ঢাবি ছাত্র রহিম হত্যা মামলা : চব্বিশ বছর পর সাত জনের যাবজ্জীবন

আগের সংবাদ

ঈদযাত্রায় এবার স্বস্তির আশা

পরের সংবাদ

চট্টগ্রাম বীর চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের তিনটি পৃথক পর্বে বীর চট্টলার ভূমিকা ইতিহাস খ্যাত। তাই তো ছোটবেলায় শোনা সেই গান আজও হৃদয়ে স্পন্দন তোলে, ‘জালালাবাদের পাহাড়েতে রক্তে লিখেছি কত নাম, চট্টগ্রাম বীর চট্টগ্রাম’।
১৮৫৭ সালে প্রথম সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে বঙ্গদেশের পশ্চিম বাংলার ব্যারাকপুরে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ সিপাহিদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ইংরেজবিরোধী প্রকাশ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশ নেয় বিদ্রোহী সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে। তাকে নিবৃত্ত করতে আসা ইংরেজ অফিসার অ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট বাগ এবং সার্জেন্ট মেজরকে প্রকাশ্যে হত্যা করে মঙ্গল পাণ্ডে বিদ্রোহের সূচনা করে। তার সঙ্গীদের বিদ্রোহে অংশ নেয়ার ডাক দিলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। একার পক্ষে সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। তাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে আত্মসমপর্ণের নির্দেশ দিলে নিজ বন্ধুকের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আহত মঙ্গল পাণ্ডেকে সুস্থ করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ইংরেজদের নির্দেশ পালন না করার অপরাধে অপর সিপাহি ঈশ্বরী পাণ্ডেকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা বঙ্গদেশে হলেও তার ধারাবাহিকতা অন্য কোথাও ঘটেনি। একমাত্র সংঘটিত হয়েছিল চট্টগ্রামে। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের ৩৪ নম্বর রেজিমেন্টের সিপাহিরা পরাভূত করেছিল ইংরেজ বাহিনীকে। আত্মসমর্পণকারী ইংরেজরা প্রাণ বাঁচিয়ে সমুদ্রে নোঙর করা মালবাহী জাহাজে করে পলায়ন করে। ওদিকে বিদ্রোহী সিপাহিরা কারাগার ভেঙে সব বন্দিকে মুক্ত করে। ব্যারাক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অস্ত্রাগার বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। সরকারি অর্থ ও অস্ত্র তিনটি হাতি ও দুটি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে বিদ্রোহের নেতা হাবিলদার রজব আলী খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে দিল্লির সিপাহিদের সাথে মিলিত হওয়ার অভিপ্রায়ে রওনা দেয়। ইংরেজ শাসনমুক্ত ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে দিল্লি যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়। সীতাকুণ্ডের পাহাড়ের পথ দিয়ে ত্রিপুরা পৌঁছানো মাত্র ইংরেজদের নির্দেশে ত্রিপুরার রাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। অর্থ, হাতি, জনবলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিদ্রোহীরা নিরুপায়ে কুমিল্লা হয়ে মণিপুর রাজ্যের দিকে রওনা হয়। কিন্তু সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মেজর বাইঙ্গের নেতৃত্বে সাঁজোয়া বাহিনী। ক্লান্ত-অবসাদে সিপাহিরা অসম ওই যুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করে মেজর বাইঙ্গকে হত্যা করে। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে বেঁচে যাওয়া কিছু সিপাহি আত্মরক্ষার্থে লাতু এবং মণিপুরের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে ঢুকে যায়। তাদের শেষ পরিণতির বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে চট্টগ্রামের সিপাহি বিদ্রোহের।
১৯৩০ সালে সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিদ্রোহ, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, জালালাবাদ পাহাড়ে, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অবিস্মরণীয় স্মারক। সূর্য সেন তার বন্ধু অনুপম সেন, নগেন সেন, অম্বিকা চক্রবর্তীকে নিয়ে গড়ে তোলেন স্বদেশী বিপ্লবী দল। বহরমপুর কলেজ থেকে বিএ পাস করে সূর্য সেন চট্টগ্রাম ফিরে যোগ দেন উমাতারা হাই স্কুলে গণিতের শিক্ষক পদে। সাদামাটা ভগ্নস্বাস্থ্যের নিরীহ গণিত শিক্ষক সূর্য সেন ছাত্রসহ সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন মাস্টার দা নামে। তাকে দেখে কারও বোঝার উপায় ছিল না দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ সংগ্রামী এই মানুষটি কঠিন সংকল্পে দৃঢ়। নির্মল সেন, প্রমোদরঞ্জন চৌধুরী, অনন্ত সিংহ, আশরাফউদ্দিন, গণেশ ঘোষ প্রমুখদের নিয়ে গড়ে তোলেন গোপন সশস্ত্র বাহিনী। দান ও চাঁদা সংগ্রহ করে কলকাতা থেকে অস্ত্র ক্রয় করে এনে চালু করেন প্রশিক্ষণ শিবির।
