ডায়েট ভুলে জমিয়ে খান নুসরাত

আগের সংবাদ

অভিযানে কোণঠাসা কেএনএফ

পরের সংবাদ

ভর-জোছনায় হুমায়ূন আহমেদের সাথে

প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে দেওয়ের মতো বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আচড়ে পড়ছে বেড়িবাঁধের শরীরে। বেড়িবাঁধের রোগা শরীর কাহাতক সইবে এসব! সে তো আর বলতে পারে না- ফি বছর মেরামত করা লাগবে; তার নামে আসা বরাদ্দের পুরোটা তাকে দিতে হবে! এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান এমনকি এমপি মহোদয়, কেউ বাদ যায়নি এই বেড়িবাঁধের লোকদেখানো রাজনীতি থেকে। ভোটের তরী পার হলে যে লাউ সে কদু; কেউ মুখ তুলে চায় না তার দিকে। অবশ্য প্রজেক্ট আসাতে তার পাড়ের রোশনাই বেড়েছে, বদলে গেছে তার শান-শওকত। বেড়িবাঁধের পাড়ে বসে তার কাশি শুনি আমরা। ঢেউয়ের সাথে ভর পূর্ণিমায় ভেসে চলছে আমাদের বিরহী হৃদয়। ডলার, সফি, কুদরত, মন্ত্রী ও আমি কোরাস ধরি- ওরে নীল দরিয়া… নিজেদের কণ্ঠের জোর যা-ই থাক না কেন সমুখে পাওয়া বঙ্গোপসাগরের জল আরো উতলা হচ্ছে তরুণদের গায়কী দেখে। আমাদের দৃষ্টি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার কালে খুব দূর থেকে, অনেক দূর থেকে কুতুবদিয়ার বৃক্ষরাজি অতি চিকন রশির রূপ ধরে নজরে গোছর হওয়ার ধান্ধা করে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতা চলে জোছনার সৌন্দর্যের। আমাদের চোখ ঝলসে যায়, বুক ভেঙে যায় এমন রূপের বাহারে- যেনবা মলকা বানুর সই হয়ে মায়া ছড়াচ্ছে জোছনারা।
মোবাইলে দেখা যাচ্ছে এগারোটা পঞ্চান্ন; বয়সি রাতে কেন আমরা জনা পাঁচেক তরুণ বঙ্গোপসাগরের কোলে গান ধরছি কেউ এ-প্রশ্ন তুললে অন্যায্য হবে না। আমরা জানি, রাত ঘুমের জন্য; সুতরাং গানটান ধরে কারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো রীতিমতো অন্যায়। কিন্তু অন্য সময় হলে কি এখানে এভাবে বসা যেত? অন্তত পাঁচ-সাতবার পড়া লাগতো গেরস্তি কুত্তার কবলে। গন্ধ শুঁকে চিনলে ভিন্ন কথা, না হয় বিরাট ঝামেলা। শোনা যায়, অত্র এলাকায় নয় শুধু জলসুন্দর খালের ওপাড়ের এলাকাগুলোও এখন কুকুরশূন্য। প্রজেক্টের বৈদেশিদের কাছে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে সব কুকুর। ইউটিউবে চায়নিজদের সাপ-খোপ খাওয়ার ভিডিও দেখে এক সময় বমিতে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছিল মা-বোনেরা। এসবও খায় মানুষ, নাউজুবিল্লাহ! আশ্চর্য, বৈদেশিদের সাথে ওঠাবসা এমনকি কুত্তা সাপ্লাই দেয়া দেশি লোকদের