ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

রবি ঠাকুরের কলকাতা ভ্রমণ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নাহ। ল্যান্ডিংটা ঠিকমতো হলো না। আমি রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবি রবি ঠাকুর। মর্ত্যে মানে পৃথিবীতে আসব ঠিক করেছিলাম, তাও জোড়াসাঁকোতে। এ যে কোথায় নামাল স্বর্গযানটা! তবে কলকাতায় নামিয়েছে বুঝতে পারছি। বিহারীলালটা প্রোগ্রামে শিওর ভাইরাস ঢুকিয়েছে।
– ও ভাই এই জায়গাটার নাম কী গো?
– চোরবাগান। কেন দাদু, লাইনে নতুন নাকি?
– লাইনে? মানে? কিসের লাইনে?
– চুরির লাইন। চুরি করে মালটা বেচবেন কোথায়? এই চোরবাগান ছাড়া?
– ওহ, এটা চোরবাগান! জোড়াসাঁকোর কাছেই তো।
– ঠিক দাদু, পাশেই জোড়াসাঁকো। তা চুরির লাইনে শুরু করলেন কোথা থেকে?
– ভাই, লাইন যখন চুরি করার ছিল তখন অনেক করেছি। লালন ফকিরের লাইন, হরু ঠাকুরের লাইন, দাসু রায়ের লাইন, এমনকি এক আইরিশ কবির লাইন। তবে একটু পাল্টে দিয়েছিলাম আর কি? কেউ ধরতেই পারেনি।
– বাপ রে! রেলের লাইন ছাড়া দু-এক পিস ট্রামের লাইন চুরি যায় শুনেছি। কিন্তু এতো মানুষের লাইন। তা এদের লোহার লাইন চুরি করলেন কী করে?
– হুঁ হুঁ বাবা, এ চুরি সে চুরি নয়। সিমলে পাড়ার হরু ঠাকুর ১৭৭২ সালে লিখেছিলেন-
যাদু এতো বড়ো রঙ্গ যাদু এতো বড়ো রঙ্গ
চার কালো দেখতে পারো যাবো তোমার সঙ্গ
কাক কালো, কোকিল, কালো কালো ফিঙের বেশ
তাহার অধিক কালো কন্যে, তোমার মাথার কেশ।
– তা দাদু এটাকে ঝাড়লেন কী করে?
– ১৯১৭ সালে ‘রঙ্গ’ বলে কবিতাটা লিখলাম-
এত বড়ো রঙ্গ যাদু এতো বড়ো রঙ্গ
চার মিঠে দেখাতে পারো, যাবো তোমার সঙ্গ
বরফি মিঠে, জিলাবি মিঠে, মিঠে সোনপাপড়ি
তাহার অধিক মিঠে কন্যা, কোমল হাতের চাপড়ি।
– এতো হুবহু ঝাড়া কবিতা। পাবলিক ধরতে পারেনি?
– দূর, অরিজিনালের সাথে একটা-দুটো ঝাড়া মাল চালিয়ে দিয়েছি। কে ধরবে? খাদ ছাড়া সোনার আংটি হয়?
– আর ওই লালন ফকির না কার নাম বললে- ওর থেকে কী ঝাড়লে?
– ওটা বাধ্য হয়ে ঝেড়েছি। ‘ডাকঘর’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী। আমি বাউল হয়ে দৃশ্যগুলোর ফাঁকে ফাঁকে গান গাইছি। হঠাৎ মনে হলো গানগুলো ঠিক হচ্ছে না। কী করি? হঠাৎ লালনের শিষ্য গগন হরকরার গানটা মনে হলো-
তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর পেলাম না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
তখন সেই সুরে গেয়ে দিলাম- ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে…
– বাঃ এতো কেতায় ঝাড়া। কিন্তু দাদু, তোমার থেকে কেউ ঝাড়েনি?