১৯১৯ সালে পারিবারিক চাপে পুষ্পকুন্তলাকে বিয়ে করলেও সংসার ধর্ম পালন করা তার সম্ভব হয়নি। বৃহত্তর সশস্ত্র সংগঠন গড়ার অভিপ্রায়ে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির অর্থ লুণ্ঠন করা হয় ১৯২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হন সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী এবং কলকাতা থেকে অনন্ত সিংহ। কিন্তু তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের অভাবে ঔপনিবেশিক সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯২৬ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতায় পুনরায় গ্রেপ্তার হয়ে মেদিনীপুর, মুম্বাই রত্মগিরি জেলে দুই বছর কারাভোগ করেন সূর্য সেন। ওদিকে মরণাপন্ন স্ত্রীকে দেখার জন্য এক মাসের জন্য প্যারলে মুক্তি পান। স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পর সূর্য সেন এবং তার সঙ্গীরা কারামুক্ত হন। কুস্তি, লাঠিখেলা, বন্দুক চালানোসহ সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তোলেন। ১৯২৯ সালের মে মাসে নেতাজী সুভাষ বসু চট্টগ্রাম এলে সূর্য সেনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী সামরিক কায়দায় তাকে অভিবাদন জানায়। সূর্য সেন অহিংস আন্দোলনে আস্থা না রাখলেও ছদ্মবেশে জাতীয় কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছিলেন।
লাহোর জেলে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ফুঁসে ওঠে। আইরিশ বিপ্লবীদের আদলে সূর্য সেন গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। প্রায় একই সময়ে ভগৎ সিং গড়ে তুলেছিলেন আরো অগ্রসর চেতনায় ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান সোশ্যালিস্ট আর্মি।
অনুশীলন এবং যুগান্তর দলের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটনের আলোচনা করলেও তাদের অসম্মতিতে ইংরেজ শাসনের অবসানে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন সূর্য সেন। চট্টগ্রাম অক্সিলারি ফোর্সের, পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার দখল এবং শহরের তিনটি বন্দুকের দোকান লুণ্ঠন করা হয়। চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে ধুম রেলস্টেশনের রেললাইন, ফিসপ্লেট উপড়ে এবং চট্টগ্রামের সব টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে সেনার ছদ্মবেশে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুণ্ঠন করে। পুলিশ লাইনে উড়তে থাকা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে এবং সেখানে উড়ানো হয় ভারতীয় জাতীয় পতাকা। অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্র দখলে নিলেও গুলি না থাকার কারণে অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। অগত্যা অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রামের ব্রিটিশদের সব ঘাঁটি বিপ্লবীদের দখলে চলে আসে। চট্টগ্রাম শহরে ব্রিটিশবিরোধী প্রচারপত্র বিলি করা হয় এবং প্রচারপত্রে জনসাধারণকে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
ব্রিটিশ বাহিনী মালবাহী জাহাজে করে পলায়ন করে এবং জাহাজ থেকে কলকাতায় চট্টগ্রামের ঘটনা সবিস্তারে জানিয়ে দেয়। বিপ্লবীরা ক্রমাগত অনেক অপারেশন সফল করলেও অনিদ্রা, ক্লান্তি ও ক্ষুধা-পিপাসায় ফতেয়াবাদ পাহাড় থেকে খিচুড়ি খেয়ে চট্টগ্রাম শহর দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু বিলম্ব হওয়ার কারণে এবং সকাল হয়ে আসায় পরিকল্পনা পেছানো হয়। ২২ এপ্রিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় জালালাবাদ পাহাড়ে আত্মগোপনের পর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহর দখলাভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওদিকে দু’জন রাখাল পাহাড়ে উঠলে তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়। এই সংবাদ শোনামাত্রা মাস্টার দা ভয়াবহ পরিস্থিতি আঁচ করলেও ঠান্ডা মাথায় অম্বিকা চক্রবর্তী, লোকনাথ বল এবং নির্মল সেনকে নিয়ে আগত বিপদ সম্পর্কে পরামর্শ করেন।
মাস্টার দার আশঙ্কা অমূলক ছিল না। বেলা ৩টায় রেলপথে ট্রেন এসে থামে এবং অগণিত ব্রিটিশ সেনা জালালাবাদ পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে ফেলে। হালকা অস্ত্র নিয়ে ভারী মেশিনগানের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ শুরু হয়। বিপ্লবীরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অসম যুদ্ধে অনেক ব্রিটিশ সৈন্য প্রাণ হারায়। বিপ্লবীদের সাহস ও ক্ষিপ্রতায় ইংরেজ বাহিনী সন্ধ্যার পর পর রণে ভঙ্গ দিয়ে দ্রুত ট্রেনযোগে পালিয়ে যায়। জালালাবাদ পাহাড়ের ঐতিহাসিক এ যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেয় লোকনাথ বলের কিশোর ভাই হরিগোপাল বল টেগরা, নির্মল লালা, প্রভাস বল, পুলিন ঘোষ, নগেন রায়, বিধু ভট্টাচার্য, ত্রিপুরা সেন, শশাঙ্ক দত্ত, জীতেন দাশগুপ্ত ও মধুসূদন দত্ত। জীবিত ও আহত ৪০ জন বিপ্লবী দলটি চট্টগ্রাম শহর দখলের পরিকল্পনা ত্যাগ করে দু’ভাগে ভাগ হয়ে লোকালয়ে মিশে যায়।
