মোহাম্মদপুরে ২৫ দিন ধরে শিকলে বেঁধে তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ

আগের সংবাদ

পাল্টে যাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা : শিখনকালীন ৪০ শতাংশ, ৩০ নম্বর হাতেকলমে এবং ৩০ নম্বর সামষ্টিক মূল্যায়ন

পরের সংবাদ

সবুজ পৃথিবী গড়ায় মনোযোগী হতে হবে

প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, ছড়া-নদী, গিরি, ঝর্ণা- এসব মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান- বাংলাদেশের এই তিন জেলাকেই মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম হিসেবে ধরা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন প্রায় ১৩ হাজার ১৮৪ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১০ শতাংশ। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্যতম বৃহত্তম বনাঞ্চল। আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় দেশের বনাঞ্চলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
একটি দেশের জন্য যতটুকু বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন তার চেয়েও অনেক কম বন রয়েছে আমাদের। আর যা আছে তাও দিন দিন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা পাহাড়ি এলাকার যে দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ার কথা কিন্তু সে রকম দৃশ্য এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। পাহাড়ে এখন আর সেই প্রাকৃতিক নিবিড় ঘন বন নেই, প্রাচীন কোনো গাছপালা নেই। যে বনে বাঘ, হরিণ, হাতি, শিয়াল, সাপ, পাখ-পাখালির আস্তানা থাকার কথা সে বন-পাহাড় এখন চা বাগান, আম বাগান অথবা লিচু বাগানে রূপান্তর হয়ে গেছে। সেখানে পাখিদের বিচরণের কোনো সুযোগ নেই। বন্যপ্রাণীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম কোনো পরিবেশ নেই। এটা সত্যিই খুব উদ্বেগের বিষয় বৈকি।
পাহাড়ি এলাকায় যাতায়াতের সময় যখন রাস্তার দুপাশে তাকাই তখন পাহাড়ের এই করুণ চিত্র আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। পাহাড়গুলো যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে! এইতো, মাত্র কয়েক বছর আগেও যখন এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতাম তখন কেমন যেন রোমাঞ্চকর ছিল পাহাড়ের দৃশ্যগুলো! পথ চলতে চলতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের গল্পের সঙ্গে দৃশ্যগুলোকে মিলাতাম মনে মনে। সেই গা ছমছম করা পাহাড়ি পথের ছবি আঁকতাম কল্পনায়। কিন্তু সেই পাহাড়, সেই বন আজ কোথায়? এক সময় এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ১ হাজার ৫৬০টিরও অধিক সম্পূরক উদ্ভিদের সন্ধান ছিল, যার মধ্যে অন্তত ৬০০টি ছিল বৃক্ষ প্রজাতি। কিন্তু আজ সেসব কোথায় হারিয়ে গেল? এ বিষয়গুলোর কোনো সঠিক জবাব কারো কাছে আছে কি?
গাছপালা আমাদের দিচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, ঘরবাড়ি তৈরির সরঞ্জাম। কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেনও সরবরাহ করছে। ঝড়-জলোচ্ছ¡াস প্রতিরোধে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত কমাতে ও এর গতির তীব্রতা কমাতেও বিরাট ভূমিকা পালনে সহায়ক আমাদের এই গাছপালা। এছাড়া বজ্রপাত ও ভূমিক্ষয়রোধেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর প্রচুর পরিমাণে গাছপালা বা বনাঞ্চল না থাকলে আমাদের বন্য পশু-পাখি, প্রাণীরা সব হারিয়ে যাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আমি কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। দেখছি আমাদের কৃষি খামারের আশপাশের সব পাহাড়ের চেহারা প্রায় একই রকম। সবুজ পাহাড়ের সব ধরনের গাছপালা কেটে একদম পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হবে যেন মরুভূমির কোনো অঞ্চল এটি। ছোট ছোট লতা-গুল্ম, ঘাস- এসবও ঘাসমারা বিষ প্রয়োগে ধ্বংস করা হয়েছে। কী নির্দয় আচরণ! পরিবেশ প্রকৃতি বিশারদ ও নিরাপদ খাদ্য গবেষক কাজী জিয়া শামস্ একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- এই ঘাস, লতা-পাতা যেগুলোকে আমরা আগাছা বলে ধ্বংস করছি সেগুলোতো অন্ততপক্ষে আমাদের জন্য প্রতিনিয়ত অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে। আর এসব আগাছা তো আমাদের গরু-ছাগল, ভেড়া-মহিষসহ গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের অতি বাণিজ্যিক চিন্তার বলি হচ্ছে আমাদের এসব পাহাড়-পর্বত-বন-নদী।
বাণিজ্যিক বাগান তৈরি করতে আমরা আমাদের বন এবং বনজসম্পদকে ইচ্ছামতো ধ্বংস করছি। ঘর-বাড়ি, রিসোর্ট, শিল্পকারখানা তৈরি করতেও বন ও পাহাড় কেটে উজাড় করা হচ্ছে। মানুষের রান্নার কাজে লাকড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বনের কাঠ। ঘরের আসবাবপত্র তৈরিতে নিঃশেষ হচ্ছে পুরনো সব গাছপালা। ইটের ভাটার জ¦ালানি জোগাতে প্রতিনিয়তই বন উজাড় হচ্ছে। এছাড়া ইট তৈরিতে মাটির উপরিভাগের অংশ কেটে নেয়ার ফলে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। কমছে কৃষি উৎপাদন। সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাত কল নিষিদ্ধ হলেও তা কেউ মানছে না। ফলে বন ধ্বংসের এই মহাযজ্ঞ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