সাথে বসলেও কারো বমি পায় না এখন। আরো শোনা যায়, কুকুরের পর সাপ-খোপও নাকি তারা হিসেবে নিয়েছে। বন্ধু ডলারের উসকানি আমাদের নিয়ে আসে শায়েস্তাপুরের কুকুরহীন এই উপকূলে! ডলার আবার মানুষের নাম হয় কেমন করে? এমন প্রশ্ন আমরাও করেছি ছোটকালে। কিন্তু তার মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী বাবার দিলে ‘ডলার’ শব্দটা কেন স্থায়ী জায়গা করে নিয়ে নিজের ছেলের উপর সোয়ার করলো তা কে জানে! আরো মজার বিষয় ডলারের ছোট ভাইয়ের নাম দিনার। এই ডলারই বললো, চল, ভর-জোছনায় গ্রামে যাই। চারদিকে কলকারখানার উৎপাদনমুখী শব্দবান আর জৌলুসে কে বলবে এটা গ্রাম ছিল? আমরা আসলে এই অতীত গ্রামেরই সন্তান। বিগত-যৌবনা নারী যেমন বলে লোকে তেমনি এই আমাদের বিগত-গ্রাম। জোছনার সাথে বোঝাপড়া করতে, নাড়িপোতা মাটির গন্ধ নিতে ডলারের প্রস্তাবের সাথে রাজি না হয়ে পারি না আমরা। আমাদের জন্মঘ্রাণ, আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস এই নোনা হাওয়ায় নিয়ে আসে বারবার।
মনে পড়ে, বছর দশেক আগে, গ্রামের লোকদের ভেতর শুরু হয়ে যায় একটা ঘোর উত্তেজনা। পুকুরে স্বর্ণ কি বউয়ের জেওর হারিয়ে গেলে যেভাবে পাগল হয়ে খোঁজে লোকে, তারচেয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে খোঁজাখুঁজি করছে জমির দলিল, দাগ-খতিয়ান। ঘটনা কী? আচাম্বিক জমি নিয়ে এমন তোলপাড়ে উত্তর-দক্ষিণ না-ভেবে সমানে যুক্ত হতে থাকে এলাকার যুবা-বুড়ো। পার্শ্ববর্তী দুই উপকূলীয় ইউনিয়ন, যেখানে সকাল হতো মাছের পোনা গুনে কি মাঠের লবণ ওজন করে সেখানে নয়া টসা দিন দিন ছিনালি শুরু করে। উপজেলা রেজিস্ট্রি অফিস আর সোনাখালী ইউনিয়নের প্রজেক্ট অফিস লোকে গমগম। সফির বাবা, কুদরতের বাবা, সবার মতো আমার বাবাও একদিন সিল ছাপ্পর মেরে বাপ-দাদার জমি লিখে দেয় প্রজেক্ট অফিসে গিয়ে। যেই জমি গন্ডা বিশ-ত্রিশ হাজার বিকোয় কিনা সন্দেহ ছিল তা একেবারে দুই-তিন লাখের উচে! হঠাৎ পাওয়া আলাদিনে দুই ইউনিয়নের লোকের মাথা নষ্ট অবস্থা। বেচো আর বেচো। ভাগ্যক্রমে হাজার দশেক টাকা হাতে এলে যেই মানুষ মুখের থুথু বারকয়েক হাতে লাগিয়েও গুনতে ভুল করতো, সেই তেনারা কোটি টাকার এফডিআর করে ব্যাংকে! পরনে লুঙ্গির বদলে জায়গা নেয়া প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখে আস্ত চেক বই আর জমির দলিল। মনে মনে জপে, এই কাঁচা টাকা সবসময় আসে না মনা; এই সুযোগে উপজেলায় জায়গা ধরো, শহরে ফ্ল্যাট কেনো, পোলা বিদেশ পাঠাও। প্রজেক্টয়লারা আগেই ক্যানভাস করে