মোহাম্মদপুরে ২৫ দিন ধরে শিকলে বেঁধে তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ

আগের সংবাদ

পাল্টে যাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা : শিখনকালীন ৪০ শতাংশ, ৩০ নম্বর হাতেকলমে এবং ৩০ নম্বর সামষ্টিক মূল্যায়ন

পরের সংবাদ

একই গোষ্ঠীর দুই ইফতার পার্টি

প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: এপ্রিল ২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ৩০ মার্চ ঢাকার দুটি অভিজাত হোটেলে দুটি ইফতার পার্টি হয়েছে। এর একটির আয়োজক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, অন্যটি এবি পার্টি। দুটি একই ঘরানার, এবি পার্টি দাবি করে থাকে যে তারা জামায়াতের সঙ্গে অনেক বিষয় দ্বিমত পোষণ করে আলাদা হয়েছে, তবে তাদের আদি উৎস জামায়াতই। কিন্তু রাজনীতির গভীর জ্ঞান ও সচেতনতা যাদের রয়েছে তাদের ধারণা এটি জামায়াতের একটি অভিনব কৌশল মাধ্যম। আদর্শগতভাবে দুইয়ের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে যেহেতু জামায়াতের শরীরে কলঙ্কের দাগ লেগে আছে তাই কলঙ্কমুক্ত থাকার জন্য কিছু দলীয় নেতাকর্মীকে ভিন্ন নামে রাজনীতির ময়দানে রেখে ফসল তোলার কৌশল ছাড়া এটি আর কিছু নয়। ভবিষ্যতে সুযোগ ঘটলে বা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে আদি উৎস আর নবপরিচিতরা এক হতে মোটেও দেরি হবে না, সমস্যাও হবে না। দেশে ধর্মান্ধ তরুণ ও জনগোষ্ঠীকে একসময় জামায়াত যেভাবে কাছে টানতে পেরেছিল ২০১০-এর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং শাস্তির কারণে অনেকেই জামায়াতের দিকে রাজনীতির কেবলা নির্ধারণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সে কারণেই হয়তো স্বাধীনতা-উত্তরকালে যাদের জন্ম হয়েছে, ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল তাদেরই একটি অংশকে দিয়ে আমার বাংলাদেশ তথা এবি পার্টি প্রতিষ্ঠার কৌশল জামায়াত থেকেই নেয়া হতে পারে। এবি পার্টি এখন প্রায় প্রতিদিনই দেশের নানা ইস্যুতে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করে থাকে। ফলে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতিদাতা সংগঠনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এর ফলে দলটি অনেকের কাছেই পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া দলটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ সক্রিয় আছে। দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন এক সময়কার জামায়াত ঘরানার আমলা বলে পরিচিত এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী। যিনি ১৯৬৪ সাল থেকে ইসলামী ছাত্র সংঘের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পরে ১৯৭৫ সালে ছাত্রজীবন শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ২০০৬ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি গোপনে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং বেশ কিছু জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদেও গোপনে আসীন ছিলেন। বিএনপির শাসন আমলে তিনি সরকারের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। ২০১৯ সালে ১০ ডিসেম্বর জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে ২ মে ২০২০ সালে তিনি এবি পার্টি নামক নতুন রাজনৈতিক দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। এই পার্টির অন্য নেতাদেরও অতীত প্রায় একই রকম। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাতে থাকা জামায়াতের অনেকেই এখন এই দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন। যদিও এই দলের ঘোষণা পত্রে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার ইত্যাদি কায়েম করাই এই দলের লক্ষ বলে ঘোষণা করা হয়েছে; কিন্তু যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই, অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কেও কোনো প্রতিশ্রæতি নেই। ফলে এ দলের রাজনীতি, লক্ষ, উদ্দেশ্য মোটেও পরিষ্কার নয়। দেশের ডান এবং অতি ডানদের সঙ্গেই তাদের গাঁটছড়া সম্পর্ক জন্ম থেকেই বিরাজ করছে।
৩০ তারিখ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হোটেল সোনারগাঁওয়ে ইফতার পার্টির আয়োজন করেছিল। বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা এই ইফতার পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন। এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাসসহ দলটির ১৮ জন নেতা অংশ নেন। এছাড়া এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিকল্পধারার নুরুল আমিন ব্যাপারী, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, এবি পার্টির যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, গণদল, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় দল, জাগপার দুই অংশ, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, লেবার পার্টির নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি রুহুল আমিন গাজী উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে হোটেল আমারিতে এবি পার্টির দেয়া ইফতার পার্টিতে বিদেশি কূটনীতিবিদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বলে পরিচিতি দানকারী বেশ কিছু সংগঠনের প্রধান এতে অংশগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর (অব.), মেজর আখতারুজ্জামান (অব.), শামা ওবায়েদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, আশরাফ উদ্দিন নিজান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণফোরাম নেতা অ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, এনডিএম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, জাতীয় পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, ন্যাপ পার্টির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, আইআরআই প্রতিনিধি দলসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অংশ নেন। সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের মধ্যে অংশ নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নাজিম উদ্দিন, সাবেক সচিব ইসমাঈল জবিউল্লাহ্, মেজর জেনারেল (অব.) এহতেশামুল হক, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক মোজাহেরুল হক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন, অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুন আহমেদ, আইনজীবী মহসীন রশীদ, অভিনয়শিল্পী আরজুমান্দ আরা বকুল, সামাজিক সংস্থা ব্রতীর সিইও শারমিন মুরশিদসহ বিভিন্ন পেশার আরো অনেকেই এই ইফতার পার্টিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ইফতার পার্টি দুটির রাজনৈতিক তাৎপর্য বিভিন্ন মহলের কাছে বিভিন্ন রকম বলে মনে হয়েছে। কেউ এই দুই ইফতার পার্টিকে তেমন গুরুত্ব দিতে আগ্রহী ছিলেন না। কেউ কেউ অভিজাত ফাইভ স্টার হোটেলের ইফতার পার্টির আয়োজন যারা করতে পারেন তাদের অর্থনৈতিক সূ²তার কথাও বলার চেষ্টা করেছেন। তবে দুই ইফতার পার্টিতেই মোনাজাতের আগেই দুই দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক যে বক্তব্যটি উচ্চারিত হয়েছে সেটিকে মোটেও হাল্কা করে দেখার সুযোগ নেই। হোটেল সোনারগাঁওয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘সত্যের পক্ষে দাওয়াত দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। সে দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে আমার ওপর যদি কোনো আঘাত আসে, তাহলে এর প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করার অধিকার আমার আছে। আমরা কারো সঙ্গে গায়ে পড়ে লাগতে চাই না। কিন্তু কেউ যদি পায়ে পাড়া দিয়ে আমার সঙ্গে বাধে, তখন তো আমার দায়িত্বটা আমাকে পালন করতেই হবে। হঠকারিতা নয়, বিশৃঙ্খলা নয়, সত্যের পক্ষে বুক সটান (উঁচিয়ে) করে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আমরা রাজনীতি করি, এটা আমাদের অপরাধ নয়। সরকারি দলের লোকেরা যদি রাজনীতি করার অধিকার রাখে, আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিক সাংবিধানিক অধিকার বলেই সে-ও রাজনীতি করার অধিকার রাখে।’ জামায়াতের আমিরের বক্তব্য বেশ দীর্ঘ ছিল তাতে সুকৌশলে অনেক কথা বলা হয়েছে যার গূঢ় অর্থ অনেক সাধারণ মানুষ উদ্ধার করতে পারার কথা নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক আদর্শের রাজনীতিরই অধিকার উন্নত দুনিয়াতেও থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রের আদর্শবিরোধী কোনো রাজনীতিরই অধিকার কোনো দলের থাকে না। জামায়াতে ইসলামী গণতন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করে, কিন্তু দলটির আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নয় এটি তাদের সংগঠনের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত। সুতরাং জামায়াত নেতা শফিকুর রহমানের দেয়া বক্তব্যের আরো অন্য অংশগুলোও বেশ চাতুর্যে ভরপুর। অন্যদিকে হোটেল আমারিতে এবি পার্টির ইফতার পার্টির দেয়া দলের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য দেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। বক্তব্যে দেশের চলমান অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মানবাধিকারের জন্য চরম হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। গণতন্ত্রকামী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সব রাজনৈতিক পক্ষের একটি ঐক্যবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। নির্দোষ এই বক্তৃতার মধ্যে অন্য কিছু খোঁজার চেষ্টা হয়তো কেউ করবে না, কিন্তু যারা বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলে অবিহিত করেছেন তাদের অতীত কী ছিল- তা কি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে। গণতন্ত্র কি এতই সহজ যা বললেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। যেসব দলকে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে তারা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মানবাধিকার রক্ষা, দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার জন্য অতীতে কী করেছে কিংবা এখন বা ভবিষ্যতে কীভাবে তা করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে তা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য কিনা সেই প্রশ্ন করা যেতেই পারে। তবে তারা যদি সত্যিই দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামই কেবলই করেন, দলে যোগ্য, মেধাবী, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাস এবং জীবনাচরণে সেসবের প্রতিষ্ঠা না ঘটান তাহলে এসবের বাস্তবায়ন কেউ কোনো দিন দেখবে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যার কোনো শেষ নেই। সবাই নিজেকেই দেশের একমাত্র আদর্শবাদী দল বলে মনে করে, কিন্তু যিনি এমনটি দাবি করেন তার পেছনে কয়জন আছে সেই পরিসংখ্যান নিলে তা দিয়ে একটি ফুটপাতের দোকানও সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ আছে। দেশে সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর মতো ভিশনারি-মিশনারি নেতৃত্বের অভাব কত প্রকট সেটি বুঝিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। হেনরি কিসিঞ্জার মৃত্যুর দুই বছর আগে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন পৃথিবীতে এখন তিনি যোগ্য নেতাই খুব একটা দেখতে পাচ্ছেন না। কিসিঞ্জার বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত ছিলেন, কিন্তু তার রাজনৈতিক জ্ঞান অগাধ ছিল সে কারণেই তিনি এমন সত্য কথাটি বলতে পেরেছেন। আমাদের দেশে বেড়ে ওঠা এবং গড়ে ওঠা রাজনীতিবিদদের যারা হত্যা করেছেন এবং যারা দেশের জন্য যোগ্য নেতৃত্বের রাজনীতিকে জটিল করার মিশন নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাদের ভাবশীর্ষদের দিয়ে আর যাই কিছু হোক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা একেবারেই সম্ভব নয়।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়