বনভূমি রক্ষায় সরকারি আইন আছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই অবাধে পাহাড় প্রকৃতিকে ধ্বংসের কাজ করছে সবাই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বাগান সৃজনের ফলে আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে বনভূমির পরিমাণ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণী, প্রাণবৈচিত্র্য। একসময় আমাদের এই পাহাড়ে ছিল হাজারো রকমের গাছপালা, উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম। ছিল নানা রকম কাঠের গাছ, ফলের গাছ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ। অতি লোভে আমরা সব শেষ করেছি।
প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে, বন উজাড় করে, নদী-খাল-ছড়াকে বিপন্ন করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অসুস্থ পরিবেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। আর এর ফলে নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে আমাদের ওপর। ইদানীংকালে বজ্রপাত, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাহাড় ধস, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আর এজন্য একমাত্র আমরাই দায়ী, এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। পার্বত্য এলাকার প্রতিটি অঞ্চলই তো পাখ-পাখালির কলরবে সরব থাকার কথা। কিন্তু কেমন যেন একটা হাহাকার বিরাজ করছে সর্বত্র। পাহাড়ের প্রাচীন সব গাছপালা কেটে বাণিজ্যিক বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে বনের পাখিরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। আর পোকামাকড় দমনের জন্য কয়েকদিন পরপর যে পরিমাণ বিষ ছিটানো হয় তাতে করে পাখিসহ বনের অন্য প্রাণীদের বেঁচে থাকাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। আর এক শ্রেণির মানুষ তো আছেই যারা চরম উন্মাদনায় পাখি শিকার করে চলছে। এভাবেই প্রকৃতি ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গকে ক্রমাগত ধ্বংস করে দিচ্ছি আমরা।
পৃথিবীর সব জীবের বেঁচে থাকার মূল উপাদান হলো গাছপালা আর সবুজ বনাঞ্চল। পরিবেশ প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ঠিক রাখতে কোনো দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমি আছে মাত্র ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। পৃথিবীতে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ হলো ০ দশমিক ৬২ হেক্টর। যা ১৯৬০ সালের তুলনায় মাত্র অর্ধেক। আর বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ০ দশমিক ০১৫ হেক্টরেরও কম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও যেটা ছিল প্রায় ০ দশমিক ৩৮ হেক্টরের মতো। আমরা আমাদের সুন্দর এ পৃথিবীকে কীভাবে ধ্বংস করে চলেছি এটা তার একটা ছোট্ট নমুনা মাত্র।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বিশ্বের সব দেশকে বনভূমির পরিমাণ ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয়েছে। অথচ সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি অবস্থানেও আমরা এখন নেই। আমাদের সচেতনতাই পারে সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নে এগিয়ে নিতে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকার কারণেই প্রতিনিয়ত নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছি আমরা। নদীর নাব্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, পাহাড়ে ভূমিধস হচ্ছে হরহামেশাই, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন দিন পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দূষিত হচ্ছে বায়ু। বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে নানা রোগব্যাধি, ফুসফুস এবং অ্যালার্জিজনিত বিভিন্ন রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে- কেবলমাত্র বায়ুদূষণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০ মিলিয়ন লোক মারা যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন- কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারলে ২০৩৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা এখনকার তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। ২০৫১ সালে তা আরো ২ ডিগ্রি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভয়াবহ এই পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আবারো সবুজ পৃথিবী গড়ায় মনোযোগী হতে হবে। নিজ নিজ এলাকায় পর্যাপ্ত গাছ লাগিয়ে, প্রাচীন বন-পাহাড়কে সংরক্ষণ করে সবুজের এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। এই কাজগুলো আমাদের করতে হবে আমাদের নিজেদের জন্যই, আমাদের সুস্থতা আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যই। আমাদের সবাইকেই মনে রাখতে হবে, আমরা বহু অর্থ ব্যয় করে আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতার জন্য সুরম্য অট্টালিকা বানাতে পারব; কিন্তু গাছপালা, পাহাড়, প্রকৃতি, বনাঞ্চল না থাকলে সুস্থভাবে বাঁচার আর কোনো উপায় থাকবে না।

আমিনুল ইসলাম বাবু : কৃষিবিদ; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সেফ ফুড অ্যালায়েন্স।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়