সাড়ে ৩ মাস পর কারামুক্ত আলাল

আগের সংবাদ

নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের কোনো প্রশ্ন নেই : সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

ভাষার বিকাশ সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণে আন্তঃভাষার আন্তঃসংযোগ জরুরি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারাদেশে বেশ আড়ম্বরভাবেই এ দিবস পালিত হলো এবং সেটা যথার্থই কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত ছিল। বিশেষ করে, ১৯৯৯ সালে ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে এদিন শুধু বাংলা ভাষার জন্য নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে বসবাসরত প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের মাতৃভাষার দিবস হিসেবে পালিত হয়। ফলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন এখন আর সেই বেদনাবিধুর কিন্তু বিরোচিত স্মৃতিতর্পণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরঞ্চ, এদিন এখন বিশ্বব্যাপী বহু ভাষাভাষী মানুষের ভাষা চর্চা, বিকাশ, সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণের আকাক্সক্ষা, আবেদন এবং দাবি প্রকাশের দিনে পরিণত হয়েছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর এখন একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর সামনে হাজির হয়। যেহেতু ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পাওয়ার পেছনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত, ১৯৫২ সালের ভাষার আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ভাষা শহীদের আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য এবং মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রাজন্মিক দায়িত্বশীলতার ইতিবৃত্ত প্রভৃতি প্রধান ও মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল, সেহেতু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ও পালনের ক্ষেত্রে বাংলাভাষাসহ বাংলাদেশে প্রচলিত, কথিত ও চর্চিত অন্যান্য ভাষার বিকাশ, সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণের বিষয়টিও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়া জরুরি। এ নিবন্ধে ভাষার বিকাশ, সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণে আন্তঃভাষার আন্তঃসংযোগ কেন এবং কীভাবে জরুরি সেটা নিয়ে আমার কিছু চিন্তা-ভাবনা পেশ করা হয়েছে।
লেখা বাহুল্য, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই মোটাদাগে একটা ধারণা আছে কিন্তু আজকে ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পরে এসে আমার মনে হয় আমরা এর মূল তাৎপর্যটা খানিকটা ভুলতে বসেছি। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যখন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একতরফা ঘোষণা দিয়ে বাঙালির আবেগ, অনুভূতি এবং ভালোবাসার মাতৃভাষার টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল তখন বাংলার দামাল ছেলেরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল এবং মাতৃভাষার মান, মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল। সুতরাং মাতৃভাষার যে আবেদন, মাতৃভাষার যে প্রয়োজন এবং মাতৃভাষার যে সাংস্কৃতিক গুরুত্ব, সেটা শুধু বাঙালিদের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, সেটা অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। আর সেই কারণেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা বাংলা ভাষার চর্চা, বিকাশ, বিস্তার, সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণের কথা বলার পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার ভিন্ন ভাষাভাষীর ভাষার প্রতিও সমান মর্যাদা, সম্মান এবং অধিকারের প্রিত শ্রদ্ধাশীল হওয়া ঐতিহাসিকভাবে আমাদের একটি নৈতিক কর্তব্যকর্ম।
বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় ৫০টি জাতিসত্তার মানুষ বাস করে এবং তারা প্রায় ৪১টি ভাষায় কথা বলে। এই যে ভাষা বৈচিত্র্য, এটা যেমন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে, তেমনি ভাষার বৈচিত্র্যতা একটি শংকর জাতি হিসেবে বাঙালির সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের সঙ্গে বসবাসের যে উত্তরাধিকার, সেটাকেও প্রতিভাত করে। ফলে বাংলা ভাষা ছাড়াও এ দেশে যে আরো ৪১টি ভাষার প্রচলন আছে, তার অনেক ভাষা এখন সংকটের মুখে। বাংলাদেশে বসবাসরত ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি হচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নিজের ভাষায় পঠন-পাঠনের অধিকার এটি অন্যতম মানবাধিকার। ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের যে দাবি, সেটা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নমাত্রার ন্যায্যতা পায়। কিন্তু সেই ন্যায্যতা এবং যথার্থতা সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো যথাযথভাবে স্বীকৃত নয়। ফলে ৪১টি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ৪১টি স্বতন্ত্র, ভিন্ন এবং মৌলিক ভাষা সংরক্ষণের অভাবে আজ হুমকির মুখে, বিলুপ্তির মুখে এবং বিলীন হওয়ার সংকটের মুখে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বসবাসকারী ভিন্ন জাতিসত্তার প্রায় ১৩টি ভাষা বিলুপ্তির পথে। কারো কারো মধ্যে এ সংখ্যা আরো বেশি। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিভিন্ন সংকটের কথা নানাভাবে আলোচিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব ভাষা সংরক্ষণের, ভাষা বিকাশের, ভাষা অনুশীলনের এবং ভাষা সমৃদ্ধির কোনো চেষ্টা, উদ্যোগ এবং দায়িত্ববোধ আমরা খুব একটা লক্ষ করিনি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৭ সালে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি জাতিগোষ্ঠীর পাঁচটি ভাষায় মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। মহাধুমধাম করে ভিন্ন জাতিসত্তার শিশুদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় লেখা পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। কিন্তু নানা কারণে এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ শুধু পাঁচটি ভাষায় বই ছাপালে এবং সেটা বিতরণ করলেই মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম সফল হবে না। তার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার, প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার, পঠন-পাঠন পদ্ধতির যথাযথ পরিবর্তন দরকার এবং বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা প্রয়োজন। কিন্তু যথাযথ সমন্বয়ের অভাবে এ প্রকল্প খুব সফল হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তাছাড়া ৪১টি ভাষার মধ্যে কেবল ৫টি ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করলেই ভিন্ন জাতিসত্তার ভাষা সংরক্ষণের ও সুরক্ষার সুব্যবস্থা হয় না। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে এবং প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের কোনো মৌলিক তাৎপর্য থাকে না, যদি না ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের প্রতি এবং ভিন্ন ভাষার প্রতি আমরা একটা অন্তর্গত নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ববোধ উপলব্ধি না করি। এই উপলব্ধি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে কিংবা সরকারের নীতি গ্রহণ প্রক্রিয়ার ভেতরে হলেই চলবে না; এই উপলব্ধি জরুরি সমাজ-মানসে, সমাজ মনস্তত্ত্বে এবং মানুষের নৈতিক সংস্কৃতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের শক্ত পাঠাতনে।
এছাড়া এই কথা অনস্বীকার্য যে ভাষার সমৃদ্ধি, বিকাশ ও পরিবৃদ্ধি ঘটে অন্য ভাষার সংস্পর্শে অন্য ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদানে এবং অন্য ভাষার আন্তঃসংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পৃথিবীতে আজকে যেসব ভাষা বহুল চর্চিত, সমৃদ্ধ এবং বৃহত্তর পরিসরে বিকশিত, সেটা সম্ভব হয়েছে অন্য ভাষার সংস্পর্শে, অন্য ভাষার সঙ্গে আন্তঃসংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে এবং অন্য ভাষা থেকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী রসদ সংগ্রহের ভেতর দিয়ে। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব শক্তি এবং মৌলিক গুণ হচ্ছে, অন্য ভাষার সংস্পর্শে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করে, নিজের শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে এবং নিজের গঠন কাঠামো, চর্চা ও রীতিনীতিকে পরিশোধিত করে। ফলে অন্য ভাষার সঙ্গে আন্তঃসংযোগের মধ্য দিয়ে ভাষা সমৃদ্ধ হয়, বিকশিত হয় এবং বিস্তারিত হয়। তাই বাংলাদেশেও যে ৫০টি ভিন্ন জাতিসত্তার ৪১টি ভাষার চর্চা, বিস্তার ও সংরক্ষণে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি, বাংলা ভাষার সঙ্গে এসব ভাষার আন্তঃসংযোগ, পারস্পরিক যোগাযোগ এবং ভাষার মিথস্ক্রিয়ার পরিবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে বাংলা ভাষাও সমৃদ্ধ হতে পারে।
যেহেতু ভাষাকে বলা হয় সংস্কৃতির বাহন; ভাষাকে বিবেচনা করা হয় সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারের সোপান; সেহেতু ভিন্ন জাতিসত্তার ভিন্ন ভাষার চর্চা, সমৃদ্ধি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা, পরিকল্পনা, নীতি প্রণয়ন ও তার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সংস্কৃতিও অনিবার্যভাবে সমৃদ্ধ, বিস্তারিত ও সংরক্ষিত হবে। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সাংস্কৃতিক সত্তা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সুরক্ষিত হবে, যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের উত্তরাধিকার অটুট থাকবে, যা বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশে পরিণত করবে। তাই ভিন্ন জাতিসত্তার ভিন্ন ভাষা সংরক্ষণের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা একান্তই জরুরি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়