নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পেল চার হাজার শ্রমিক : গাজীপুর

আগের সংবাদ

গরম মসলার বাজার গরম

পরের সংবাদ

বাংলা ভাষাচর্চায় এবার আসুক আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্য

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এই ভাষা দিবস অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই হয় মহাবিপদ। শোরগোল পড়ে যায় অপার বাংলাজুড়ে। সারাদিন তারস্বরে উচ্চারিত হয় আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী লিখিত ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরকৃত গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত পাঁচজন শহীদের নাম বেশি শুনতে পাই- সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। যদিও সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। আমিই আরো তিনজনের নাম পেয়েছি- আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিন। সে যাক, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। আড়ালে চলে গেছে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৬৫ তারিখে চেন্নাইয়ে তামিলদের ভাষা আন্দোলনে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু, ১৯ মে, ১৯৬১ তারিখে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষা আন্দোলনে ৯ জনের মৃত্যু, ১৬ জুন, ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটোতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে ২০০ জনেরও অধিক মানুষের মৃত্যু। আসলে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন একটি রাষ্ট্রের জন্মদানের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বলেই এই স্বীকৃতি।
ভাষা দিবসে বহু তাত্ত্বিক, তার্কিক, বিশেষজ্ঞ, ভাষাপ্রেমী তাদের বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন, কিন্তু তাতে নবীন প্রজন্মের ভাষাচর্চার সামান্য কেশদামও কর্তিত হয় না। কারণ ভাষা এক চলমান নদীর মতো। নদীর রূপ যেমন অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়, ভাষাও তাই। অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত হয়। নদীর কিছু প্রবাহ অগ্রগতির সঙ্গে বিলুপ্ত হয়, একইভাবে কিছু ভাষার মৃত্যু হয় চর্চাকারীর বিলুপ্তিতে। ১৭৭৭ সালে ডলি পেনট্রিথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কর্নিশ ভাষা। কিন্তু এক সময়ে ইংল্যান্ডে অন্যতম প্রচলিত ভাষা ছিল প্রাচীন কর্নিশ ভাষা। ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আন্দামানের বোয়া সিনিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে ‘বো’ ভাষাও হারিয়ে যায়। তিনি সেই শেষ ব্যক্তি, যিনি আন্দামানের ‘বো’ ভাষায় কথা বলতেন। ১৯৯২ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হান্স জুর্গেন স্যাসে তার, ‘ভাষার মৃত্যুর তত্ত্ব’ গবেষণাটি প্রকাশ করেছিলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী দ্বিভাষিক হলে বুঝি কোনো একটি ভাষা অবহেলিত হয়। চিকিৎসা ও ভাষাবিজ্ঞান প্রমাণ করছে, একটি ভাষা অন্যের সম্পূরক, শত্রæ নয়। কোনো একটি ভাষা, কখনই অপর ভাষাকে এক্কেবারে মেরে ফেলে না। বাস্তব উদাহরণ হাতের নাগালেই আছে। আমাদের (ধরা যাক ‘ক’ প্রজন্ম) সবার পরিবারের পরের প্রজন্ম (‘খ’ প্রজন্ম) কেউ না কেউ থাকে অন্য রাজ্যে অথবা বিদেশে। সেসব জায়গায় অফিসে, বাজারে, পথেঘাটে, সামাজিক মেলামেশায় তাকে ব্যবহার করতে হচ্ছে ইংরেজি অথবা হিন্দি। বাংলা খুব কম, হয়তো মুষ্টিমেয় বন্ধুর সঙ্গে বা বাড়িতে। ফলে পরের প্রজন্মের (‘খ’ প্রজন্ম) সন্তানদের (‘গ প্রজন্ম’) মধ্যে ভাষা নিয়ে দুটি বিষয় ঘটতে পারে। একটি হলো তারা