– ঝাড়েনি আবার! জীবনানন্দ যাকে নিয়ে তোরা এখন নাচিস। সে হঠাৎ লিখে ফেলল-
মহামৈত্রীর বরদতীর্থে, পুণ্য ভারতপুরে
পূজার ঘণ্টা মিশেছে হরষে নামাজের সুরে সুরে।
এতো পুরো আমার হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থ জাগো রে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে কবিতার ক্যারিকেচার।
হঠাৎই শুনলাম কে যেন আমার নাম রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ বিড়বিড় করতে করতে সামনে দিয়ে যাচ্ছে।
– ও মশায়, রবীন্দ্রনাথের কী হয়েছে? তাকে গাল পাড়তে পাড়তে যাচ্ছেন যে বড়?
– গাল দেব না? হতচ্ছাড়া যে কেন এত লিখতে গেছে আর আমাদের হয়েছে মুশকিল। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। আপনি…
– আমি নিবারণ চক্রবর্তী। কবি। শেষের কবিতায় পড়েননি?
– তা হবে। অতো মনে থাকে না। আমি মরছি নিজের জ¦ালায়। মাস্টারি করতে করতে তো অনেক দিন গাধা হয়ে গেছি। এখন সেই গাধার পিঠে চড়িয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমাদের স্কুলে একটা কাব্য রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিলাম। বিষয়- বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ।
– তাহলে গোল বাধলো কোথায়?
– গোল বাধলো যখন আমার ছাত্ররা রচনাগুলো জমা দিলো। কী করে যে এগুলো বিচারের জন্য পাঠাই। স্কুল ইন্সপেক্টর মশাই আবার বিচারক। তেল দিতে হেড স্যার তাকে বিচারক করেছেন। কিন্তু এই লেখা তার কাছে পাঠালে চাকরি নট। কী লিখেছে শুনবেন? শুনুন তবে এক হতচ্ছাড়া লিখেছে-
ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি
আছে আমাদের পাড়া খানি
পার্ক তার মাঝখানটিতে
জমে ক্ষীর গ্রীষ্মে বা শীতে
তার পাশে সরু গলি বেয়ে
চ্যাট করে যত ছেলে মেয়ে
ঠেকে বসে কানাই বলাই
ভরপুর বেচিছে চোলাই
বড়বাবু এসে গান গায়
আমার ভাগটা নিয়ে আয়।
– এটা যদি বর্তমান প্রেক্ষিত হয়। তাহলে দোষ কোথায়? ভালোই তো লিখেছে।
– ভালো লিখেছে? এটা পাঠালে আমার বাঁশ, আর স্কুলের সর্বনাশ। আরো আছে, আর একটা শুনুন-
শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে
নেতা বলিলেন জমিটা তো দেন- আমাকে সবাই চেনে
কহিলাম আমি- ও আমার জমি, ধান বুনে বেচে খাই
মাটি মোর মা, কাটো হাত পা, জমি বেচবক নাই
আখি করি লাল, দাদা ক্ষণ কাল চলিয়া গেলেন হাটে
পরদিন মেয়ে তাপসী মালিক মরে পড়েছিলো মাঠে।
– ভালোই তো লিখেছে।
– কী বলছেন? কী ভয়ংকর পলিটিক্যাল কবিতা। আপনি বিপজ্জনক লোক। এবার আপনিও বরং এগোন।
– আমি তো থামি না। আমি এগিয়ে যাই।
একটু এগোতেই কানে এল স্খলিত কণ্ঠ-
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া
সঙ্গীরা সব গিয়াছে দেশীর চক্করে
আমার সঙ্গে আছে শুধু আজ ছামিয়া।
– কে রে? ভুলভাল রবীন্দ্রনাথ আওড়াচ্ছিস?
– আমি ওস্তাদ। রবি ঠাকুরের সাথে হিসাবই আছে হাফ তুমি নিট আর হাফ আমি সোডা।

– মাল খেয়েও রবীন্দ্রনাথ?
– কেন গুরু তো আগেই বলেছিল-
দেশে অন্ন জলের হলো ঘোর অনটন
ধরো হুইস্কি সোডা আর মুরগি মাটন… ব্যাস। গুরুর আদেশ শিরোধার্য। ধরে ফেলেছি।
– তা ভালো। আচ্ছা এই যে নেশা করছিস, রবি ঠাকুর আউরাচ্ছিস, সন্ধে হলেই এখানে জুটছিস। বউ কিছু বলে না?
