ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিভূমি

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ আছে দেশ ও বিদেশে। বিদেশিদের কেউ কেউ বিষয়টিকে অতি-সরলীকরণ করেন, কেউ কেউ আবার মনে করেন- এ সংকট শেষ হবার নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, এ সংকটের শেষ না টানা পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিপন্ন হতে থাকবে, রাষ্ট্র তার প্রার্থিত শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হবে। আর সে সুযোগ গ্রহণ করবে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী, যারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি এবং তারা, যারা ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের মাটিতে অস্থিতি জিইয়ে রাখার পক্ষপাতি।
কাজেই বিবদমান পক্ষগুলোকে পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে এই সংকটের সমাধান টানতে হবে। রাজনীতিতে মত ও পথ যতই ভিন্ন হোক না কেন, মৌলিক জাতীয় বিষয়গুলোতে সকলকে এক হতে হবে। রাজনৈতিক দলগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এই উপলব্ধি যত দ্রুত ঘটবে ততই মঙ্গল।
দ্বিমতের কোনোই সঙ্গত কারণ নেই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আরোপিত বা পরিকল্পিত; রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার মধ্য দিয়ে, লাখো শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে যার সৃষ্টি। এই দুই অঘটন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধক। পঁচাত্তরের কুশীলবরা চেয়েছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রটির সকল অর্জন ধূলিসাৎ করা যাবে। তারা চেয়েছিল, মুসলমান প্রধান একটি জনপদে, সকল অর্থে, বঙ্গবন্ধু যে আধুনিক এবং জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পত্তন করার বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছেন, তাকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে মারা যাবে। কিন্তু তা ঘটেনি।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স ৫৩ বছর অতিক্রান্ত। এরই মধ্যে পাঁচ যুগ পার হয়েছে। নতুন নাগরিকরা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও খেলাধুলায় তারা অবাক করা সাফল্য দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই নতুন নাগরিকদের নানা রাষ্ট্রীয় অন্তরায় লক্ষ্য করতে হচ্ছে। তারা দেখছে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গ্রাস করার চেষ্টা করছে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। তারা দেখছে, রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। মুক্তচিন্তা, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের আদি উপাদান, সেটিও গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছে উগ্রবাদী ও ধর্মান্ধরা। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুবাদে এসবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করছে এক-দুটি বড় রাজনৈতিক দল।
কাজেই মূলে ফিরে যেতে হবে। মৌল সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। কয়েকটি নির্বাচনী সফলতা বা গণতান্ত্রিক বাগাড়ম্বরে এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয়। বুঝতে হবে, স্বাধীনতার কিছুুকাল পর থেকেই জাতিকে পরিকল্পিত পন্থায় বিভাজিত করা হয়েছে, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিমূল থেকে ক্রমশই দূরে সরানো হয়েছে। অথচ সকলেই জানি,

জাতীয় ভিত্তিমূলে ফিরে যেতে না পারলে মৌলিক সংকট দূর হবার নয়।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র শাসন করেছে অবৈধ সেনাপতি শাসকরা, কিংবা তাদের হাতে গড়া হঠাৎ গজানো রাজনীতিবিদরা। এ সময়ে বাংলাদেশের সীমানায় নতুন করে ‘নতুন পূর্ব পাকিস্তান’ তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। এসব শাসকের হাতে রাষ্ট্রের স্থপতি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন; উপেক্ষিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও আদর্শ। ফলে গজিয়েছে নানা পরগাছা। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি খুঁটি গেড়ে বসেছে। ধনেজনে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সবই করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, যাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় লাখো মানুষের আত্মদানের মুক্তিযুদ্ধ, যে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা বাঙালি জাতীয়তবাদী শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল।
নানা পালাবদলের পর ১৯৯০ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আশাজাগানিয়া গণতান্ত্রিক নবযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সে যাত্রা মসৃণ হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রধান কারণ এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার প্রশ্নে ইতিহাস ও ন্যায়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের আবির্ভূত করেছিল কিছু নব্য প্রতিষ্ঠিত সেনাপতি- রাজনীতিবিদ ও তাদের দল। এরা অস্বীকার করে গেছে বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তিযুদ্ধকে; আঘাত হেনেছে বাঙালি সেক্যুলার সমাজশক্তির প্রতিটি স্তম্ভে।