তার পিতৃপ্রজন্মের ভাষা পুরোপুরি ত্যাগ করে স্থানীয় ভাষা ও অন্য কাজের ভাষা শিখল। একে বলা হয় ‘ভাষা পরিবর্তন’ বা ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শিফট’। দ্বিতীয়টি হলো এই ‘গ’ প্রজন্ম, ‘ক’ ও ‘খ’ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে বাংলা কিছুটা শিখল, হয়তো বলতেও পারে। কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে ভীষণভাবে ঢুকে পড়ল অন্য ভাষা। বাংলা ক্রমে হারিয়ে যেতে লাগল। এই তত্ত্ব অনুযায়ী একে বলা হয় ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ডিকে’ বা ‘ভাষার ক্ষয়’।
ভাষা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই শতাব্দীর শেষে প্রচলিত অর্ধেক ভাষার মৃত্যু সুনিশ্চিত। ঠিক এই কারণেই সারা পৃথিবীর একমাত্র ভাষার ভিত্তিতে জন্ম নেয়া দেশ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন দিবস অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অন্য কোনো দেশের ভাষা আন্দোলন দিবসকে নয়। কিন্তু বাংলা ভাষা বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? বাংলা ভাষার কিন্তু একটি মাত্র রূপ নেই। এই ভাষায় ‘রাঢ়ী’, ‘বঙ্গালী’, ‘বরেন্দ্রী’, ‘কামরূপী’, ‘ঝাড়খন্ডী’- মোট পাঁচটি উপভাষা চিহ্নিত হয়েছে। অঞ্চলভেদে কেন ভাষা বদলে যায়? ভাষাবিদরা মনে করেন, ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং ভূপ্রকৃতির নির্দিষ্ট যোগসূত্র রয়েছে। এরা মানুষের বাকযন্ত্রের ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। বাংলার লোকভাষার মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক, লোকতাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের ছাপ। এর একটা দারুণ উদাহরণ দিয়েছেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। একটা বাক্য অঞ্চলভেদে কীভাবে পাল্টে যায়, দেখুন।
১. ‘রাঢ়ী’ অঞ্চল : (কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলা)
ক) কলকাতা : অ্যাক জন লোকের দুটো ছেলে ছিল।
খ) তমলুক : অ্যাক ব্যক্তির দুইটা পুত্রা থাইলা।
গ) ক্যানিং : অ্যাক্টা লোকের দুটো ছাবাল ছ্যালো।
২. ‘বঙ্গালী’ অঞ্চল : (ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম)
ক) ময়মনসিংহ : একজনের দুই পুৎ আছিল।
খ) নোয়াখালী : অ্যাকজন মাইনষের দুগা হোলা আসিল্।
গ) চট্টগ্রাম : অ্যাগুয়া মাইনষের দুয়া ফুয়া আসিল্।
৩. ‘বরেন্দ্রী’ অঞ্চল : (মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা)
ক) মালদা : অ্যাক ঝন মানুসের দুটা ব্যাটা আছল।
খ) দিনাজপুর : অ্যাক জন মানুষের দুই ছাওয়া ছিল।
গ) পাবনা : কোনো মানষের দুই ছাওয়াল ছিল।
৪. ‘কামরূপী’ অঞ্চল : (কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রংপুর, ত্রিপুরা, উত্তর দিনাজপুর, কাছার)
ক) জলপাইগুড়ি জেলা : অ্যাক ঝনকার দুই ঝন ব্যাটা আছিল্।
খ) রংপুর জেলা : অ্যাকজন মানষের দুইকলা ব্যাটা আসিন্।
গ) কোচবিহার জেলা : অ্যাক জনা মানসির দুই কোনা ব্যাটা আছিল্।
৫. ‘ঝাড়খন্ডী’ অঞ্চল : (মানভূম, সিংভূম, ধলভূম, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর)
ক) পূর্ব মেদিনীপুর : গোতে লোকের দুইটা তোকা থিলো।
খ) পশ্চিম মেদিনীপুর : অ্যাক লোক্কার দুট্টা পো থাইল।
গ) মানভূম : অ্যাক লোকের দুটা বেটা ছিল।
