ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

স্বাধীনতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা ও কর্মযজ্ঞ : তারই প্রকাশ স্বাধীনতার ঘোষণা

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে কিছু কিছু মানুষ আজো দুটো অনুকল্পনা নিয়ে নাড়াছাড়া করেন। তার একটি হচ্ছে ‘১৯৭১ সালে শেখ মুজিব কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।’ অপর অনুকল্পনাটি হলো শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের বা মিসেস মুজিবের চাপে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন; তিনি স্বাধীনতা চাননি!
বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় এসব কথা চুপিসারে উচ্চারিত হতো। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তার প্রায় সপরিবারে শাহাদাতবরণের পর প্রথমে মৃদুলয়ে এবং তারপর দ্রুতলয়ে এসব কথা ছড়াতে থাকে। এসব যারা শুরু করেন তাদের একুনে পরিচয় হচ্ছে বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন রাজাকার, আলবদর, আলশামস তেমনি ছিলেন এমন সব যোদ্ধা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা ধারণ না করেই বিপদে পড়ে, জীবন বাঁচাতে আত্ম কিংবা গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরাও ছিল। তার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে।
তাদের প্রথম কথায়ই ছিল শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এবং সে কারণে তিনি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে পারেন না। কিন্তু তারা হয়তো জানতেন না বা জানলেও স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন যে লাহোর প্রস্তাবের বদলে দিল্লি প্রস্তাব ভিত্তিক পাকিস্তান সৃষ্টিতে প্রথম থেকেই শেখ মুজিবের আপত্তি ছিল।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি দ্বিতীয় অভিযোগ যে তিনি ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বললেও জয় বাংলা ও জয় পাকিস্তান বলে বক্তব্য শেষ করেন। তাতেই প্রমাণিত হয় যে তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। কার্যত তাদের মুখের ভাষা বিপক্ষীয়রা বেদ বাক্যের মতো মেনে নিয়েছিল। এর সঙ্গে একজন বিচারপতি, একজন কবি ও একজন রাজনীতিবিদ একই কথার প্রতিধ্বনি করায় অপপ্রচার বেগবান হতে সময় লাগেনি, যদিও তাদের তিনজনের দুজন পরবর্তীতে ভুল স্বীকার করেছিলেন। তবে এ সময়ে প্রতিবাদী কণ্ঠও সবল হতে থাকে। তাই বিরুদ্ধবাদীগণ কৌশল বদলাতে গিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রসঙ্গ টেনে সে মামলায় শেখ মুজিব প্রদত্ত জবানবন্দিকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে করে। আগরতলা মামলার জবানবন্দিতে শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে তার ভূমিকার কথা বলেছেন এবং স্পষ্টভাবে বলেছেন তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চাননি বা পাকিস্তান ভাঙতে পারেন না। তা ছাড়া তার অপর একটি উচ্চারণ ‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে বিচ্ছিন্ন হতে যাব কেন?’ বিপক্ষীয়দের হাতে আরো মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয়। তবে সবচেয়ে মারাত্মক উক্তিটি আমরা খুঁজে পাই মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক তাজউদ্দীন কন্যা শারমিনের ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থের একাংশে তিনি উল্লেখ করেন যে বঙ্গবন্ধু কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তাতে অতি উৎসাহী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান একই কথা বলে বসেন। তদানিন্তন সরকারপ্রধান আরো তার স্বরে ঘোষণা করেন যে শেখ মুজিব স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি।
বঙ্গবন্ধুর অপর একটি কৌশলকেও বিরুদ্ধবাদীরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে বা করছে। শেখ মুজিব ছাত্রলীগের একাচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাতে দুটো ধারা বিরাজমান ছিল। একটি ছিল তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনপন্থি যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি আর অপর অংশে ছিলেন সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। শেখ মুজিব আপন ভাগনে মনিকে দিয়ে স্বায়ত্তশাসনমুখী ধারাকে বেগবান রাখেন, যদিও তলে তলে তাকে দিয়েই সশস্ত্র যুদ্ধের প্রয়োজনে পৃথক একটি সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আর সিরাজ-রাজ্জাককে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারাকে বিপ্লবী ধারায় রূপান্তর ঘটান। এটা ছিল পাকিস্তানকে ঘুম পাড়ানোর কৌশল। পাকিস্তানিরা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝে নিয়েছিল যে শেখ মুজিব বিচ্ছিন্নবাদী বা সমাজতন্ত্রী নয়। শেষকালে দু’ধারাকে মিলিত করে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধের পথ ধরেছিলেন।