– আমি পালিয়ে বেড়াই দৃষ্টি এড়াই যায় না মোরে বাঁধা। বউ ফউ নেই গো। একা মানুষ। ধুসস, দিলে তো নেশাটা কাটিয়ে। রবি ঠাকুর মানেই নেশা। কেন যে ওল্ড মঙ্ক রবি ঠাকুরকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করে না?
– উঠি ভাই। আর কিছুক্ষণ থাকলে তুই আমাকে মদের বিজ্ঞাপনে নামিয়ে দিবি।
– তুমি নামলে মন্দ হতো না। ক্যাপশন হতো- মধুর, তোমার শেষ যে না পাই।
একটু এগোতেই দেখি একা নারীমূর্তি। বড় চেনা। বহুকালের। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
– কে? কে যায়? রানু?
– না আমি বন্যা। লাবণ্য। অবশ্য চাইলে তুমি আমায় রানুও বলে ডাকতে পারো।
– ও। তুমি জানো আমি কে?
– ও মা কেন জানবো না! তুমি অমিত। অমিত রায়। রানুর আবশ্য ভানুদাদা।
– তুমি তোমার নাম কী বললে? লাবণ্য। মানে শেষের কবিতার লাবণ্য? লাবণ্য দত্ত? বাবার নাম অবিনাশ দত্ত?
– একেবারে ঠিক।
– তা তুমি এখানে কেন? উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এলে কেন?
– তোমায় ধরতে। বহুদিন তক্কে তক্কে ছিলাম।
– কেন? আমি আবার কী করলাম?
– কী করলাম? তুমি তো দেখি ন্যাকামির নিত্যানন্দ। আমার সাথে চুটিয়ে মিশছ দুই বছর ভুলে গেছ?
– আমি কোথায়? সে তো অমিত রয়।
– আবার ভক্কি। তুমি বলনি আমায়-
বন্যা, তুমি বয়সেতে ছোটই হবে বোধ করি
আর আমি তো পরমায়ুর ষাট দিয়েছি শোধ করি
তোমায় দেখে মনটা আমার পূর্ণ হলো উৎসাহে
মনে হলো বৃদ্ধ আমি মন্দ লোকের কুৎসা এ।
– ধ্যাৎ। ওটা ভানুদাদা রানুকে বলেছিল। অমিত রায় মোটেই লাবণ্যকে বলেনি।
– তুমি তো দেখছি পাল্টাওনি একফোঁটা। কখনো ভানুদাদা, কখনো অমিত রায়, কখনো নিবারণ চক্রবর্তী। পাক্কা ঢপবাজ। যাক গে শোনো। যে কারণে তোমার পিছু নিয়েছি। উপন্যাসের পাতায় থাকতে থাকতে, মোহনলালের সংসার করতে করতে বোর হয়ে গেছি। সাধারণ হয়ে থাকা আর পোষাচ্ছে না। চারদিকে কত শপিং মল, বেশ কিছু ভালো ঝাক্কাস ড্রেস কিনতে হবে, সানগøাস, ভালো রেস্তোরাঁয় থেতে হবে। ডিস্কে যেতে হবে, খরচ অনেক। কিছু মালকড়ি ছাড়।
– আমি? আমার পয়সা কোথায়?
– কেন, নোবেল প্রাইজ পেলে, ষাট বছর ধরে তোমার গান, বই- সব কিছুর কপিরাইট…
– নোবেল চুরি হয়ে গেছে। সিআইডি কেসটা নিচ্ছে সিবিআইয়ের থেকে। এক পয়সাও নেই আমার। অ্যাপ্লাই করব সরকারের কাছে। ততদিন…
– ততদিন তুমি স্ট্যাচু হয়ে থাকো।
আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুহূর্তে ময়দানে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম।

– অমিত গোস্বামী

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়