দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : ৬ আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতি প্রত্যাখ্যান সরকারের

আগের সংবাদ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া বার্তা

পরের সংবাদ

সংখ্যালঘুদের দেয়া অপূরণীয় প্রতিশ্রুতি কি এবার পূর্ণ হবে?

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৫, ২০২৪ , ১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা বহু দেশ, ব্যক্তি ও দলের মুখে প্রায় ঝামা ঘষে দিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেখিয়ে দিল যে সেখানে আস্ফালন স্বাভাবিক নিয়মে থাকলেও তারা গণতান্ত্রিক। ভোট বয়কটের ডাক, সহিংসতা ও ভীতি কাটিয়ে প্রায় ৪১.৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ বড় একটা আসেনি। এবারের নির্বাচনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে মোট ১৪ জন জয়ী হয়েছেন। এদের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৩ জন ও ১১ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের। ৭ জন হিন্দু ও ১ জন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রার্থী হেরে গেছেন। জয়ী ১১ জন হিন্দু প্রার্থীর মধ্যে ২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন। এরা হলেন সুনামগঞ্জ-২ আসনে জয়া সেনগুপ্ত ও বরিশাল-৪ আসনে পঙ্কজ নাথ।
২০১৮-এর নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৮ জন প্রার্থী জয়ী হয়ে সংসদে যান। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৮ জন প্রার্থী জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হন। কিন্তু এবার হলেন ১৪ জন। কমে গেল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করার মতো। এবারের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চারজনসহ ২০ জনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। আরো ৮ জন সংখ্যালঘু প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করায় এবার সংখ্যালঘু প্রার্থী ছিলেন ২৮ জন। অথচ ২০১৯-এর নির্বাচনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৯, যা এবার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। যদি জনগণনা হিসাব করা যায়, তা হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের পর প্রথম জনগণনা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। সেই বছর বাংলাদেশে হিন্দুদের হার ছিল ১৩.৫০ শতাংশ। ১২ বছর আগের জনগণনায় বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.১৮ কোটি। এটা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.৬ শতাংশ। সম্প্রতি যে জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭.৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে দ্রুত হারে কমছে হিন্দু সংখ্যা। বাংলাদেশে এবারের ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত ভোটার ছিলেন ১২ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ। তার মধ্যে হিন্দু ভোটার প্রায় ১ কোটির সামান্য কম। কাজেই বাংলাদেশের ১৫ বছর রাজত্ব করা শাসক দলের প্রতি প্রশ্ন রাখাই যায়, গত ১৫ বছরে তাদের প্রতি ‘কমিটেড’ হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমেই কি কোণঠাসা হয়ে পড়ছে না? বাংলাদেশের হিন্দুরা যে সমস্যাজর্জর তা বলতে দ্বিধা নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে সব নাগরিকের সমানাধিকারের কথা। অথচ অন্যান্য বৈষম্যের কথা না বলে একটি উদাহরণ দিয়ে রাখি। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেট ছিল ১৫ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ হলো ২৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের ১.৯৩ শতাংশ (তথ্য সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার, ২৯/০৫/২০২১)। অথচ বাংলাদেশে ভারত তথা মোদিবিদ্বেষ ক্রমেই তীব্রতা পেয়েছে এই অভিযোগে যে ভারতে মুসলমানরা নিগৃহীত হন। এই বিদ্বেষ আরো তীব্রতা পাবে আগামী ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পরে। কিন্তু মন্দিরের অদূরেই অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে ভারতের বৃহত্তম মসজিদ। আদালত নির্দেশিত ১৫ একর জমি বাড়িয়ে সরকার প্রদত্ত ৪০ একর জমিতে তৈরি হচ্ছে মসজিদ। কিন্তু সেই সত্য তুলে ধরবে কে? কাজটা যে কোনো দেশের সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের। পাকিস্তানের মতো মধ্যযুগীয় দেশেও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় আছে। অথচ বাংলাদেশে আজো নেই। তাই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিজেদের খুব নিরাপদ মনে করতে সংশয়ী।