তার অপর একটি কৌশলেরও মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে এক ধরনের কনফেডারেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন; সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য ভারতীয় সিগনালের প্রতীক্ষায় ছিলেন। তখন ভারতের ইন্দিরা সরকার সবেমাত্র অনেকটা আগোছালো ভাবে ক্ষমতায় বসেছে। তাই তাদের জন্যও ক্ষাণিকটা প্রতীক্ষার প্রয়োজন ছিল। শেষ মুহূর্তে যুব ও ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি শেষ দুটো তুরুপের কার্ড খেলেন। সে কার্ডদ্বয় ছিল পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা ও স্বতন্ত্র বাহিনী গঠনের প্রস্তাব। তাতে ইয়াহিয়া অতিমাত্রায় ক্ষিপ্ত

হয়ে বঙ্গবন্ধুকে পরিণতির হুঁশিয়ার দেন। পরিস্থিতি বুঝে তিনি তার স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি পাকিস্তানিদের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুর আগেই দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের সারাদিনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলেও বুঝা যাচ্ছে তিনি সশস্ত্র আঘাতের নির্দেশ চট্টগ্রামসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটগুলোতে দিয়েছিলেন। এই প্রবন্ধে এসব কথাগুলোর একটু বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে প্রথম অনুকল্পনাটিকে মিথ্যা প্রমাণের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অনুকল্পনাটি অন্যত্র আলোচিত হবে।
শেখ মুজিব পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন ঠিকই, তবে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দিল্লি প্রস্তাব ভিত্তিক পূর্ব ও পশ্চিমাংশ মিলিয়ে এক কেন্দ্রিক পাকিস্তান সৃষ্টির কারণেই অনেকের সঙ্গে শেখ মুজিবও আশাহত হলেন। বেদনাহত মুজিব মূলত সেদিন মানে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে বাঙালিদের উপযোগী একটি ভৌগোলিকসত্তা সৃষ্টির কথা চিন্তা করেন। বহুদিন পর ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক সভায় বঙ্গবন্ধু এই গোপন তথ্য ফাঁস করেন। তিনি বলেন, ‘আমার যতটা মনে পড়ে, আমি ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে সিরাজোদ্দৌলা হোটেলে একটি অনানুষ্ঠানিক সভায় আমার বন্ধুদের বলেছিলাম, পাকিস্তান সৃষ্টিতে আমরা বাঙালিরা শেষ হয়ে গেলাম। তবে আমি প্রতিশ্রæতি দিলাম যে, আমি তা হতে দেব না, আমি বাঙালিদের স্বাধীন করে ছাড়ব। কার্যত সেদিন থেকেই আমার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়।’ এ কথার সাক্ষ্য হয়ে আছেন তদানিন্তন মুসলিম লীগের টি আলী, নুরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ। পরের দাপে আছেন কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এবং খোকা রায়।
তাইত মনি সিংহকে বলতে শুনি, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রকে শুরুতেই মেনে নিতে পারেননি। তার সঙ্গে যখন আমার আলোচনা হতো তখন তিনি বলতেন, ‘দাদা সমাজতন্ত্র আপনারা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। তার চেয়ে আমাকে সমর্থন দেন। আমি দেশটা স্বাধীন করে আপনাদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেব।’
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের ভাষায় ‘শেখ মুজিব কোনো দিন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমরা যখন গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করতে বসলাম তখন তিনি আমার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দেন। তাতে লেখা ছিল, ‘যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবে এবং পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বিরোধিতা করবে তাদের কমিটিতে রাখা যাবে না।’ তারপরের ঘটনাপুঞ্ছি তার স্বাধীনতার স্পৃহা বা চেতনাকে ক্রমশ: ক্ষুরধার করেছে।
