নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পেল চার হাজার শ্রমিক : গাজীপুর

আগের সংবাদ

গরম মসলার বাজার গরম

পরের সংবাদ

ভাষার অর্থমূল্যও জরুরি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভাষায় জবরদস্তি সফল হয় না, তা বায়ান্নতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটে ভাষায় জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড এখনো চলছে। একদিকে বলা হচ্ছে, বাংলায় ভিনদেশি শব্দ ব্যবহার বন্ধের কথা। অন্যদিকে স্বদেশি উদ্ভট-উৎকট শব্দ আরোপ থামছেই না। যেখানে-সেখানে ‘আজব-জটিল-অস্থির-সেরাম’ ধরনের আচানক স্বদেশি ভাষার ব্যবহার চলছে শিক্ষিত মহলেও। তা বাংলাকে হৃষ্টপুষ্ট করছে, না সর্বনাশ করছে- এ প্রশ্নের কিনারা করা দরকার।
বিশ্বায়নের যুগে ভাষার সীমানা নেই। তার ওপর বাংলা আন্তর্জাতিক ভাষা। সেখানে বাংলার বিস্তার ঘটানোর একটি অর্থনৈতিক চাহিদা থাকা জরুরি। চাহিদা থাকা মানে ব্যবহার বাড়ানো। আর ব্যবহার বাড়লে প্রেম ভালোবাসা বাড়বেই। জানতে কি ইচ্ছা হয় না- বিশুদ্ধতা ও জাতপাত খোয়ানোর পরও ইংরেজি ভাষা কেন বিশ্বময় এত প্রতিপত্তি বিস্তার করে চলছে? ইংরেজি জানা কেন সারা দুনিয়াতেই স্মার্টনেসের ব্যাপার? বিশ্বের অনেকে বাণিজ্যিক কারণে চীনা ভাষা শিখছেন। আগে শিখতেন কেবল পণ্ডিত বা ভাষাবিদরা। এখন শিখছে অনেক সাধারণ মানুষও। জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষা শেখার কারণ এমনই। হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্য তো চলছেই।
ভাষাকে একঘরে হয়ে যেতে হয় নানা কারণে। সময়-অসময়ে বিভিন্ন ভাষা নেতিয়ে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রায় একই। অনেকেই মানতে চান না ভাষার সঙ্গে কর্মসংস্থানসহ কর্মজগতের বিশাল সম্পর্কের কথা। মানুষ অজস্র ভাষা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পারে অপব্যবহারে, খামখেয়ালিতে ভাষার ছারখার করতেও। কোনো ভাষাকে শক্তিধর রাখতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দরকার। অথচ বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর কথাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেন অনেকে। শিক্ষিতদের কেউ কেউও এই পক্ষেই।
শঙ্কার বিষয়টা ভাষার স্বভাব নিয়ে। টিকে থাকা ও সম্বৃদ্ধতার প্রশ্নে সব ভাষার স্বভাবই এক। কোনো ভাষাই শুধু আবেগ, চেতনা আর ভালোবাসার ওপর ভর করে টিকে থাকে না। মূল ভিত্তির অক্ষুণ্নতা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি চায় সব ভাষাই। নয়তো দুর্বল হতে হতে একসময় পড়ে যায় তলানিতে। হারানোর ঝুঁকিতে। বিকৃতি আর শক্তিহীনতার কারণে পৃথিবীর একসময়ের শক্তিধর ভাষাগুলোরও কিছুটা দুর্বল হয়েছে। কিছু হারিয়েই গেছে। বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষায় মেসোডোনিয়ায় আজ ক’জনে কথা বলে? পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মপ্রণেতার অন্যতম যিশু খ্রিস্টের ভাষাও প্রায় বিলুপ্ত। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, আরেক বিশ্ববিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব অনন্তহীন। তা-ও আবার চলছে রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি। ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে এই মাপের আন্দোলন দুনিয়ার কোথাও হয়নি। তাই রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই বাংলার কোনো ক্ষতি হবে না- আশাবাদের এমন জিকিরতো করবই। এই জিকিরকে বাস্তব করার ফিকির অর্থাৎ সঠিক পদক্ষেপ না থাকলে নেই। বিশ্বের ২৫ কোটি লোকের ভাষাটি মোটেই ধনেজনে দুর্বল নয়। যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তার ওপর বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা অসীম। কিন্তু শুধু আবেগ, ভালোবাসা, চেতনায় ভাষা বা কোনো কিছুর শেষরক্ষা হয় না। হুকুম-হাকিমে ভাষা সাধন বা নিয়ন্ত্রণ হয় না। অথচ ভাষা প্রতিষ্ঠায় আমাদের আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। আদালত বলেছে বাংলায় সাইনবোর্ড নিশ্চিত করতে। ২০১৪ সালে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে এ মর্মে আদেশ জারি হয়। আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়। এ বিষয়ে যথেষ্ট তদারকিতে সরকারি দপ্তরের সাইনবোর্ড বা নামফলকের বেশির ভাগ বাংলায় রূপান্তর হয়েছে। বাংলায় সরবরাহের কারণে যানবাহনের ডিজিটাল নম্বরপ্লেটও অনেকটাই বাস্তবায়ন করা গেছে। তবে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি নামকরণ ঠেকানো যায়নি। তা আরো বাড়ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, দোকানপাট, শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক ইংরেজিতে লেখা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইংরেজির চাহিদা বেশি। ভোক্তা বা সেবাগ্রহীতাদের চাহিদার কারণেই তারা ইংরেজি ব্যবহার করছেন।
প্রয়োজনে না লাগলে কোনো কিছুরই ব্যবহার বাড়ে না। আর ব্যবহার না হলে বাড়ে না প্রেম-ভালোবাসাও। এটা মোটেই চেতনার বিষয় নয়। চাহিদাই মূল বিষয়। ভাষা হিসেবে বাংলা জীবন-জীবিকার সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত? ছোট্ট এ প্রশ্নটির জবাব খুঁজলেই মিলবে কেন ইংরেজির মতো বাংলার চাহিদা তৈরি হচ্ছে না? আমরা সেটা তৈরি করতে পারিনি। সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই চাহিদা তৈরি করতে না পারায় মার খাচ্ছে বাংলা। সেখানে হরদম ঢুকে পড়ছে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি শব্দ। এটা মোটেই প্রেম বা চেতনার ঘাটতির কারণে নয়। বাংলার প্রতি কোনো অশ্রদ্ধার কারণেও নয়। কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লীগ, পার্টি, ফেডারেশন, ফোরাম, ফ্রন্ট, কমিটি, কমিশন, ইলেকশন, সিলেকশন, ভোট, মিটিং ইত্যাদি মানের বাংলা শব্দ আজো প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলন করা যায়নি। সেই চেষ্টাও কাক্সিক্ষগত পর্যায়ে নয়। আবেগ-চেতনা থাকলেও বাংলার উপযোগিতা তৈরি করতে না পারার এ কুফল ভুগতেই হচ্ছে আমাদের।
রিজিকের তাগিদে আমরা ইংরেজিকে ব্যবহার করি। আর ভালোবাসি বাংলাকে। ঘর-সংসারের জন্য উপযুক্ত একজন, ভালোবাসার জন্য আরেকজন- এই বাস্তবতায় চলে গেছে বাংলা। মোটকথা বাংলা আর বাঙালকে একই দশায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই রোগের ও সুযোগেই হয়েছিল বাংলা সাবান, বাংলা কলা, বাংলা কালি, বাংলা মদ, বাংলা টাকা নামকরণ। এমন নামকরণে নিকৃষ্টই করা হয়েছে বাংলাকে। সাবান, কলা, কালি, মদ, টাকার মধ্যে নিকৃষ্ট বা কমদামিগুলোর আগে কুবুদ্ধিকরেই সাঁটানো হয়েছিল বাংলা শব্দটি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সহ দর্শন, ইতিহাসের বাংলা বইগুলো কি মানসম্পন্ন? বাংলা বইয়ের মাধ্যমে এসব বিষয় বোঝার চেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন। ইংরেজিকে পাস কাটানোর কারণে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ভালো করে বোঝা সম্ভব নয়। উল্টাপাল্টা বোঝার ঘটনাও ঘটছে। ল্যাটকা আবেগে শিক্ষামাধ্যম থেকে ইংরেজি শিক্ষা খেদানোর জের কেবল শিক্ষায় নয়, প্রশাসন, বিজনেস হাউসেও পড়ছে।
