১৪ মাস পর ঢাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন

আগের সংবাদ

চলচ্চিত্র উৎসবে বিচারক বাঁধন

পরের সংবাদ

বাংলা ভাষার জন্য জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধুকন্যার অবদান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘মোদের গরব, মোদের আশা; আ-মরি বাংলা ভাষা’ অতুল প্রসাদ সেনের এই কথা প্রতিটি বাঙালিরই মনের কথা। মা, মাটি আর মুখের বোল- এই তিনে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। নিজের মুখের ভাষার চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু তাদের সেই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে, ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এককথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত।
২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে বাঙালির দেয়া রক্ত আজ বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যা সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের গুণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ ইতিহাস আবহমানকাল শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে।
১৯৯৯ সালেই ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মনে হতে পারে, এসব কিছুই ঘটে গেছে রাতারাতি। কিন্তু এদিনটিকে ইউনেস্কোর কাছে তুলে ধরতে, তাৎপর্য বোঝাতে, বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনাকে যে কত প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটা কাজ করতে হয়েছে, তা অনেকেরই অজানা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার দায়িত্ব পালনের সময় (১৯৯৬-২০০১) জননেত্রী শেখ হাসিনা একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন কানাডার দুজন বাঙালি প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তবে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বেসরকারি ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। অনুরোধ/প্রস্তাব একটি সদস্য রাষ্ট্র থেকে জমা দিতে হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন, তখন খুব বেশি সময় বাকি নেই। আসলে হাতে ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আওয়ামী লীগ সরকার তখন প্রবাসীদের নেতৃত্বাধীন ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং প্রস্তাবনাটি ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউনেস্কোর কাছে প্রেরণ করে। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের মিশনগুলোকে অন্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি এই প্রস্তাবটির জন্য তাদের সমর্থন চাওয়া হয়েছিল।
ফলস্বরূপ, ’৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাবটি পাস হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালে থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘উর্দু ভাষাকে’ একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হলো তীব্র গণআন্দোলন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানে প্রত্যয়ী ছাত্র সমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে সরকারের নির্দেশে পুলিশ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে নিহত হয়। অতঃপর ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (বাংলা ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) অধুনা বাংলাদেশের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, যার স্বীকৃতি পরবর্তীকালে পথ দেখালো সারা পৃথিবীকে, হয়ে রইল এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিল। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে এই দিনটি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেই। কারণ, এ তো শুধু বাংলা ভাষার আন্দোলন নয়, মায়ের ভাষা, গানের ভাষা, আবেগের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় শহীদদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু মাতৃদুগ্ধকে করিয়েছিল স্মরণ প্রতিটি বাংলা ভাষীর মনেপ্রাণে।
ভাষার ঐক্য, সম্প্রীতি, ভাষার মৌলিক অধিকার শিক্ষা, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ এবং সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা- এই দিকগুলোর প্রতি নজর রাখার সময় এসেছে হয়তো। কারণ বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ আনুমানিক ৬ হাজার ভাষায় কথা বলেন। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ; কমবেশি আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা রাজ্য, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আবার আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা হলো দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্য এই নয়, অন্য ভাষাভাষীদের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। পরিবর্তে শুধু এই বিষয়টার প্রতি নজর দেয়া, বিভিন্ন ভাষাভাষী যত মাতৃভাষা রয়েছে, সেগুলোর গুণমান ও উৎকর্ষ তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ।
এই ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন ভারত ও বাংলাদেশের দুই জাতীয় সংগীত, ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে….’ আর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি….’।
নিজের ভাষা নিয়ে বাঙালির গর্ব যতই থাক, পরিস্থিতির চাপে সেই ভাষার সর্বাত্মক চর্চায় বাঙালি আজ ব্যর্থ। বাংলার প্রতি এই অবহেলা কেন? উপলব্ধির অন্তর্লোকে উঁকি দিলে দেখা যাবে এই অবহেলার মূল কারণ প্রতিযোগিতা আর পেশার তাড়না। যার সামর্থ্য বা সুযোগ আছে, তার মধ্যেই নিজের সন্তানকে বাংলা মাধ্যমের বদলে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থাটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলানির্ভর। সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমও বাংলাই।
বাংলাকে শিক্ষা ও পেশার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করে তোলার প্রয়াস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে কেউ চাইলেই বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিদ্যা, কারিগরি বা প্রযুক্তি বিদ্যা, আইন বা অন্য কোনো বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাংলায় চালানো সম্ভব নয়। ইংরেজির বাইরে রুশ, জার্মান, জাপানি, ¯প্যানিশ, ফরাসি ইত্যাদি ভাষায় প্রায় সব ধরনের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। নিজেদের মাতৃভাষাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারের ভাষা করে তুলতে পেরেছেন তারা। তারা নিজ ভাষায় বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারছেন। তারা মাতৃভাষায় স্বচ্ছন্দে প্রকৌশল বিদ্যা পড়তে পারছেন। আমরা মাতৃভাষাকে নিয়ে সেভাবে এগিয়ে যেতে পারিনি।
একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আমাদের স্বকীয় চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে চাইলে তার উপযুক্ত পরিভাষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সেই শপথ নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলেই বাংলা সর্বস্তরে ব্যবহারযোগ্য ভাষা হয়ে উঠতে পারবে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভাষা হিসেবে বাংলার এই প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি, যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষী জনগণ সেই ভাষার নামে একটি দেশ পেয়েছে; সেই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ সব ভাষাশহীদকে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বাস্তবায়ন করা গেলেই ভাষাশহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো সার্থক হবে ও বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবদীপ্ত ঐতিহাসিক দিন। এ দিবসে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালোবাসবে, তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশকে চেতনায় ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ।

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়