আত্মগোপনে থাকা মাস্টার দা পুনরায় বিপ্লবীদের সংগঠিত করে চট্টগ্রামজুড়ে গেরিলা আক্রমণে ব্রিটিশদের তঠস্থ করে তোলেন। চোরাগুপ্ত হামলা; খণ্ড যুদ্ধ অবিরাম চালিয়ে যান। চট্টগ্রাম কারাগার ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে বন্দিদের মুক্ত করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এক বিপ্লবী ধরা পড়ার কারণে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সূর্য সেনকে

ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে আক্রমণ পরিচালিত হয়। এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ এবং বোমা মেরে ফুর্তিরত ব্রিটিশদের হতাহত করার পর, গুলিবিদ্ধ প্রীতিলতা ধরা পড়ার আশঙ্কায় বিষপানে আত্মহত্যা করেন। সূর্য সেনের দলে নারী সম্পৃক্তি ব্রিটিশদের ভাবিয়ে তোলে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ স্বদেশি বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরের সাহায্যে ধরা পড়েন সূর্য সেন ও ব্রজেন সেন। গহিরায় সম্মুখ যুদ্ধে ধরা পড়েন তারকেশ্বর দস্তিদার। ১১ মাস মামলা চলার পর সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ফাঁসির রায় বাস্তবায়নের দিনটিতে সারা চট্টগ্রামে কারফিউ জারি করা হয়। ১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ সূর্য ওঠার পূর্বে দ্রুত তাদের ফাঁসি কার্যকর করে মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরের গভীরে নিয়ে ভাসিয়ে দেয় ব্রিটিশ শাসকরা। মৃত সূর্য সেনকে নিয়ে পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা মুক্ত ছিল না।
সূর্য সেনের নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রাম আত্মত্যাগ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বীর চট্টগ্রাম।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে সেনা-জনতা সম্মিলিতভাবে ঘটিয়েছিল পূর্বেকার স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পুনরাবৃত্তি। ইতিপূর্বে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবে চট্টগ্রামের সিপাহিদের বীরত্বের ধারাবাহিকতায় ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল তিন দিন চট্টগ্রাম ছিল স্বাধীন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। চট্টগ্রামে ওই তিন দিন ব্রিটিশের পতাকার পরিবর্তে উড়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা। একইভাবে ৭১-এর ২৫ মার্চ পরবর্তী তিন দিন হানাদার পাকিস্তানি জান্তা মুক্ত ছিল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সর্বত্র উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র-সংবলিত জাতীয় পতাকা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিশ্চয় ঘটে না। কিন্তু চট্টগ্রামের ইতিহাসে তিন পর্বের ঘটনার যোগসূত্রতা অস্বীকারও করা যাবে না। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের তিন পর্বের সদৃশ চট্টগ্রামের জন্য যেমন ঐতিহ্যের। তেমনি আমাদের ভূখণ্ডের জন্যও গৌরবের।
একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে অবাঙালি বিহারি অধ্যুষিত পাহাড়তলীর ওয়্যারলেস কলোনি, শেরশাহ কলোনি এবং ফিরোজশাহ কলোনির অবাঙালিদের বাঙালিবিরোধী নির্মম তাণ্ডবে স্থানীয় বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা-সমর্থনে, এমনকি অস্ত্র জোগানের মাধ্যমে অবাঙালি বিহারিদের দৌরাত্ম্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না। কৈবল্যধাম মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা-লুণ্ঠন চালায় তারা। ২ ও ৩ মার্চ রেলওয়ে কলোনি, ওয়্যারলেস কলোনি এবং শেরশাহ কলোনি এলাকায় চট্টগ্রামের সামরিক প্রশাসক কর্নেল ফাতেমির নেতৃত্বে পাঠান সেনারা এবং অবাঙালি বিহারিরা যৌথভাবে বাঙালিদের আবাসে-স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, নারী-শিশু নির্বিশেষে বাঙালি হত্যা সংঘটিত করে। চট্টগ্রামে মার্চের শুরু থেকেই ঘটতে থাকে এমনি নানা অঘটন। অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল-অবরোধে বিস্ফোরণোন্মুখ চট্টগ্রামে গঠিত হয় ‘চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ’। স্বাধীনতার জন্য চট্টগ্রাম কলেজ এবং মেডিকেল কলেজের মাঠে শুরু হয় রাজনৈতিক দীক্ষা ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। অগণিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতা প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রশিক্ষণ হয় আগ্রাবাদ স্কুল মাঠে, কলোনি মাঠে, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর প্রাঙ্গণে। নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের আদেশ-নির্দেশেই একাত্তরের মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে চট্টগ্রামের পুরো প্রশাসন পরিচালিত হয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ-ভূমিকা ছিল না।