খাঁটি বাংলা ব্যবহারে ভুলের ছড়াছড়িও কম নয়। প্রয়োজনের বাইরে মানসিক সমস্যাও পিছু ছাড়ছে না। বক্তৃতা, ভাষণ, টিভির টকশোর আলোচনায় পর্যন্ত ইংরেজি-বাংলার উদ্ভট মিশ্রভাষা বুঝিয়ে দেয় মাতৃভাষা বাংলাকে আমরা কী চোখে দেখি। সমসাময়িক তরুণ প্রজন্ম এর প্রয়োগ করতে গিয়ে লিখিত-মৌখিক দু’ভাবেই এমন সব উদ্ভট শব্দ ছড়াচ্ছে, যা বাংলার জন্য রীতিমতো আতঙ্কের। গল্প-কবিতাসহ উপন্যাস, চলচ্চিত্র-নাটকেও তা সংক্রমিত। সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমগুলো ভাষাকে শক্তিশালী করা ও সঠিকভাবে ব্যবহারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ভাষার শুদ্ধরূপ প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম অভিধানের চেয়েও শক্তিশালী। অনেকের বাড়িতেই এখনো অভিধান নেই। থাকলেও সেটা পড়ে থাকে বইয়ের তাকে বা শোকেসে অনাদরে। কিন্তু রেডিও, টিভি বা পত্রিকাহীন কোনো ঘরবসতি বাংলাদেশে নেই। অথচ গণমাধ্যমে প্রায়ই বাংলার করুণ দশা দেখতে-শুনতে হয়। এসবের যোগফলে বাংলার প্রমিত বাচনিক রূপটি মোটামুটি হারাতে বসেছে। রূপ নিয়েও মতভেদ। এতে লেখ্য বাংলার অবস্থা নড়বড়ে। বানান নিয়ে অরাজকতা। বাক্য নিয়েতো রীতিমতো নাশকতা। উচ্চারণে দুরবস্থা। ব্যাকরণের ধোপে টেকে না এমন বাংলা অহরহই চোখে পড়ে। এ নিয়ে কিছু বললে বিরক্ত হন সহকর্মীদের অনেকেও। এতে কোথাও বাধা না পড়ায় বাহবাও পান। ঠিকভাবে দুই শব্দ বাংলা লিখতে জানেন না, কিন্তু মস্ত বাক্যবাগীশের দেখা মেলে অহরহ।
প্রয়োজন এবং চাহিদাই বড় কথা। আরো পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, জীবিকা ও অর্থনৈতিক চাহিদার নিশ্চয়তা দরকার ভাষায়ও। স্রোতের এ ঢেউ লেগেছে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রেও। বিশেষ করে ব্যাংক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণের নমুনা ভাবনার বিষয়। আপ-ডাউন ছাড়া দেশে এখন উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমসহ প্রায় সবদিকের ব্যাংক-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। এদিক-সেদিক, অন্যদিক কোনো দিকই আর বাদ নেই। আবার রয়েছে দুই দিক মিলানো নামও। নর্থ-সাউথ, ইস্ট-ওয়েস্ট, সাউথ ইস্ট ঠিক থাকলে নর্দার্ন, সাউদার্ন, ইস্টার্ন ইত্যাদি নাম বাদ থাকবে কেন? এদিক-সেদিক বাদ দিয়ে কোনো কোনো বিনিয়োগকারী অন্যদিকেও ছুটেছেন। দেশ-মহাদেশ এমনকি বিশ্বও টেনে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি নামের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। শুধু কি দেশ? বিশ্ববিদ্যালয় আছে উপমহাদেশ, মহাদেশ, আন্তঃদেশ, এমনকি আন্তঃমহাদেশের নামেও। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতো মোটামুটি নামকরাই। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ- নামটি শুনে বাংলাদেশ কি কোনো ফেডারেল রাষ্ট্রের স্টেট বা অঙ্গরাজ্য- এমন প্রশ্ন করে পাত্তা পাবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এরকম নামের কিছুবিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির মতো কিছু করে দুধের স্বাদ আমরা ঘোলে মেটানোর চেষ্টা আছে। তা শখে বা খামখেয়ালিতে নয়। বাংলার প্রতি অবজ্ঞার কারণেও নয়, অনিবার্য প্রয়োজনেই।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়