নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে মুগদা থেকে গ্রেপ্তার ১

আগের সংবাদ

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে তোলার চেষ্টা : সুফল মিলবে কি?

পরের সংবাদ

ঔপনিবেশিকতা সংস্কৃতির শত্রæ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঔপনিবেশিকতার একটা রাজনৈতিক রূপ আছে। বর্তমান সময়ে এটিকে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলি। কিন্তু এর ভেতরে যেটা আছে- সেটা হলো পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদটাই হচ্ছে আসল বিষয়, যেটা ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, পুঁজিবাদ ও সংস্কৃতি পরস্পরবিরোধী। পুঁজিবাদ যে ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টি করেছে সেটা সংস্কৃতির বিকাশকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে এবং সংস্কৃতি যে বিকশিত হয়েছে সেটা এই ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই। কাজেই ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সংস্কৃতির সংগ্রাম অত্যন্ত বাস্তবিক সংগ্রাম।
পুঁজিবাদ যে কাজটা করে, তা হচ্ছে মানুষের ওপর নিপীড়ন, লুণ্ঠন করে, দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যায় এবং দারিদ্র্যের সৃষ্টি করে। দারিদ্র্য সৃষ্টি হলে সংস্কৃতি বিপন্ন হয়। পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিকতা দ্বিতীয় যে কাজটা করে সেটা হলো তাদের সংস্কৃতিতে অন্য দেশের সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আরো একটা কাজ করে, সেটা হচ্ছে সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কৃতিও পণ্যে পরিণত হয়। কাজেই ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সংস্কৃতির দ্ব›দ্বটা একেবারেই অবশ্যম্ভাবী। সংস্কৃতি বিকশিত হয় পুঁজিবাদ বিরোধিতার মধ্য দিয়েই। কীভাবে এই ঔপনিবেশিকতা কাজ করে? স্বাভাবিকভাবে তারা একটা কাজ করে, সেটা হচ্ছে ব্যবস্থা। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের দেশে এসেছিল ব্যবসার নাম করে। তখন ব্যবসা মানেই ছিল লুণ্ঠন। সেই ধারা এখনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো ব্যবসা মানেই হলো লুণ্ঠন। তারা আরেকটি অস্ত্র ব্যবহার করে, সেটা হচ্ছে বন্দুক। এছাড়া আরো একটি অস্ত্র ব্যবহার করে সেটা হচ্ছে ভাষা। তারা নিজেদের ভাষাকে চাপিয়ে দেয় যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে সেই মানুষদের ওপরে। আমাদের দেশেও সেই ঘটনা ঘটেছে। তারা ইংরেজি ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
এ ব্যাপারে এখানে আমি দুটি ঐতিহাসিক উদাহরণ দেব। একটি হচ্ছে শেকসপীয়রের নাটক বিষয়ে। টেম্পেস্ট নাটকে প্রসপেরো নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে একটা দ্বীপে গিয়ে উঠেছে। সেখানে এরিয়েল এবং ক্যালিভেন- এ দুজনকে পেয়েছে সে। এরিয়েল গাছের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, তাকে মুক্ত করেছে প্রসপেরো। ক্যালিভেন হচ্ছে ওই দ্বীপের আদি মালিক, যে এরিয়েলের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আমরা দেখব সেই দুজনকেই তার ভাষা শিখিয়েছে। এরিয়েলের ভাবটা উড়– উড়–, এরিয়েলকে দেখা যায় না, সে উড়ে বেড়ায় এবং সে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। সে মনে করে যে, একদিন সে স্বাধীন হবে। এই স্বাধীনতার জন্য সে প্রভু প্রসপেরোর সেবা করে। প্রসপেরোর হয়ে ক্যালিভেন যে বিদ্রোহী- তার ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন চালায় এবং ক্যালিভেনকে বাধ্য করে প্রসপেরোর পক্ষে কাজ করতে।