পাকিস্তান সৃষ্টিতে শেরে বাংলা ও সোহ্রাওয়ার্দীর অবদান থাকলেও ১৯৪৭ সালের পর শেরে বাংলা ও সোহ্রাওয়ার্দীর প্রতি চরম অবিচার করা হয়। বিক্ষুব্ধ সোহ্রাওয়ার্দী কলকাতায় রয়ে গেলেন। শেখ মুজিব নবসৃষ্ট পাকিস্তানে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে ভর্তি হোন। মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়ে প্রাথমিক স্তরে তিনি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের গোড়াপত্তন ঘটালেন। এমনকি গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামক একটি যুব সংগঠনেরও তিনি জন্ম দিলেন। উভয় সংগঠন ছিল জাতীয়তাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন ও গণতান্ত্রিক চেতনার ধারক। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনকে তার স্বর্পাজনের আর একটি সম্পূরক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায়ই আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি জেলে ছিলেন ঠিকই কিন্তু সে দিনটির সফলতার মূলে রাজবন্দি শেখ মুজিবের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ভাষা বিতর্কের মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ জাতীয় স্লোগানের পাশাপাশি ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’, জাতীয় একটা বোধ তাকে নাড়া দিতে থাকে।
তার দু’বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে, সোহ্রাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর প্রিয় মানুষ ছিলেন শেখ মুজিব। যুক্তফ্রন্টের শাসনামলে তিনি মন্ত্রিত্ব পেয়ে অনেকটা পদ-প্রদীপের আলোতে উদ্ভাসিত হচ্ছিলেন। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে এক পর্যায়ে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন যা ছিল অভাবিত। মতলবটা সুস্পষ্ট ছিল। ওই অবস্থান থেকে দলটাকে নিজের মনমত গড়ে তোলার নিরবিচ্ছিন্ন সুযোগ তিনি লাভ করলেন। সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায় যে শেখ মুজিব ১৯৫৪ সাল থেকে ময়মনসিংহে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিফ্রন্টকে বৈষয়িক, তাত্ত্বিক ও মনসতাত্ত্বিক সাহায্য দিয়ে আসছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনোত্তর ঘটনাপুঞ্ছি বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল ও মিলিটারি আমলা নির্ভরশীলতা এবং বৈষম্যমূলক আচরণ তাকে আবারো নতুন ভাবনায় ফেলে দিল। অস্থায়ী সংবিধানের ৯২(ক) ধারার যথেচ্ছা প্রয়োগ কিংবা রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকে কলংকিত করার নেপথ্যের প্রয়াসও তিনি অবলোকন করলেন।
১৯৫৬ সালের অগ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র কিংবা সিয়াটো সেন্টোর ন্যায় সামাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে গাঁটছাড়া ও কর্তৃত্ববাদী পাকিস্তানি শাসন মেনে তিনি কার্যত নেননি। সাধারণ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে এলো ষড়যন্ত্রের ঘোট ততই পাকানো হচ্ছিল। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র ভিত্তিক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে ইসকান্দার মির্যা ১৯৫৮ সালের শেষ ভাগে সেনাশাসন ঘোষণা করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাতিল করে দেয়। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সেনা প্রধান আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতিবিদদের রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা, অনেককে জেলে প্রেরণ এবং কতিপয় সিনিয়র আমলাদের চাকরিচ্যুৎ করে। এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব বিকল্প রাস্তা খুঁজতে শুরু করেন। তিনি বুঝলেন নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় লক্ষ্য অর্জিত হবে না। তাই ১৯৬১ সালের কোন এক সময়ে তিনি পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট (ইবিএলএফ) গঠন করেন এবং এর ছত্রছায়ায় একটি লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা করেন যাকে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার বলা যায়। পরবর্তীতে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট) নামকরণ করে তার দায়িত্ব শেখ ফজলুল হক মনিকে দেয়া হয়। প্রায় একই সময়ে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে তার দায়িত্ব সিরাজ-রাজ্জাক ও আরেফকে দেন। ১৯৭১ সালে বিএলএফের নামকরণ করা হয় মুজিব বাহিনী। বর্ণিত লিফলেট বিতরণের কিছুদিন পরই দলের গন্ডি ছাড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংহ ও খোকা রায়ের কাছে স্বাধীন বাংলার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এ ব্যাপারে তাদের সম্মতি মিলে নাই ঠিকই কিন্তু তখনই প্রকাশিত হয় যে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীও এ ব্যাপারে অসম্মতি জ্ঞাপন করে আসছিলেন। মনি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে আলোচনার পূর্বে শেখ মুজিব ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে গোপনে আগরতলা গিয়েছিলেন সাহায্যের আশায়। কিন্তু ভারতের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু থেকে তেমন কোন প্রতিশ্রæতি পেতে ব্যর্থ হোন। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ভারত-চীন যুদ্ধের ফলশ্রæতিতে নেহেরুর তাৎক্ষণিক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না পেলেও শেখ মুজিবের একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে কথা বার্তা বলার পথ খোলা রাখেন। অবশ্য তার পূর্বে তিনি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ ভারতীয় দূতাবাসের জনৈক শশাংক চক্রবর্তীর সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়ে আলাপ করেন এবং নেহেরুর সাহায্য চেয়ে লেখা একটি চিঠি তার হাতে হস্তান্তর করেন। এই চিঠির জবাব না পেয়ে তিনি তড়িঘড়ি আগরতলা চলে গিয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল নেহেরুর সম্মতি পেলে তিনি ব্রিটেনে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এবং তার অনুসারীরা ভারতের সহায়তায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করবে। শেখ মুজিব দেশে ফেরত এসে গ্রেপ্তার হন এবং স্বল্প সময় জেলে কাটান। তারপর ১৯৬৪ সালে সেনা, বিমান ও নৌ-বাহিনীর এক দল স্বাধীনতাপন্থি কর্মকর্তাদের সংস্পর্শে এসে তাদের প্রয়াসের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এক পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে এসব সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও গণতন্ত্র বা শোষণহীন সমাজ পত্তন অধরা থেকে যাবে। এই উপলব্ধির কারণে তিনি আওয়ামীপন্থিদের তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থান থেকে বিরত রাখেন। তার আগে কয়েকজন শিক্ষাবিদ দুই অর্থনীতি তত্ত্বের আলোকে কার্যকর ব্যবস্থা দাবি করেন। যার সঙ্গে শেখ মুজিব সম্পৃক্ত হয়ে যান। ১৯৬৩ সালেও তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন। এ যাত্রায় অনেকটা আটঘাঁট বেঁধে যাবার কারণে তিনি নেহেরুর সম্মতি পেয়েছিলেন বলে প্রকাশ (শাহরিয়ার কবির, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আবদুল মান্নান চৌধুরী)। কথিত আছে যে ১৯৬৪ সালে তিনি গোপনে কংগ্রেস সভাপতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়ে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তার ফলাফল অজ্ঞাত রয়ে গেছে। সে সালে দেশ থেকে হিন্দু বিতাড়নের সর্বশেষ প্রয়াস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে শেখ মুজিবসহ অনেকে রুখে দাঁড়ালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জাতিগত প্রতিরোধে রূপ নেয় এবং ঐক্যবদ্ধ বাঙালির রূপ পরিস্ফুট হতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্রী শাসন পোক্ত করেন। এই ব্যবস্থার কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আশা তিরোহিত হয়। শেখ মুজিব দুটো বিকল্প পথ ধরে তার পূর্বের সিদ্ধান্ত নিয়ে আগাতে থাকেন। সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন। মৃত্যুর পূর্বে সোহ্রাওয়ার্দী পাকিস্তানিদের সতর্ক করে দেন যে পাকিস্তান বৈষম্যের অবসান না ঘটালে তার মৃত্যুর পর মুজিব ঠিকই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। দিব্যচোখে সোহ্রাওয়ার্দী হয়তো তা অবলোকন করেছিলেন।