দেয়, ভাইসব, ভাইসব, অত্র এলাকায় হতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল; যদি ভাগ্য বদলাতে চান, যদি নিজেকে দেখতে চান সম্মানী এলাকায়, যদি চান সরকারকে উন্নয়নে সাহায্য করবেন তবে আজই আসুন প্রজেক্ট অফিসে… ভাইসব… ভাবনায় বসা বয়স্করা বলে, অ-পথ পথ হবে, অ-মানুষ ফেরেশতা হবে। কী সব দেখছি আজকাল! একটু সচেতনেরা ভাবে, আসলেই তো, আমাদের এলাকার দুর্নাম আছে, আমাদের দারিদ্র্য আছে, এই সুযোগে বদলা নিতে হবে, বদলা।
কিছুদিন পরে দেখা যায় বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে শাঁ শাঁ করে উপকূলে ভিড়ছে ছোট ছোট জাহাজ। জাহাজের মতো আশ্চর্য বাহন দেখার সাথে সাথে এলাকাবাসী জানে কবে যেন রাতের আঁধারে তৈরি হয়ে যায় বিশাল এক জেটি বেড়িবাঁধের শরীর চেপে। এক কালে দেওয়ের খনন করা বড় দিঘি আর জিনের বানানো মসজিদের মতো ঘটনার সাথে জেটিকে না মেলালেও এই কথায় সবাই কবুল করে যে, টাকার পাওয়ার কয়েক হাজার দেও-জিনের চেয়ে কম নয় কিছু! সদরের রাস্তা ধরে রাতের নীরবতা ভেঙে সমান তালে ঢুকছে ট্রাকের পর ট্রাক। ততোদিনে দুই ইউনিয়নের বেশির ভাগ বাড়ি-ঘর হাওয়া। উপজেলায় বাসা হয়েছে কারো, শহরে ফ্ল্যাট নিয়েছে কেউ, কেউবা অন্যত্র গড়েছে বসতি। যারা নোনা পানিতে তাজা সুরুজের গরম নিয়ে ফলাতো লবণ, যারা মাছ আর মাছের পোনায় নিজেদের ভাগ্য দেখতে পেতো এমনকি যারা অন্যের মাছবাহী ট্রলারকে অস্ত্রের জোরে নিজের মনে করতো, তারা কেউ এখন পাতার বিড়ি ফুঁকে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে যায় না গন্তব্যে। তাদের ছেলেরা বাইকে ঘুরে, কেউবা নিয়েছে চার চাক্কার বাহন। এত সহজে কি আর প্রজেক্টয়লা গেড়ে বসতে পারে? চেয়ারম্যানের ইশারায় হামলা কিছু কম হয়নি, পড়েছে গণ্ডাখানেক লাশও। বড় বড় লেকচার দিয়েছেন চেয়ারম্যান। শোনা যায়, এই প্রজেক্টে মাথা দিয়েছেন খোদ বড় বড় মন্ত্রীরা, স্থানীয় এমপি সাহেবরে দেয়া হয়েছে বিশাল দায়িত্ব। চেয়ারম্যান চালাক মানুষ, জানে একটু গাইগুই না করলে রাজনীতির মাঠে দাঁড়ানো মুশকিল। নিজের ইউনিয়নে যদি কিছু হেডম না দেখায় ইজ্জত বাঁচানো দায়। উল্টা-সিধা কথা সম্মানীর প্যাকেট বড় করেছে, মাথা করেছে ঠাণ্ডা। প্রতি মাসে নিয়মিত পান-পকেট খরচ। চেয়াম্যানেরা আত্মীয়েরাই যাবতীয় কাঁচামাল সাপ্লাই দেয়। আর যারা ছিল চালাক গোষ্ঠীর সব জমি বিক্রি করে ভরেছে নিজের পকেট। কেউবা অহেতুক জলা-জমিতে ছোট্ট ঘর তুলে বাড়িয়ে নিয়েছে ক্ষতিপূরণের টাকা। প্রজেক্টয়লারা ঝানু মাল, দুনিয়াদারি বুঝে। তারচেয়ে বেশি বুঝদার প্রজেক্টের হোমরা-ছোমরারা। চা খরচ দাও আগে, তারপর দলিল দেখবে। এসব ভাবতে ভাবতে সাগরের দিকে তাকাই। কলিজা পচে গন্ধ বের হয়, টের পাই আমরা।
উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বিশাল বিশাল কারখানা দেখে কে বলবে এখানে এক সময় ঘরবাড়ি ছিল? ওই তো, চোঙ্গাটা, ওই। ওটা দিয়ে যখন বানের জলের মতো ধোঁয়া বের হয়ে আকাশে ছড়িয়ে যায় তখন অনেক দূর থেকে দেখা যায়। হে, ওটাই পাওয়ার প্ল্যান্টের নিদর্শন। এই চোঙ্গাটা যখন জিরাপের মতো গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি অতীত করে তখন আশপাশের অনেকেই টের পায় প্রজেক্টয়লারা মিথ্যে বলেছে। বলেছে ইকোনমিক্স জোন হতেছে চোঙ্গা! অবশ্য এটা নিয়ে তেমন কথা বাড়ায়নি লোকেরা। তারা কি আর এখানে থাকবে? এলাকাবাসী টাকা পেয়ে, নিজেদের বিক্রি করে দিয়ে জাতে ওঠার আনন্দে বিভোর। যাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে আর যাদের মেয়ে ঘরে নিতে ছিল ঘোর আপত্তি এখন কাঁচা টাকার জোরে তাদের সাথে আত্মীয়তা করছে গণ্যমান্য লোকেরা। উপকূলীয় খাসলতে যারা কথায় কথায় চালাতো চাকু, মুখে ঝরতো অশ্রাব্য গালিগালাজ তাদের গায়ে ফিনফিনে পাতলা পাঞ্জাবি দেখে কে বলতে যাবে ওরা অশিক্ষিত ডাকাতের দল? এই প্রজেক্ট তাদের যা দিয়েছে এরচেয়ে বেশি আর কী লাগে মানুষের জীবনে, এ্যা?
গানের তোড়ে ভেসে যাওয়া সময়ে সিগারেট চলছে সমানে। কার প্রেম ভেঙেছে, কার প্রেমিকা অন্য পুরুষের সাথে গিয়েছে কক্সবাজার

ইত্যাদি আলাপের সাথে চলে কীভাবে মরিচের দাম হয়ে গেল কেজি ছয়শ টাকা। গানের ফাঁকে ঢুকে যাচ্ছে কবিতা, কবিতার ভেতর কোরিয়ান রক, তার পেছনে ভাণ্ডারী গান। এলোমেলো পঞ্চ পাণ্ডবের দিশাহীন স্রোতে হঠাৎ পূর্ব দিকে তাকিয়ে চিক্কার দিয়ে ওঠে কুদরত। এই, দেখ… দেখ তোরা… কী হইছে? ডলারের প্রশ্ন। দেখ না তোরা… ধ্যান ভেঙে চোখে সর্ষে দেখার মতো লাফিয়ে উঠি আমরা। কী এসব? পূর্ব দিকে সারি সারি স্থাপনা কোথায়? আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, পূর্ব দিকে কোনো কারখানা নাই। উত্তরে দেখি, তাও নাই। বুকের ভেতর কাঁপন ধরে আমাদের। মুহূর্তেই সাহসের সব কটা বেলুন ফুটো হয়ে গেছে যেন বা। জোছনার আলোয় একদম ক্লিয়ার দেখা যায়, সারি সারি কবর। না, আমরা তো বেশরিয়তী পানিটানি খাইনি, তাহলে? মন্ত্রী প্রস্তাব করে, দোয়া-দরুদ পড়া শুরু কর, দোস্ত। জোরে জোরে দোয়া পড়লে বদ কিছু থাকে না! আরে এই উপকূল হয়ে আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, এখানকার অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে জিডিপি, এখানে কর্মরত আছে হাজারে হাজার নারী-পুরুষ। এত বছর পর, এখানে কবর আসবে কোত্থেকে? জানোস না, পূর্বপুরুষদের কবরের উপরেই এইসব কারখানা? খেকিয়ে ওঠে সফি। মুহূর্তের আকস্মিকতায় আমরা বোবা। ভাবনার সমস্ত দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে কেউবা। হ্যাঁ, মনে পড়ে, ওই পূর্ব দিকে, ওই দক্ষিণ দিকে, ওই উত্তর দিকে ছিল ঘন বসতি। এইসব বসতির ভেতর থেকে উঠে এসেছি আমরা। জন্মের সময় পোতা নাভিরা যেন লাইন ধরে মিছিল শুরু করছে। তারা রাগে রক্তিম, ক্রোধে মারমুখী। পাঁচ যুবক নজর রাখি উত্তর দিকে, পূর্ব দিকে, দক্ষিণ দিকে। স্পষ্ট দেখা যায় সারি সারি কবর হাঁটাহাঁটি করছে। সাথে অজস্র বৃক্ষ। হাঁটার গতি বাড়িয়ে তারা সমবেতভাবে আমাদের দিকে আসছে। মন্ত্রী বলে, কী দেখলি, পালা দোস্ত।
প্রাণ হাতে নিয়ে কতক্ষণ দৌড়ছি পাঁচ যুবক মনে নাই। বড় বড় নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে আমাদের। বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে সমানে। দম বন্ধ হবার জোগাড়। পানির তৃষ্ণায় ছাতি ফাটা অবস্থা। গাড়ি, গাড়ি কই? সফির হুঁশ ফিরে আসে। ততক্ষণে আমরা ঘাটখালির মুখে। দরিয়ার দিক থেকে ফিরছে মাছ-মারা ট্রলার। একেকটা ট্রলার আসে আর নতুনভাবে জেগে ওঠে ঘাটখালী। সমুদ্র থেকে আসা ফ্রেশ মাছেদের অন্যরকম গন্ধে ভরে গেছে পুরো ঘাট। হৈহৈ করে ওঠে জেলেরা। বরফ ভাঙে, মাছ ওজন করে, দাম হাঁকে। ঘাটের কারবার টানে না আমাদের। প্রাণ নিয়ে যুদ্ধ সেখানে আবার ঘাট! পরস্পরের দিকে অবাক তাকিয়ে প্রশ্ন করি, গাড়ি কই? আমরা তো চার চাকার গাড়ি নিয়ে আসছি! ডলারই বলে, যেই গাড়ি কেনা হইছে ওই ভিটা বেচা টাকা দিয়ে, সেই অভিশপ্ত গাড়িরে ওই মাটি গিলে খাইছে। বড় বাঁচান বাঁচাইছে আল্লাহ। চল, এভাবে রাত খেয়ে ফেলে লাভ নেই। চল, বাসায় ফিরে যাই। এত রাতে গাড়ি কই পাবা মিয়ারা, জোছনা ধরে চল হাঁটা দেই, কুদরতের প্রস্তাব। রাতের বয়স তখন একটার ঘর পার হয়েছে। জোছনার বৈভবের সাথে দক্ষিণ দিক থেকে যুক্ত হয়েছে লোনা হাওয়া। একটা চোরা-মনোকষ্ট আমাদের খুড়ে খুড়ে খাচ্ছে নীরবে। পরস্পরের মুখ দেখাদেখি করি কিন্তু বের হয় না কোনো কথা। জনমানবহীন রাস্তায় নেই সাড়া-শব্দ। হাঁটতে বেশ আরাম লাগছে। কিছুক্ষণ আগে আধঘণ্টার মতো যম-দৌড়ানি হয়েছে এটা একদম ভুলে গেছি। পুনঃজন্মের আনন্দ নিয়ে হাঁটছি আমরা। কিছু দূর যেতেই দেখি আগে আগে হাঁটছে এক ভদ্রলোক। হালকা গঠনের, চোখে চশমা। আবার কোন ভূতের পাল্লায় পড়লাম আমরা, সফির জিজ্ঞাসা। মন্ত্রী এবার যথাযথ মন্ত্রীর মতোই বলে, আরে পাঁচ তাগদা জোয়ানের সামনে ভূত পড়তে ভয় পাবে না! শালার ভূতটূত সব এক লাত্থিতে কিক। সমস্বরে হেসে ওঠি। ভদ্রলোক পেছনে তাকান। কুদরত বলে, আরে উনারে চিনছি! আমাদের হাসির মাত্রা আরো চড়া হওয়ার উপলক্ষ পেয়ে যায়।