পড়তে গেলে বোঝা গেলেও শোনার সময় এই আঞ্চলিক উপভাষা অনেক সময় অবোধ্য ও অসভ্য মনে হয়। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষাচর্চাই ভাষার চালিকা শক্তি। মানুষ যদি আঞ্চলিক ভাষা পরিত্যাগ করে তবে আঞ্চলিক ভাষার মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়বে। সিলেট এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলাদেশের সব আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় সর্বাধিক দুর্বোধ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় সুদূর অতীতে পুঁথি-সাহিত্যও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ওইসব পুঁথি গ্রন্থগুলো দেবনাগরী বর্ণমালার আদলে কথিত সিলেটি নাগরী লিপিতে যা এখন বোঝার মানুষ নেই। চট্টগ্রামের ভাষা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে বলা তো পরের কথা বোঝাও প্রায় অসম্ভব। কালের বিবর্তনে চট্টগ্রামের আদি ভাষার অনেক শব্দই ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। তার প্রধানত কারণটি হচ্ছে অতি-আধুনিকতার স্থূল প্রবণতা। এখন বাবা-মায়েরাই উৎসাহ দিচ্ছেন না। গল্পটা আমার এক বন্ধুর থেকে শোনা, সেটা বলি। এক সন্তান মাকে বলছে, ‘ওমা আঁই আজিয়া স্কুলত জাইতান ন।’ শুনে মা আঁতকে উঠে ছেলেকে তীব্র তিরস্কারে বলে ওঠেন, ‘তুমি চিটাগাইংগা কথা বলছ কেন, তোমাকে না শুদ্ধ কথা বলতে বলেছি, এখন থেকে আর চিটাগাইংগা কথা বলবে না, শুদ্ধ কথা বলবে বুঝেছ।’ অর্থাৎ মা-বাবারা আঞ্চলিক ভাষা পরিত্যাগে সন্তানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আঞ্চলিক ভাষা ত্যাগে বাধ্য করে চলেছেন। যেটা আত্মঘাতী বলা যায়।
অনেকে বলেন আঞ্চলিকতার বৃত্তে আটকে থাকা সংকীর্ণতা। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষারূপ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করা আরো বড় মাত্রার হীনম্মন্যতা। আঞ্চলিক ভাষা টিকে থাকার একমাত্র উপায়টি হচ্ছে তার চর্চা অব্যাহত রাখা। কিন্তু এখানে একটা মস্ত দ্বিচারিতা আছে। তা হলো আঞ্চলিক বাংলার লিখিত সাহিত্য চর্চা। কবিতা দু-চার পিস বেরোলেও গদ্য প্রায় নেই বললেই চলে। এর ওপরে আঞ্চলিক ভাষা মুখে মুখে ব্যবহার বন্ধ হলে ক্ষতি কিন্তু বাংলা ভাষার। বাংলা ভাষা নিয়ে অহেতুক জ্ঞানবাণী বিতরণ আমাদের মজ্জাগত। যারা এটা দেন তাদের খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যে তারা তাদের আঞ্চলিক ভাষায় ক’টা রচনা উপহার দিয়েছেন। এখানেও এক মস্ত ধোঁয়াশা আছে। জয় গোস্বামী বলেছেন, ‘নানা বৈচিত্র্য সমন্বিত যে বাংলা ভাষা, সেটাই আমার মতে মান্য বাংলা ভাষা। বিভিন্ন অঞ্চলের উচ্চারণের ফারাকের সমন্বয় করেই একটি মান্য বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছে।’ আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘আপনারা যাকে মান্য বাংলা ভাষা বলেন, আমরা এপার বাংলায় তাকে বলি প্রমিত বাংলা ভাষা। তবে বিষয়টা একই। লেখার ক্ষেত্রে একটা বাংলা ভাষা ব্যবহার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। লেখক তার লেখায় চরিত্রের মুখ দিয়ে আঞ্চলিক ভাষা বলাতেই পারেন। কিন্তু সাহিত্যে লেখকের নিজস্ব লেখনী মান্য বাংলা ভাষায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’ কিন্তু একটা কথা আশা রাখি সবাই শুনেছেন যে এখন মানুষ পড়ছেন না। বই মানুষে আগের মতো পড়েন না। ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তব কি তাই? আসলে মানুষ গতানুগতিক প্রমিত বা মান্য ভাষাকে সে অর্থে মান্যতা দিচ্ছে না। তারা চাইছে যে তাদের ভাষায় সাহিত্যচর্চা হোক। সাহিত্যে উঠে আসুক আঞ্চলিক উচ্চারণ। উঠে আসুক রকের ভাষা। নোয়াখালীর তরুণ প্রজন্ম শুনতে চাইছে কবি বলুক-

বুকের মইদ্দে সুগন্ধি রুমাল থুই বরুণা কইছিল,
যেইদিন আঁরে হাঁচা হাঁচা ভালোবাইসবা
হেদিন আঁর বুকেও এমিক্কা আতরের গেরান অইবো!
কিন্তু আমরা আজো উচ্চারণ করছি- বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল-। এটুকু বুঝুক এখনকার কবি-লেখকবৃন্দ ও ভাষার উত্তরাধিকার বহনকারীরা।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়