সাংবাদিকদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

আগের সংবাদ

অর্থপাচার বাড়ছে যে কারণে

পরের সংবাদ

ব্যাংক একীভূত করে সংকট কাটানো যাবে কি?

প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২০, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বিলীন হতে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক। একীভূত হওয়ার পর এটি এক্সিম ব্যাংক নামেই কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ব্যাংক দুটি একীভূত হতে চুক্তি করেছে। এরপর তারা আবেদন করবে। তাদের প্রস্তাব অনুমোদিত হলে নিরীক্ষা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর একীভূত হওয়ার অনুমোদন দেয়া হবে। তখন নতুন একটি ব্যাংক চালুর অনুমতি দেয়া হলে বিলুপ্ত হবে পদ্মা ব্যাংক। তার আগ পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে চলবে ব্যাংক দুটি। পদ্মা ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে বারবার রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তবে চূড়ান্ত বিচারে তা কাজ করেনি। অনেকটা শুরু থেকেই সংকটে থাকলেও বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এই ব্যাংক। কিছু ব্যাংক একীভূত করার যে চেষ্টা শুরু করেছে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক, তার ফলে পদ্মা ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাদের সীমাহীন অনিয়মের কারণে একটি ব্যাংকের এই অবস্থা হলো, তাদের আদৌ কোনো শাস্তি হবে কিনা। পদ্মা ব্যাংকের ইতিহাস লজ্জার। এক দশক আগে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তাদের একটি ছিল পদ্মা ব্যাংকের পূর্বসূরি ফারমার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু থেকেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তারা, অনুমোদন পাওয়ার আগেই এটি কার্যালয় খুলে লোকবল নিয়োগ দিয়েছিল। প্রভাব ছড়িয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত নিয়েছিল ব্যাংকটি, চলেছে অনিয়ম-দুর্নীতি। ফলে খুব দ্রুতই সংকটে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মধ্যে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান। ব্যাংকটি তখন কার্যত ধুঁকছে। চারটি সরকারি ব্যাংক ও রাষ্ট্র খাতের ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) টাকা মূলধন হিসেবে জোগান দেয়া হয় ফারমার্স ব্যাংককে, এটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। যে ব্যাংকের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়াই ছিল যৌক্তিক উপসংহার, সেটিকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হয় রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রকের সিদ্ধান্তে। তবে ফারমার্স ব্যাংক আর্থিক খাতে এরই মধ্যে এতটাই দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে যে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এসে সেটির নাম পাল্টাতে হলো। ফারমার্স ব্যাংক কাগজে-কলমে আর সাইনবোর্ডে পদ্মা ব্যাংক হলেও এই ব্যাংকে গুণগত কোনো পরিবর্তন যে আসেনি, তা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। পদ্মা ব্যাংক যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করে নানা রকম ছাড় নিতে শুরু করেন। বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, এমন মুলা ঝুলিয়ে এসব সুবিধা আদায় করে ব্যাংকটি। কিন্তু প্রতিশ্রæত সেই বিনিয়োগ কখনই আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে পদ্মা আরো শুকিয়েছে। আর আস্থা হারিয়েছেন আমানতকারীরা। ঋণ খেলাপের কারণে প্রায় ডুবতে বসা ব্যাংকের উদাহরণ হলো সাবেক ফারমার্স ব্যাংক, বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংকটিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় কয়েকটি ব্যাংক থেকে তারল্য জোগানোর মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয় কয়েক বছর আগে। ব্যাংকটি এখনো ঝুঁকির বৃত্ত ভাঙতে পারেনি। এ রকম আর কোন কোন ব্যাংক ঝুঁকিতে রয়েছে, সেটি নিয়ে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আয় দিয়ে আর আমানতের সুদ পরিশোধ করতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। সুতরাং ‘বিশ্বস্ত অভিভাবকের’ দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি।
বাংলাদেশে ব্যাংকের পতন বিরল ঘটনা। কিন্তু পশ্চিমা আর্থিক জগতে এটা অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার। বাংলাদেশে দুর্বল ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে না কেন? এসব ব্যাংকের মালিক ও বড় গ্রাহকদের বেশির ভাগ সরকার ঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটা বড় প্রশ্ন। পদ্মা ও এক্সিম একীভূত হচ্ছে স্বেচ্ছায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি বছর স্বেচ্ছায় ব্যাংক একীভূত না হলে চাপ প্রয়োগ করা হবে। কর্তৃপক্ষ কোন কোন ব্যাংককে একীভূত করতে চায়, সেটি প্রকাশ করা হয়নি। তবে গভর্নর বলেছেন, ১০টি পর্যন্ত ব্যাংক একীভূত হতে পারে।
চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংক সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে। দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদ (ঋণ) কিনে নেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি)। ফলে একীভূত হওয়ার কারণে ভালো ব্যাংকগুলোর খারাপ হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা ভালো ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। গত জানুয়ারিতে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর বলেছিলেন, দেশের মোট ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮ থেকে ১০টি ব্যাংক একীভূত হতে পারে। একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। কিসের ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা হবে, খারাপ সম্পদের দায় কে নেবে এবং একীভূত হলে ভালো ব্যাংকগুলো খারাপ অবস্থায় পড়বে কিনা- এগুলো বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। আলোচনার সময় ব্যাংক খাতের সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা পথনকশার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। বৈঠকে বলা হয়, বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী চলতি বছরের আর্থিক তথ্যের ভিত্তিতে আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে দুর্বল ব্যাংকের ব্যবসা সীমিত করে দেয়া হবে। এরপরই ব্যাংকের একীভূত কিংবা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য এবং প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের কতটা ঘাটতি রয়েছে তার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, চলতি বছরের মধ্যে নিজের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে চাপ দিয়ে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে দেয়া হবে। দুর্বল ব্যাংক সবল করতেই একীভূত করার এই উদ্যোগ। তবে একীভূত হওয়ার কারণে কোনো ব্যাংক খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে না। কোন প্রক্রিয়ায় একীভূত হওয়ার কার্যক্রম পরিচালিত হবে, তা নিয়ে শিগগির নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক অধিগ্রহণ ও একীভূত হওয়া সারা পৃথিবীর একটি চর্চা। এ নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দুর্বল ব্যাংক শক্তিশালী করতে এই উদ্যোগ। শুধু দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে নয়, দুই সবল ব্যাংক আরো শক্তিশালী হতে একীভূত হতে পারে। যাদের বড় গ্রাহক রয়েছে, সেই গ্রাহকই সেই ব্যাংকের সম্পদ। ফলে সম্পদ খারাপ হলেও গ্রাহক দেখে কেউ দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। নিজের ইচ্ছায় ব্যাংক একীভূত হতে পারে, আবার চাপ দিয়েও এটা করানো হতে পারে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি ও নানা অনিয়মের কারণে বেশ কিছু ব্যাংক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কোন কোন ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে, এর তালিকা প্রকাশ না করলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব ব্যাংকের তালিকায় চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকও রয়েছে। এসব ব্যাংক বাছ-বিচার ছাড়াই বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্রাহকের আমানতের টাকা নির্বিচারে ঋণ দেয়ার কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চরমে। অনেক ক্ষেত্রে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে তারল্য সহায়তা নিতে হচ্ছে। বিলম্বে হলেও দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার ঘোষণা আসায় ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনাটি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি থেকে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের নিজেদের মতো করে একীভূত হওয়া বা করার আলোচনা শুরু করতে বলা হয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগেও সরকারের নানা পর্যায় থেকে ‘শক্তিশালী ব্যাংক খাত’ নিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা খাতটির সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে এলেও তা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে এত দিন। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই যখন এই সংস্কারের কথা বলছে তখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তারা এত দিন কী করেছিল। দেশের ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে। এখন ব্যাংক খাতে সংস্কার শুরু করতে হবে, এর বিকল্প নেই। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি বছরের আর্থিক তথ্যের ভিত্তিতে আগামী বছরের মার্চ থেকে দুর্বল ব্যাংকের ব্যবসা সীমিত করে দেয়া হবে। এরপরই একীভূত বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য ও সুশাসনে কতটা ঘাটতি রয়েছে তার ভিত্তিতে। ব্যাংকগুলোর ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এই নীতিমালা কার্যকর করা হবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা ছিল। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর বিষয়ে সামনে নতুন ঘোষণা আসবে আশা করছি।

রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়