নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো কোনো অপরাধ করেনি বাংলাদেশ : অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল

আগের সংবাদ

স্মার্ট মন্ত্রিসভার যাত্রা হলো শুরু : ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে নতুন মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন, স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার, কাল টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

তাইওয়ানের নির্বাচনে চীন-আমেরিকা!

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২৪ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ ডেস্ক : তাইওয়ানের জাতীয় নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বেগবান হচ্ছে দুই পরাশক্তির লড়াই নিয়ে আলোচনা। দেশ দুটির নাম চীন ও আমেরিকা। চীন বরাবর বলে আসছে, তাইওয়ান তাদের ভূখণ্ডের অংশ। যে কোনো মূল্যে তা নিজ ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। অন্যদিকে আমেরিকা বলছে, চীন তাইওয়ানে বলপ্রয়োগ করলে তারা সহ্য করবে না।
তাইওয়ান ঘিরে চীন ও আমেরিকার এ রকম যুদ্ধংদেহি অবস্থার মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের দ্বীপ দেশটিতে আগামী ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। আলোচনাকারীদের একাংশ বলছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) কখনোই তাইওয়ান শাসন করেনি। তারপরও তারা কেন বারবার তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তা বোধগম্য নয় তাইওয়ানের সাধারণ মানুষদের কাছে। এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির বেশির ভাগ মান্ষুই নিজেদের ‘চাইনিজ’ না বলে ‘তাইওয়ানিজ’ বলে পরিচয় দেয় এবং তারা কখনোই বেইজিংয়ের অংশ হতে চায় না।
এদিকে তাইওয়ানকে বরাবরই সমর্থন দিয়ে আসছে আমেরিকা। ঠিক কী কারণে তাদের এই নিরঙ্কুশ সমর্থন, তা সমালোচকদের কাছে এখনো অস্পষ্ট। সমালোচকরা বলছেন, এটি আমেরিকার ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’। তবে যে বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই, সেটি হচ্ছে, তাইওয়ান ইস্যুতে চীন ও আমেরিকার মুখোমুখি অবস্থান। যখনই তাইওয়ান নিয়ে চীন কিছু একটা বলেছে, তখনই পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আমেরিকা।
এ দুটি শক্তিধর দেশ যদি সত্যি সত্যি তাইওয়ান নিয়ে লড়াইয়ে নামে, সবচেয়ে বিপদে পড়বে তাওয়ানবাসীরা। তাই তারা এখন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। তাইওয়ানিজরা তাকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে চাইছেন, যিনি তাইওয়ান প্রণালীজুড়ে শান্তি রক্ষা করবেন। কারণ এটি তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
নির্বাচনী দৌড়ে যেসব প্রার্থী : তাইওয়ানের ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) নেতা লাই চিং তের প্রতি জনসমর্থন এখন পর্যন্ত বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া আমেরিকায় নিযুক্ত তাইওয়ানের সাবেক রাষ্ট্রদূত সিয়াও বি খিমও আছেন বেশ আলোচনায়।
ডিপিপি মনে করে, তাইওয়ানকে স্থিতিশীল রাখতে হলে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর করতে হবে। কিন্তু লাই চিং তেকে আমেরিকার অতটা পছন্দ নয়, ঠিক যতটা পছন্দ সিয়াও বি খিমকে। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনও বেশ পছন্দের ব্যক্তি ছিলেন আমেরিকার।
এদিকে চীনের পছন্দের খাতাতেও নেই লাই চিং তের নাম। চীন সরকার প্রকাশ্যেই লাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। চীন প্রায়ই বলে, লাই একজন ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’ ব্যক্তি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে আরো রয়েছেন ‘রক্ষণশীল’ কুওমিনতাং (কেএমটি) পার্টির নেতা হাউ ইউ ই। সাবেক পুলিশ অফিসার হাউ এখন নিউ তাইপেই শহরের জনপ্রিয় মেয়র। কেএমটি মনে করে, তরুণদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হাউ। এই তরুণরাই তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে।
কিন্তু অভিজ্ঞ ভোটাররা বলছেন, চীন ও আমেরিকাকে কৌশলে ‘ম্যানেজ’ করার মতো যথেষ্ঠ ঝানু নন হাউ। কারণ তার কোনো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। তা ছাড়া হাউয়ের কথার মধ্যেও অসংলগ্নতা দেখছেন ভোটাররা। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কথাও বলেন, আবার চীন প্রস্তাবিত ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ মডেলও মানবেন না বলেন। ফলে চীন ইস্যুতে তার অবস্থান স্পষ্ট নয় ভোটারদের কাছে।
আলোচিত আরেক প্রার্থী নবগঠিত তাইওয়ান পিপলস পার্টির (টিপিপি) নেতা তাইপের সাবেক মেয়র কো ওয়েন জে। ২০১৪ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। কো বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে চীন ইস্যুতে ডিপিপি এবং কেএমটির মাঝামাঝি নীতি অনুসরণ করবেন।
চীনকে মোকাবিলা বড় সমস্যা : প্রধান সমস্যা হিসেবে চীনকে মোকাবিলা করার বিষয়টিই সব প্রার্থী সবিস্তারে প্রচার করছেন। সমস্যাটি যদিও নতুন নয়, দীর্ঘ দিন ধরেই চীনের আগ্রাসনের হুমকির মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান। তবে স¤প্রতি চীন-তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। তাইওয়ান প্রণালীর আশপাশে চীন তাদের সামরিক মহড়া বাড়িয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দারা বলছেন, আগামী এক দশকের মধ্যেই চীন তাইওয়ানকে দখল করে নিতে পারে।