এই যে এরিয়েলকে আমরা দেখছি- এটা কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্র। এটা কেবল যে ওই নাটকের মধ্যে আছে তা নয়। এটা সব দেশেই আছে, আমাদের দেশেও আছে। এই এরিয়েল হচ্ছে সেই শ্রেণি, সেই মধ্যবিত্ত- যা ঔপনিবেশিক শাসকরা এসে তৈরি করেছিল। এদের আমরা ‘মীরজাফর’ বা অন্য নামেও ডাকতে পারি। এরা তাঁবেদার। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। এটা সেই শেকসপীয়রের সময়- সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি করেছে শেকসপীয়র। তিনি দেখিয়েছেন যে, এরিয়েল তৈরি হলো সে প্রভুর সেবা করবে এবং সে একদিন স্বাধীন হবে- এরকম স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু আশঙ্কার কাজ হচ্ছে ক্যালিভেন- যে ওই দ্বীপের মালিক তার ওপর নির্যাতন করে।
শেকসপীয়রের এই নাটক লেখার ১০০ বছর পর আমরা একটা উপন্যাস পাই। ডেনিয়াল ডিপোর ইংরেজি উপন্যাস রবিনসন ক্রুসো। এই রবিনসন ক্রুসো একটা দ্বীপে গিয়ে বসবাস করছেন এবং ওইখানে ফ্রাইডে বলে একজন মানুষকে পেয়ে গেলেন। তাকে ক্রুসো ইংরেজি ভাষা শেখাবেন এবং ক্রুসোর উন্নত সংস্কৃতিতে দীক্ষিত করলেন তাকে। তাকে খ্রিস্টান বানানো, লবণ খেতে শিখানো, জামা কাপড়ের ব্যবহার শিখানো। আমরা ফ্রাইডের চরিত্র পেলাম। উপনিবেশ কীভাবে কাজ করে? একভাবে কাজ করল এরিয়েলের মধ্যে, আরেকভাবে কাজ করল ফ্রাইডের মধ্যে। ফ্রাইডের চরিত্রটা এরিয়েলের চরিত্র থেকে আলাদা। এরিয়েল হচ্ছে মধ্যবিত্ত, ফ্রাইডে হচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত। এ দুটো শ্রেণি কিন্তু আমাদের দেশেও আছে। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত যারা স্বাধীনতার কথা ভাবেন- যাদের উড়– উড়– ভাব, যারা বিদেশে যায়, যারা ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা নেয়, যারা বিদেশে ঘোরাঘুরি করে- তারা এরিয়েলের মতো। তারা প্রভুর সেবা করে মনে করে তারা খুব স্বাধীন আছে। আর যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত-ফ্রাইডে- সে ওই প্রভুকে রবিনসন ক্রুসোকে প্রভু বলে গণ্য করে, তার পায়ে মাথা ঘষে, তার ভাষার অনুকরণ করে। সে নিজেকে সবসময় একটা সেবাদাসে পরিণত রাখে। এভাবে সাংস্কৃতিক যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা- সেই প্রতিষ্ঠার এই দুটি উদাহরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি চরিত্র আমাদের দেশেও ঐতিহাসিকভাবে আছে। তখনো ছিল, এখনো আছে। আমরা এটাও দেখব, যে ইংরেজরা আমাদের এ ভারতবর্ষে আসত- বিশেষ করে যারা আইসিএস অফিসার হয়ে আসত তাদের ইংরেজি সাহিত্যে একটা পরীক্ষায় পাস করে আসতে হতো। ইংরেজি সাহিত্য তখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু আইসিএস হতে হলে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করে আসতে হতো। কেন? কারণ দুটো। একটা হচ্ছে এই যে- আইসিএস অফিসাররা আসবে এই উপমহাদেশে, এসে তারা যেন নিজেদের ছোট মনে না করে। কেননা ভারতবর্ষের যে ঐতিহ্য, যে প্রাচীন সংস্কৃতি- সেটা অত্যন্ত গৌরবের ও পুরনো। ইংরেজদের ওই সংস্কৃতি ছিল না। তারা দ্বীপের মানুষ। সেই তুলনায় এ উপমহাদেশের সংস্কৃতি অনেক উন্নত ছিল। এর স্থাপত্য, এর ভাস্কর্য-সাহিত্য-সংগীত অনেক উচ্চস্তরের ছিল। ইংরেজদের ধারণাটা ছিল- এই আইসিএস তরুণ অফিসাররা যখন ভারতবর্ষে যাবে অর্থাৎ এই ভারতবর্ষে আসবে- তখন তারা বড়াই করার মতো একটা বস্তু যেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। সেই বস্তুটা হচ্ছে ইংরেজি সাহিত্য। যে কারণে তাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়ানো হতো। দ্বিতীয় কারণ হলো তারা এখানে এসে যেন সাহিত্য পাঠ থেকে আনন্দ গ্রহণ করতে পারে। স্থানীয় যে সংস্কৃতি, স্থানীয় যে গান-বাজনা, যে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক তৎপরতা সেটা যেন তাদের প্রভাবিত না করে। অর্থাৎ একদিকে এ সাহিত্য তাদের গৌরবান্বিত করবে, অন্যদিকে এ সাহিত্য তাদের আচ্ছাদন হিসেবে রক্ষা করবে। যেন তারা স্থানীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ না করে। এই দুই উদ্দেশ্যে তাদের ইংরেজি সাহিত্য শিক্ষা দেয়া হতো।