বিরুদ্ধবাদীরা চোখ থাকতে অন্ধ, আর কান থাকতে বধির ছিলেন বলে দেখতে বা শুনতে পাননি যে ১৯৫৫ সালেই মুজিব পাকিস্তান গণ পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটির পরিবর্তে পূর্ব বঙ্গ কথাটি ব্যবহারের দাবি জানান। আইয়ুবের মার্শল ল’ কালে এসব কথা আপাতত চাপা থাকলেও বিদ্রোহের আভাস ফুটে উঠে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ও ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভণ্ডুলের পাশাপাশি সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি ১৯৬১ সালের গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টকে শক্তিশালী করার প্রয়াস নেন। তিনি ১৯৬৩ সালে গঠিত অপূর্ব সংসদেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আগেই বলেছি বিএলএফের দায়িত্ব দেন শেখ ফজলুল হক মনিকে আর স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের দায়িত্ব দেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফকে। শেখ মনির কারাবরণের সময়ে শেখ মুজিব স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে তার দায়িত্ব আবদুর রাজ্জাককে দেন। এই সময়ে তিনি দেশ স্বাধীন হলে তার জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কে নির্ধারণ করে দেন। রবীন্দ্রনাথের এই গানটি তিনি প্রায়শ গুন গুন করে গাইতেন এবং এটাই যে জাতীয় সংগীত হবে তা নিকটস্থদের জানিয়ে দেন। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের রূপ রেখা স্বরূপ ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ দফা দাবি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এর মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও অন্তিমে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা সৃষ্টিও সম্ভব। বিষয়টা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক, পূর্ব পাকিস্তানের পদলেহি রাজনৈতিক নেতারা ও সিভিল মিলিটারি আমলার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রের শাসক আইয়ুব খান তার এজেন্টদের মাধ্যমে এই আন্দোলন প্রতিহত করা এবং প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষায় শেখ মুজিবকে প্রতিহত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি পেশের পূর্বে শেখ মুজিব ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজের মাধ্যমে ভারতের সরকার ও ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে সংযোগের নতুন দ্বার উন্মোচন করেন। তখনো চিত্তসুতারকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি যদিও ১৯৫৪ সাল থেকেই শেখ মুজিবের সঙ্গে সুতারের এক ধরনের কার্যকরী যোগাযোগ ছিল। ৬ দফাকে কবর দেবার মানসে আইয়ুব খান তাকে ও তার দলের অধিকাংশ শীর্ষ নেতাদের জেলে প্রেরণ করে এবং আওয়ামী লীগকে কার্যত বিলোপ করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৬৪ সালের সশস্ত্র অভ্যুত্থান আকাক্সক্ষী ৩৪ জনের সঙ্গে শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়। প্রচণ্ড গণআন্দোলনে আইয়ুব সরকার এ মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং পূর্ব বাংলার জনগণ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তবে ১৯৬৬ সাল থেকে আওয়াম লীগ ও ছাত্রলীগ সার্কেলে তাকে তার দুঃসাহসিকতার জন্যে ‘বঙ্গশার্দূল’ নামে অভিহিত করা হতো। আগেই বলেছি বিএলএফ প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি দীর্ঘ সময় জেলে থাকার কারণে তার কার্যাবলি ভিন্ন নামে আবদুর রাজ্জাককে দিয়ে করিয়ে নেয়া হয়। আবদুর রাজ্জাক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হয়ে ৬ দফায় ঘোষিত এক লাখ প্যারামিলিমিশিয়া গঠনের দায়িত্ব পান। শেখ মনি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর আগে জেল থেকে মুক্তি পেয়েই বিএলএফ পুনর্গঠনে মেতে উঠেন। ১৯৬৯ সালে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক ধারা ও সমান্তরাল সশস্ত্র ধারার কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৯ সালের শেষভাগে চিকিৎসার নামে লন্ডনে গমন করে ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। স্পষ্ট ভাষায় তিনি ইন্ধিরাকে তার অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করলে ইন্ধিরা স্বাধীনতাকামীদের ভারতে প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন, অস্ত্র সম্ভার প্রদান ও প্রচার সুবিধার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন।