২০১৮ সালে নির্বাচনের ইশতেহারে শাসক আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ৭টি প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। কিন্তু তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রæতিও ছিল ইশতেহারে। হয়নি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জমি, জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। আজো হয়নি। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, দলিত ও চা-শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। তাও হয়নি। সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। অথচ গত পাঁচ বছরেও অনেক মন্দির এবং প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। ২০০১-এর নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের করুণ কাহিনি, ২০১২ সালে রামু থেকে ২০২১-এ কুমিল্লায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বীভৎস ঘটনাবলি, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে নিরপরাধ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ধর্ম-অবমাননার মিথ্যা অজুহাতে কারারুদ্ধ করার নিষ্ঠুরতা এখনো সংখ্যালঘু জনমানসে দগদগে ঘায়ের মতো বিরাজমান। কুমিল্লা-৬ আসনে এবারে নির্বাচিত শাসক দলের প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তার বিরুদ্ধে ২০২১-এ হিন্দু নির্যাতনের ঘটনায় অভিযোগ আছে। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমান, যিনি শিক্ষক শ্যামল ভক্তের ওপর নির্যাতনের অপরাধে অভিযুক্ত। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা ও হুমকির অনেক উদাহরণ আছে, যা সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত করে রাখে।
গত নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি না রাখা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ার সম্প্রতি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের যে প্রতিশ্রæতি আছে, তার প্রতিটি বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। যেমন আইনগুলো প্রণয়ন করা, কোনোটা সংসদে আছে, কোনোটা আইন মন্ত্রণালয়ে আছে, কোনোটা বিল আকারে পেশ হয়েছে, কোনোটা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পেন্ডিং (ঝুলে) আছে। কিছুই হয়নি- এটা বলা যাবে না। উই আর ওয়ার্কিং অন ইট।’ এই মন্তব্য থেকে পরিষ্কার যে সংখ্যালঘুদের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রæতি এখনো রক্ষিত হয়নি। কিন্তু এবারও তারা নতুন প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি খুবই উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিংস্র আক্রমণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অসংখ্য নর-নারী নিহত হয়েছে; অসংখ্য নারী হয়েছে ধর্ষণের শিকার; তাদের ঘরবাড়ি, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও লুণ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন করবে এবং তার পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না। প্রশ্নটা এখানেই গত ২০-২২ বছর আগে ঘটা ঘটনার বিচার এতদিন বাদে করা আদৌ সম্ভব কি?
আজ একটানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্ব রাজনীতিতে তার অবদান অস্বীকার কেউই করতে পারবে না। কিন্তু এই একটি জায়গায় তার উদাসীনতা ভবিষ্যতের জন্য সংখ্যালঘুদের আতঙ্কিত করে। এবারে এই বিষয়ে তার প্রথম কাজ সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং দ্বিতীয় কাজ সংসদে মোট ৩৫০ আসনে অন্তত ৩৫টি আসন (১০ শতাংশ) সংখ্যালঘুদের জন্য নিশ্চিত করা। ১৪ জন ইতোমধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন। আরো ৫০ জন সংসদ সদস্য মনোনীত হবেন। তার মধ্যে ২১ জন সংখ্যালঘুকে মনোনয়ন দিলে সংসদে সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক হবে।
আর সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের দেয়াই যুক্তিযুক্ত। উত্তরাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের হিন্দুরা দ্বিচারী এবং নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। এই বিতর্কের নিরসন করতে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় সঠিক নিদান। তারাই করুন সমাধান। ভারতের লোকসভা ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট। সেখানে মুসলিম সংসদ সদস্য বাড়লেও সংখ্যা ২৮ মাত্র। অথচ জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলমান। সেই হিসাবে ৭৪ জন সংসদ সদস্য হওয়া উচিত। কিন্তু তা নিয়ে ভারতে হেলদোল কম। কারণ ভারত সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তবে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হলে ধর্মকেই বর্ম করা উচিত। কারণ ধর্মকে কেউই অস্বীকার করতে পারেন না। তাই পথ দেখাক বাংলাদেশ। পূর্বের সংখ্যালঘুদের দেয়া অপূরণীয় প্রতিশ্রæতি এবার পূর্ণ করুন তারা। তাতে শুধু তাদেরই লাভ হবে না, বিশ্বের অনেক দাদার কাছেও উদাহরণ হয়ে থাকবে এই দেশ।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়