এখানে ডেকে নিয়ে এসেছে। তারপর দলবল নিয়ে এসে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। চলো তাড়াতাড়ি সরে যাই।’
অনেক সময় পর রাহেলা বলল, ‘শিয়াল তো আমাদের কাছ থেকে চলে যাচ্ছে না। ভয়ে তো আমাদের কাছ থেকে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু যাচ্ছে না কেন? নাকি আমরা যেন তার সেবাযতœ দিয়ে সারিয়ে তুলি সেজন্য।’
‘না না। চলো তো এত কিছু ভাবার সময় নেই। আগে নিজেরা বাঁচার জন্য সতর্ক থাকি। চলো।’ এই বলে রাহেলার হাতে ধরে টেনে নিয়ে আসতে লাগল। শিয়াল আর রাহেলার দিকে তাকিয়ে থাকল। রাহেলাও তার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওরা ঘরের দিকে আসতে লাগল।
কিছু দূর আসার পর ওদের মাথার উপরে দিয়ে এক ঝাক কাক কা কা কা করে উড়ে বেড়াচ্ছে। কাক উড়া দেখে রাহেলা বলল, ‘কাক উড়াতো ভালো না। অশুভ সংকেত। আমাদের কী বড় কোনো বিপদ হবে, সে সংকেত পাচ্ছি কিন্তু!’
‘এত কিছু ভেবে না তো। আকাশও তো মেঘলা। বৃষ্টি নামতে পারে। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকি।’
‘চলো।’
টিপটিপ বৃষ্টি পড়তে লাগল। ধীরে ধীরে বাতাসের গতি বাড়তে লাগল। ওরা কিছু দূর আসা মাত্র ঝড়ের গতি বেড়ে গেল। ঝড়ের গতি এতই বাড়ল যে রাশেদের হাত থেকে রাহেলা ছুটে গেল। রাহেলা একদিকে পড়ে গড়তে গড়তে চলে গেল। আর রাশেদ অন্যদিকে। রাহেলা চরের আগাছা ধরে রইল। কিন্তু রাশেদের হাত আর পায়ে সমস্যা থাকার জন্য ঝড় মোকাবিলা করার মতো শক্তি সে পায়নি। তাই সে গড়তে গড়তে যমুনার ভেতরে চলে গেল। আর ফিরতে পারল না তীরে। রাশেদের হয়ে গেল সলিল সমাধি।
আইলা, আম্ফান, অশনি ঘূর্ণিঝড়ের স্বজনদের কথা মনে করে রাহেলা রাশেদকে চরের ভেতরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোনো চিহ্ন পেল না। এখন রাহেলা ভাবছে- রাশেদ ছাড়া তার জীবনে আর কী কী ঘটবে!

– রণজিৎ সরকার

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়