১৯৭০ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম ভান্ডারির কাছে জানতে চান চিত্তরঞ্জন সুতারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেয়া যায় কিনা। নুরুল ইসলাম সাহেব বলেন, চিত্ত সুতার দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলে তিনি মনে করেন। বঙ্গবন্ধু তখন চিত্ত সুতারকে তার সঙ্গে গোপনে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। নুরুল ইসলাম ভান্ডারীর মারফত খবর পেয়ে চিত্ত সুতার ঢাকায় এসে গোপনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকারের সময় নুরুল ইসলাম সাহেব উপস্থিত ছিলেন না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি জানতে পারেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বঙ্গবন্ধু চিত্ত সুতারকে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠান। নুরুল
তারপর চিত্ত সূতারকে তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা ও চার যুব নেতা তথা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সুতারকে আশ্রয়ণে ও আবাসনের সুবিধা সৃষ্টি ও ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ। ভারতে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ও অনুকূল মনোভাব প্রাপ্তির লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বও তাকে দেয়া হয়। তাকে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। চিত্তসুতার অর্থ সংকট বিবেচনায় রেখে সীমান্তবর্তী তিনটি আবাসনের পরিবর্তে একটি আবাসন ভাড়া নেয়। মার্চ মাসের কোন এক সময় ডাক্তার আবু হেনাকে গোপনে চিত্তসুতারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রেরণ করা হয়। সব কিছু পাকাপাকি করে তিনি ফিরে আসেন। ভারতীয় হাই কমিশনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের নিবিড় পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া হয়। জহিরুল কাইউমের মাধ্যমে ত্রিপুরা হয়ে আর একটি সংযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়। ভারতীয় দূতাবাসের কর্তাব্যক্তি দিল্লিতে খবর পৌঁছিয়ে আসতে আসতে ক্র্যাকডাউনের লগ্ন এসে যায়। মনে হচ্ছে একই সময়ে বঙ্গবন্ধু অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তবে তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছিল তা অজ্ঞাত রয়ে গেছে। কিন্তু মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যে আগেই হয়েছিল সে কথা এ কে খোন্দকারসহ সব মুজিব বাহিনী বিরোধীরাও স্বীকার করেছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু কয়েকবারই প্রকাশ্য ইঙ্গিত দেন যে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। নির্বাচনের পূর্বেই সরকার গঠনের গাইড-লাইন এলএফওকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী প্রেস-কনফারেন্সে জনৈক সাংবাদিকের স্বাধীনতা সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘ঘড়ঃ ণবঃ’ বলে তাকে থামিয়ে দেন। জানুয়ারি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতি বুঝতে সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭১ এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং মার্চে ইন্ধিরা ভারতের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে ও বক্তব্যে তিনি ৬ দফার প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা ঘোষণা করেন। তখনই বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের নাম বদলিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স রাখা হয়। এই ফোর্স কথাটির মধ্যে তার যুদ্ধ-প্রস্তুতির বিষয়টি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ক্রমে বিভিন্ন নামে ও কমান্ডে বিভক্ত বিভিন্ন বাহিনী একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডে নিয়ে আসার কৌশল হিসেবে পুনর্গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) দায়িত্ব শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনায় গণহত্যার আভাস পেয়েছিলেন। এর আগে ফারল্যান্ড শর্ত সাপেক্ষে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে বিনা রক্তপাতে বিচ্ছিন্ন হতে এক ধরনের পরিকল্পনা দিয়েছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহে সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ভারত চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু নিহত হবার সম্ভাবনা থাকায় এবং হত্যার দায়িত্ব তার দলের চরমপন্থিদের ওপর ছাপিয়ে দেয়ার আশঙ্কায় তিনি শেষমেশ নিজ গৃহে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এতসব টানাফোরেন ও