এ দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, এখানে ভাষার কত গুরুত্ব, ভাষা কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে তা বোঝানোর জন্য। আমাদের দেশে ইংরেজরা এলো, ইংরেজি চালু হলো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের যারা রেনেসাঁসের নায়ক ছিল বলে আমরা বলি- তারা খুব একটা ভালো কাজ করেছেন। তা হচ্ছে তারা বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। কিন্তু এখানে আরেকটা ঘটনা আছে। এই যে রামমোহনের মতো এত বড়মাপের মানুষ সবাইকে ছাড়িয়ে উঠেছিলেন তিনি- সেই রামমোহন কিন্তু এ দেশে নীল চাষের সমর্থক ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজরা এসে এখানে বসবাস করুক। যাতে করে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওই যে এরিয়েলরা, ওই যে মধ্যবিত্তরা, ওই যে ইংরেজি শিক্ষিতরা- তারা যাতে উন্নত হতে পারে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার সমর্থক ছিলেন রামমোহন- এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর সত্য। আমরা অসাধারণ মানুষ বিদ্যাসাগরকে দেখব যিনি সমাজ সংস্কার করছেন, বিধবা বিবাহ দিচ্ছেন, সাহিত্য সৃষ্টি করছেন, যিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। তিনিও কিন্তু ব্যক্তি ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, ব্যক্তি ইংরেজকে চটি জুতো দেখিয়েছেন। কিন্তু ইংরেজের যে আধিপত্য, তার বিরুদ্ধে তিনি বলেননি। ‘বাংলার ইতিহাস’ নামে বিদ্যাসাগরের একটা ছোট বই আছে। যেটি মার্কসম্যান নামক এক ইংরেজ লিখেছিলেন। সেটিকে বিদ্যাসাগর যখন অনুবাদ করলেন তখন সেই অনুবাদে তিনি সিরাজুদ্দৌলার চরিত্রকে মার্কসম্যান যতটা না খারাপ করে দেখিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি খারাপ করে দেখিয়েছেন।
তাহলে আমরা দুটো জিনিস দেখছি। একদিকে সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, যেটাকে আমরা বলছি নবজাগরণ আসছে। আমরা দেখছি সমাজের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে ইংরেজ যে বড়, উপনিবেশ যে বড়, ঔপনিবেশিকরা যে আমাদের অনেক উপকার করছে- এই বার্তাটাও ভেতরে ভেতরে চলে গেল। এই বার্তাটাই হচ্ছে সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সেটা অত্যন্ত গভীরে গেছে। এই হীনম্মন্যতাবোধ এখনো আমাদের আছে- যেটা এরিয়েলের ছিল। সেখান থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। আমরা মাইকেল মধুসূদন দত্তকে দেখব। এক অসাধারণ মানুষ তিনি। তিনি তো ইংরেজ হওয়ারই চেষ্টা করলেন। তিনি ধর্মান্তরিত হলেন, ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করবেন বলে ভাবলেন। তিনি মহাকাব্য লিখলেন, নাটক লিখলেন, কবিতা লিখলেন। কিন্তু তিনি বিদ্রোহ করলেন বাংলা ভাষার চর্চা করে। তবে ইংরেজি যে শ্রেষ্ঠ ভাষা বা সাহিত্য- সেই বোধটা তার মধ্যেও ছিল।
যে কথাটা এর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে সেটা হলো এ ঔপনিবেশিকতা স্থানীয় সংস্কৃতিকে, জাতীয় সংস্কৃতিকে নিপীড়ন করে কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, নিপীড়ন করে আদর্শগতভাবেও। এই আদর্শগত ভাবটা হচ্ছে, আমি যে পুঁজিবাদের কথা বলছিলাম, সেই পুঁজিবাদ মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। সেই পুঁজিবাদ আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি করে, ভোগবাদিতা তৈরি করে। আমরা বিচ্ছিন্নতা দেখছি আমাদের সমাজে। আমরা দেখছি ভোগবাদিতার চরম বিকাশ ঘটছে আমাদের সমাজে। এই যে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা, এটিই হচ্ছে সংস্কৃতির শত্রæ। ভোগবাদিতাই হচ্ছে সংস্কৃতির শত্রæ। ঔপনিবেশিকতা ওই কাজটাই করছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়