ভদ্রলোককে কুদরত চিনেছে সত্য। ভদ্রলোক বলেছেন, তিনি জোছনা দেখতে এসেছেন এই উপকূলে। কিন্তু ইকোনমিক জোনের কাছাকাছি যেতে তাকেও দৌড়ানি দিয়েছে দলবদ্ধ কবর, সংক্ষুব্ধ বৃক্ষরা। কুদরত বুকে হাত দিয়ে দেখে, ভদ্রলোকের বুকেও তড়পড়ানির ঢেউ, যথেষ্ট দৌড়ছেন বুড়া বয়সে। আলাপ-আলোচনা চলে আমাদের ভেতর। মন্ত্রী কিন্তু এত কথার ভেতরেও ইজি হতে পারে না। সন্দেহজনক ভাব নিয়ে থাকান ভদ্রলোকের দিকে। কথা শুনে মনে হয় উনি এলাকার লোক নয়। কোন মতলবে এখানে এসেছেন তিনি? গোয়েন্দা নাকি? নাকি বৈদেশি এজেন্ট? দেশ নিয়ে আজকাল দেশের জনগণের চেয়ে বেশি ভাবে বৈদেশিরা! মন্ত্রী খেয়াল করে, ভদ্রলোক কথা বলছেন খুব গুছিয়ে। তাহলে জোছনা দেখার মতোন এ রকম বুড়ো লোকও আছে দেশে? উল্টো তিনি অবাক হলেন আমাদের জোছনাপ্রীতি দেখে। জানালেন হার্দিক শুভেচ্ছা। আফসোস লুকিয়ে তিনি বলছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় জোছনা দেখতে যান কিন্তু এ রকম অভিজ্ঞতা তার জীবনে আর হয়নি। এ্যা, তাই বলে এমন দাবড়ানি? নিশ্চয়ই কিছু আছে ওই কারখানায়। কুদরত বলে, হ্যাঁ স্যার, ওইসব কবর আমাদের দাদা-পরদাদার। তারা শোধ নিচ্ছেন। কিন্তু মৃত মানুষ কি এসবে থাকার কথা, স্যার! চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, পিরিতি…
গভীর জোছনারাতে গল্প করে পথ হাঁটতে এত মজা- আগে কেন বুঝিনি, এই আফসোসে পুড়ছে আমাদের হৃদয়। নোনা হাওয়া উসকে দিচ্ছে মন। সিগারেট ধরাই। ভদ্রলোককে অফার করতে হয়নি, নিজের মনে করে হাত বাড়িয়ে দিলেন। চমৎকার করে লাইটারে সিগারেট ধরায় মন্ত্রী। তার থেকে আমি, আমার থেকে কুদরত, কুদরত থেকে ডলার, ডলার থেকে সফি। আরে দৌড়ছেন কেন? এই যে… আগুনের আঁচ লাগার আগেই ভদ্রলোকের দৌড়… পালান পালান কবর আসছে, পালান জোছনা আসছে… ডানে-বামে তাকাই, মুহূর্তেই উধাও ভদ্রলোক। একের পর এক অকল্পনীয় ঘটনায় হতবাক পাঁচ যুবক। এমন হচ্ছে কেন? নিজেদের গায়ে চিমটি কাটি। আচ্ছা কুদরত, লোকটা কে? সমস্বরে বলি আমরা। খুব ভাব নিয়ে কুদরত বলে, তিনি হুমায়ূন আহমেদ, জোছনা-প্রেমিক!

– ইলিয়াস বাবর

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়