অস্পষ্টতার মাঝে বঙ্গবন্ধু আপাতত পাকিস্তানের সঙ্গে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক একটি কনফেডারেশনের ব্যাপারে পরোক্ষ সম্মতি দিয়েছিলেন। সে প্রস্তাবে ব্যাংকিংসহ মুদ্রা ব্যবস্থা ও দেশ রক্ষা কেন্দ্রের হাতেই ছিল। শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন যে তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার জীবদ্দশায় কিংবা কোনো দিন নাও আসতে পারে। বিষয়টি নিয়ে তিনি চার যুব নেতা এবং আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও শেখ শহিদুল ইসলামসহ তিন ছাত্র নেতার সঙ্গে আলাপ করলে তারা সবাই তাকে আলোচনা পণ্ড করে দেবার পক্ষে মত দেন। ২৪ তারিখে কোন এক সময়ে তিনি ইয়াহিয়াকে স্পষ্টত জানিয়ে দেন যে পৃথক মুদ্রা ও পৃথক মিলিশিয়া বাহিনীর বিধান না থাকলে পূর্বের সমঝোতা কার্যকর করা যাবে না। ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। ক্ষিপ্ত ও রাগান্বিত ইয়াহিয়া চূড়ান্ত আঘাত হানতে অপারেশন সার্চলাইটের আদেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে। ইতোমধ্যে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হককে খুলনা থেকে ডেকে আনেন। তার সঙ্গে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার ছিল। পাকিস্তানের ক্র্যাকডাউনের আগেই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে নুরুল হক বঙ্গবন্ধুর নি¤েœাক্ত ঘোষণাটি প্রচার করেন :
‘‘ঞঐওঝ গঅণ ইঊ গণ খঅঝঞ ঈঅখখ. ঋজঙগ ঞঙউঅণ ইঅঘএখঅউঊঝঐ ওঝ ওঘউঊচঊঘউঊঘঞ. ও ঈঅখখ টচঙঘ ঞঐঊ চঊঙচখঊ ঙঋ ইঅঘএখঅউঊঝঐ ডঐঊজঊঠঊজ ণঙট গওএঐঞ ইঊ অঘউ ডওঞঐ ডঐঅঞঊঠঊজ ণঙট ঐঅঠঊ, ঞঙ জঊঝওঝঞ ঞঐঊ অজগণ ঙঋ ঙঈঈটচঅঞওঙঘ ঞঙ ঞঐঊ খঅঝঞ. ণঙটজ ঋওএঐঞ গটঝঞ এঙ ঙঘ টঘঞওখ ঞঐঊ খঅঝঞ ঝঙখউওঊজ ঙঋ ঞঐঊ চঅকওঝঞঅঘ ঙঈঈটচঅঞওঙঘ অজগণ ওঝ ঊঢচঊখখঊউ ঋঙজগ ঞঐঊ ঝঙওখ ঙঋ ইঅঘএখঅউঊঝঐ অঘউ ঋওঘঅখ ঠওঈঞঙজণ ওঝ অঈঐওঊঠঊউ.’’ মেসেজটি নুরুল হক ১০.৩০টায় পাঠিয়ে দিয়ে ট্রান্সমিটারটি কি করবেন জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু হাজী মোরশেদের মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন তা ভেঙে ফেলতে ও পালিয়ে যেতে। তারপরেই বঙ্গবন্ধু হাজী মোরশেদ ও সাংবাদিক আতাউস সামাদকে বলছিলেন আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।’ সম্প্রতি জানতে পেরেছি যে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাটির উপর ভিত্তি করেই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রুজু ও শাস্তি দিয়েছিল। এই ঘোষণার কথা সিদ্দিক সালেক ডেভিড লোসাকের বরাতে উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু টিক্কা খান, মূসা সাদিক ও রেজাউর রহমানের কাছে ১৯৮৮ সালে তা আবার প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তার ঘোষণাটি যেন যোদ্ধা-জনতার কাছে পৌঁছে। তাই তিনি দ্বিতীয় ঘোষণাটি দেন ক্র্যাকডাউনের পর যার ভাষ্য ছিল :
‘গবংংধমব ঃড় ঃযব চবড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ. জধলধৎনধময চড়ষরপব ঈধসঢ় ধহফ চববষশযধহধ ঊচজ ংঁফফবহষু ধঃঃধপশবফ নু চধশ অৎসু ধঃ ২৪:০০ যড়ঁৎং. ঞযড়ঁংধহফং ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব শরষষবফ. ঋরবৎপব ভরমযঃরহম মড়রহম ড়হ. অঢ়ঢ়বধষ ঃড় ঃযব ড়িৎষফ ভড়ৎ যবষঢ় রহ ভৎববফড়স ংঃৎঁমমষব. জবংরংঃ নু ধষষ সবধহং. গধু অষষধয নব রিঃয ুড়ঁ. ঔড়ু ইধহমষধ.’ এই মেসেজটি সুবেদার মেজর শওকত আলী প্রচার করেন। তখন অন্যান্য সব প্রেরক যন্ত্রের কর্তৃত্ব পাকিস্তানিরা নিয়ে নেয় বলে ইপিআর প্রধানের মাস্টে তিনি তা প্রচার করেন। অপর একটি সূত্রে তার তৃতীয় ঘোষণার কথাও জানা যায়, যার ভাষ্য ছিল- ঞযব বহবসু যধং ংৎঁপশ ঁং. ঐরঃ ঃযবস নধপশ. ঠরপঃড়ৎু রং ড়ঁৎং. ওহংধ অষষধয, ঔড়ু ইধহমষধ, গঁলরনঁৎ জধযসধহ। কথিত আছে এটি পুলিশের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণার সময় আইনত বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির ভাগ্য নিয়ন্তা।
এসব ঘোষণা বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে জনগণের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ঘোষণার পাঠকদের এক নম্বর ব্যক্তি হলেন চাটগাঁয়ে এমএ হাশেম। মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন তার ৬ষ্ঠ পাঠক। তাই আইনত ও কার্যত স্বাধীনতার ঘোষক একজনই। তিনি হলেন মহান জাতির মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়