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে সেনানিবাস, ইপিআর, পুলিশ লাইনসহ দেশজুড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা শুরু করে নারকীয় গণহত্যা। নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ন্যায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসেও চালিয়েছিল একই কায়দায় গণহত্যা। প্রকৃতপক্ষে মার্চের শুরুতেই চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ২ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সর্বস্তরের জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করা সম্ভব হয়নি। বন্দরে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় ছাত্র-জনতা চট্টগ্রাম রেডিও অফিস থেকে দেওয়ানহাট মোড়সহ বন্দরে আসা-যাওয়ার সকল পথে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল। জনতার সুকঠিন বেষ্টনী ভেদ করে সোয়াত জাহাজের অস্ত্র স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগারে এবং ঢাকার সেনানিবাসে নেয়া সঙ্গত কারণেই সম্ভব হয়নি।
২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ঘুমন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণে হতবিহবল বাঙালি সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির মুখে আত্মরক্ষার্থে ক্রলিং করে কেউ অস্ত্র নিয়ে কেউবা অস্ত্র ছাড়াই রাতের অন্ধকারে পশ্চিমের পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে বহু কষ্টে মিরসরাই-সীতাকুন্ডের বিভিন্ন লোকালয়ে এসে আশ্রয় নেয় এবং স্থানীয় জনগণের কাছে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে। স্থানীয় মানুষ তাদের আশ্রয়, খাবার ও বিশ্রামের বন্দোবস্তে পূর্ণ সহায়তা করে। সকালেই লোকমুখে নৃশংস ঘটনার সংবাদ মিরসরাই-সীতাকুন্ড এলাকার সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পাওয়া বাঙালি সেনা সদস্যরা স্থানীয়দের মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে। ওদিকে হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পের জওয়ান এবং সেনানিবাস থেকে

ট্যাঙ্কের গোলা ও গুলির কবল থেকে বেঁচে পালিয়ে আসা সেনাদের সমন্বয়ে চট্টগ্রাম শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বস্তরের জনগণকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে লালদীঘি ময়দানে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানালেও; পরবর্তী সময়ে অপর এক ঘোষণায় তা বাতিল করে দেয়া হয়।
২৬ থেকে ২৮ মার্চ দুপুর পর্যন্ত সারা চট্টগ্রাম ছিল হানাদার পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত। চারদিকে চলছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৮ মার্চ ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ধরে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আগত বিশাল সাঁজোয়া পাকবাহিনীর আগমনের সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। শুভপুর ব্রিজ হতে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে এবং সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা, জোড়া আমতল, মাদাম বিবির হাট, ভাটিয়ারী, ফৌজদার হাট, নিউ পতেঙ্গা, পাকিস্তান বাজার, দক্ষিণ সলিমপুরের ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের সুবিধাজনক স্থানে সেনা ও ইপিআর জওয়ানদের সমন্বয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়া দলগুলো তাদের পরিমিত গুলি ও হালকা অস্ত্র নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু উপেক্ষা করে কুমিল্লা থেকে আগত পাকিস্তানি বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে লড়াই করেছিল। বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র এক-দুই ঘণ্টার বেশি তারা টিকতে পারেনি, পারা সম্ভবও ছিল না। প্রতিরোধ যুদ্ধ ত্যাগে সেদিন একজনেরও আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যাওয়ার নজির দেখা যায়নি। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে আত্মদান করেছিল দেশপ্রেমিক প্রতিরোধ যোদ্ধারা। হানাদার বাহিনী যেসব স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে সেসব এলাকা নির্বিচারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধের বাধা অতিক্রম করে কুমিল্লা থেকে আগত সাঁজোয়া পাকিস্তানি বাহিনী সন্ধ্যার পূর্বেই চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে পড়ে এবং ওই দিনই তিন দিনের পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত স্বাধীন চট্টগ্রামের পতন ঘটে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের তিন পৃথক পর্বে চট্টগ্রামের বীরত্বপূর্ণ অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সমুজ্জ্বল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়