যুদ্ধ না শান্তি- এই বিষয়টিও ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছে প্রার্থীদের প্রচারণায়। ২০২০ সালের নির্বাচনেও এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিলেন সাই ইং ওয়েন। গত মাসেও তিনি একটি সমাবেশে বলেছেন, আমরা হংকং স্টাইলের শান্তি চাই না। আমরা মর্যাদাপূর্ণ শান্তি চাই।
এদিকে কেএমটি নেতা হাউ বলছেন, ডিপিপির প্রার্থীকে ভোট দেয়া মানে তাইওয়ানের সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো। কারণ ডিপিপি চীনের সঙ্গে তাইওয়ানকে যুদ্ধে উসকে দেবে।
তাইওয়ানের মূদ্রাস্ফীতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা কম (২ দশমিক ৯২ শতাংশ) হলেও বেশির ভাগ তাইওয়ানিজ মনে করে, এখানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। তাই এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখাই হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের প্রধান চ্যালেঞ্জ। জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোই এখন ভোটারদের কাছে প্রধান ইস্যু। এরই মধ্যে লাই এবং হাউ- দুই নেতাই ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। ফলে তরুণ ভোটাররা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।
তাইওয়ান একটি আমদানি নির্ভর দেশ। এর প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় ৯৭ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। দেশটিতে জ্বালানির অভাবে ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২২ সালে ব্যাপক ব্ল্যাকআউট হয়। লাখ লাখ মানুষ বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে সরকারের ওপর বিরক্ত ছিল। চীন যদি তাইওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, সে ক্ষেত্র তাওয়ানের যে পরিমাণ গ্যাস, কয়লা ও তেলের মজুত রয়েছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ দিন চলতে পারবে তাইওয়ান। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
নির্বাচনকে সামনে রেখে পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচি পুনরায় শুরুর বিষয়টি আলোচনায় আসছে। কারণ ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সাই ক্ষমতায় আসার পর পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচির কার্যক্রম হ্রাস করেছিলেন। তাইওয়ানের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এমন পরিস্থিতে পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচি পুনরায় শুরু করার প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন হাউ।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বেইজিং। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন তার ওপর চীনের চাপ বাড়বে। নতুন বছরের ভাষণে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, ‘মাতৃভূমির পুনর্মিলন একটি ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।’ অর্থাৎ তিনি চীন ও তাইওয়ানকে একীভূত করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিবর্তে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে শি তার লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবেন।
নির্বাচন ঘিরে গুজব ছড়াচ্ছে : এসবের বাইরেও তাইওয়ানের নির্বাচন ঘিরে চীনের কিছু কার্যক্রম দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যেমন গুজব প্রচার করা। কয়েকদিন ধরেই বেইজিং বলে আসছে, আমেরিকার কাছ থেকে আমদানি করা বিষাক্ত শূকর তাইওয়ানের নাগরিকদের খাইয়ে দেয়া হচ্ছে।
এবং চীনে আক্রমণ চালাতে জনগণের কাছ থেকে গোপনে রক্ত সংগ্রহ করে জীবাণু অস্ত্র বানানোর জন্য আমেরিকায় পাঠানো হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব গুজব প্রচারের মাধ্যমে তাইওয়ানিজদের মধ্যে আমেরিকা সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরি করতে এবং সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করতে চাইছে চীন।
২০২১ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, তাইওয়ানের জনগণ চীনের চেয়ে আমেরিকাকে বেশি বিশ্বস্ত মনে করে। ওই জরিপে অংশ নেয়া ৪৫ শতাংশ জনগণ বলেছেন, তারা আমেরিকাকে চীনের চেয়ে ভালো বন্ধু মনে করেন। যদিও গত বছরের এক জরিপ বলছে, আমেরিকাকে বিশ্বস্ত মনে করা তাইওয়ানের জনগণের সংখ্যা ৩৪ শতাংশ।
এদিকে তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত সোমবার বলেছে, তাইওয়ান প্রণালিতে তারা ৩টি চীনা বেলুন শনাক্ত করেছে। এসব বেলুন উড়িয়ে তাইওয়ানের বিমান উড্ডয়ন ঝুঁকির মুখে ফেলছে চীন। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য চীনা প্রচেষ্টাগুলোকে নথিভুক্ত করছে এবং ভোটের পরে তার বিশ্লেষণ প্রকাশ করবে।
আগামী ১৩ জানুয়ারির নির্বাচনে কে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। একইভাবে বলা যাচ্ছে না, আগামী নভেম্বরে মার্কিন নির্বাচনে কে হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ততদিন পর্যন্ত আমেরিকার সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক কেমন থাকবে, তা নির্ভর করছে তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্টে কে হতে যাচ্ছেন, তার ওপর।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি ও রয়টার্স

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়