কিন্তু ইাতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এই বিরূপ মনোভাবে জাতি লাভবান হয়নি। বরং সংকট ঘনীভূত হয়েছে, জাতি উত্তরোত্তর বিভাজিত হয়েছে। একের পর এক সংকট গ্রাস করেছে রাষ্ট্রকে, সমাজকে। দুর্ভাগ্যজনক এই প্রক্রিয়ায় দেশের স্বাধীনতার চিহ্নিত প্রতিপক্ষরা শক্তি সঞ্চয় করেছে। তারা একাত্তরের পরাজয়ের শোধ নিতে প্রস্তুত হয়েছে।
সকলের আরো জানা যে, শত প্রতিবন্ধকতার পরও ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠেকানো যায়নি, বিচার ঠেকানো যায়নি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের। দেরিতে হলেও ইতিহাসের অমোঘ সত্যগুলো কষাঘাত করেছে। জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠিগুলো নিরন্তর বিষবাষ্প ছড়ালেও নতুন প্রজন্মের বৃহৎ অংশ মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের প্রতি আস্থাশীল হয়েছে। এই নতুন মানুষরা বিকৃত জাতীয় ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায় ও সত্যের পক্ষ নিতে চায়, যা বড় ইতিবাচক অগ্রগতি। অন্যদিকে নানা আঘাতে দীর্ঘকাল পর্যুদস্ত থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তাদের শক্তিকে অদূর ভবিষ্যতে খর্ব করা যাবে, ভাবা ঠিক নয়। যদি কেউ এমনটা ভাবে, তা হবে তাদের ব্যর্থ উপলব্ধি।
রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, সে কারণেই, আরো একটি গুণগত পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। পুরনো ব্যর্থতা ও কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়। আমার বিশ্বাস, পরিবর্তনের এই ধারাটির সূচনা করে দেশের রাজনীতিতে সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা যেতে পারে, জাতীয় ঐক্যের পথে বড় বাধাটি দূর করা যেতে পারে। এ পরিবর্তনের মূল শর্ত- অতীতের কলঙ্ক ঝেরে ফেলে নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ঐতিহাসিক মহিমায় গ্রহণ করা, তাঁর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জ্ঞাপন করা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী পাকিস্তানি তস্করদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আকণ্ঠ সমর্থন দান করা।
রাজনীতিতে সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করা অপরাধ কিছু নয়, যদিও ঐতিহাসিক সত্য এই যে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং আজো নানা সংকট-সীমাবদ্ধতার পরেও অসাম্প্রদায়িক সমাজ শক্তির নেতৃত্ব দান করছে। কাজেই অপরাধ হচ্ছে, এই দলটির বিরোধিতার নামে জাতির জনককে অবজ্ঞা করা, তাঁরই মুখ্য নেতৃত্বে সংগঠিত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উপেক্ষা করা, বিতর্কিত করা এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে আঁতাত করে জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও রক্তস্নাত ইতিহাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।
আমি জানি না এই আত্মঘাতী চেতনার ধারকরা তাদের দীর্ঘকালের কলঙ্কময় অবস্থান পাল্টাবে কিনা, রাষ্ট্রবিরোধী জামায়াতসহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চেতনাবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গ ছাড়বে কিনা। যদি করে তা হবে রাষ্ট্রের বড় লাভ। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় সমঝোতার প্রধান শর্ত হচ্ছে- নিঃশর্ত এবং পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক সততা ও আবেগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রহণ করা, একই সঙ্গে জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা। যতদিন না এ কাজটি করা সম্ভব হবে ততদিন সংকট জিইয়ে থাকবে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবর্ষিকী পালিত হয় প্রতি বছর। কেবল আওয়ামী লীগ নয়, সমাজের নানান মত-পথ থেকে ‘জাতীয় শোক দিবস’-এর অনুষ্ঠানমালা পালিত হয়। কিন্তু এতকিছুর পরেও জাতীয় ঐক্যের সঠিক উপলব্ধিতে আসতে পারেনি কিছু দলগোষ্ঠী। পারলে দীর্ঘকালীন সংকটের বড় বাধাটি দূর করা সম্ভব হতো। সকলকে পূর্ণ উপলব্ধিতেই বুঝতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দলের নেতা নন, ইতিহাস পরিক্রমায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা, জাতির জনক। কাজেই জনককে উপেক্ষা করে জাতীয় এক্য গঠন বাস্তব সম্মত নয়। যদি কেউ তা করার চেষ্টা করেন, তাহলে তা অবশ্যই ষড়যন্ত্রমূলক এবং প্রতিরোধ যোগ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মানার প্রধানতম শর্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমহিমায় গ্রহণ করা, মুক্তিযুদ্ধকে তার অবিকৃত ইতিহাসে বরণ করা। এর ব্যতিক্রম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর যারা দলীয় অনুসারী, তাদেরও উচিত হবে জাতির জনককে গণ্ডিবদ্ধ না করা, সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ এই বাঙালিকে সর্বজনীন করা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়