ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিট

আগের সংবাদ

রাতারাতি ডাবল সেঞ্চুরি : ফের টালমাটাল পেঁয়াজের বাজার > অভিযানে নেমেছে ভোক্তা অধিদপ্তর > দেশি পেঁয়াজ হাওয়া

পরের সংবাদ

অধ্যক্ষের স্মৃতির কোলাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৩৫-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্বের শিক্ষার্থী তাফাজ্জল হোসেন। পরবর্তীকালে চৌমুহনী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে সুপরিচিত। সে সময় তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। হলের এক অনুষ্ঠানে তশরিফ আনেন মিসরের একজন ধর্মীয় বক্তা। তার বক্তৃতার ভাষা আরবি। দোভাষীর সহায়তা ছাড়া তিনি কী বলছেন তা বোঝার সাধ্য ক’জনের? কেউই এ কাজে এগিয়ে আসছেন না দেখে ‘সবাই মিলে শহীদুল্লাহ সাহেবকে মঞ্চে তুলে দিলেন। মিসরি সাহেবের আরবি বক্তৃতার তর্জমা করতে গিয়ে তিনি যে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা অপূর্ব।’ বক্তৃতা শেষ হলে মিসরি সাহেব ও শহীদুল্লাহ সাহেব উপস্থিত আলেমদের সামনে অনেকক্ষণ আরবিতে আলোচনা করেন। আলেমরা সম্ভবত তাদের বিদ্যার ঘাটতির অন্তত কিছুটা বুঝতে পেরে অভিভূত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ডক্টর শহীদুল্লাহকে তিনি প্রথম দেখেন ১৯৩২ সালে কার্জন হলের সাহিত্য সভায়। সেখানে হাজির ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, মোহিতলাল মজুমদার ও কাজী মোতাহার হোসেন, সভাপতি শহীদুল্লাহ। আলোচ্য বিষয় ছিল মোহিতলালের প্রবন্ধ শিরঃপীড়া; কাজী আবদুল ওদুদ লেখককে বেশ একহাত নিলেন। ‘মোহিত বাবু বললেন, কাজী সাহেব বোধহয় আমার ওপর রাগ হয়েছে।’ ওদুদ সাহেব অমনি উত্তর করলেন, ‘হ্যাঁ, তবে সংস্কৃত অর্থে’।
দুজনের মধ্যে বাদানুবাদ প্রায় লাগাতারই বলা চলে। তাদের ছাত্ররা এই বিতর্ক বেশ উপভোগ করতেন। টেবিল টকে কাজী আবদুল ওদুদের সমকক্ষ মোহিতলাল ছিলেন না। ‘মোহিত বাবু অল্পতেই মেজাজ গরম করে ফেলতেন। তার লেখাতে যে চাতুর্যের পরিচয় পাই এবং ক্লাসে তিনি যেভাবে হাস্যরসিকতার মাধ্যমে সাহিত্যের বিষদ ব্যাখ্যা করতে পারতেন, তর্ক লাগলে কিন্তু তিনি কথার খেই হারিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে চটে-মটে খুন হয়ে যেতেন।’
তিনি আরো লিখেছেন : ‘ভাগীরথীর তীরবর্তী সমাজের প্রতি মোহিত বাবুর একটা বায়াস ছিল। এই জন্য পূর্ববঙ্গবাসীকে নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে রসিকতা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসে সে বছর আমিই একমাত্র মুসলমান ছাত্র ছিলাম। আমি মাঝে মধ্যে শেরওয়ানি পরে ক্লাসে যেতাম। মোহিত বাবু একদিন আমাকে বললেন, তোমার পোশাক পরিচ্ছদে তোমাকে বাঙালি বলে মনে হচ্ছে না। দেখ, বাংলা সাহিত্যে পূর্ব বাংলা হিন্দুদেরই কোনো অধিকার নেই- আর তোমরা মুসলমান তো একেবারে অনাহূতই। তুমি ইংরেজি ছেড়ে বাংলা বিভাগে এলে কেন?’
তাফাজ্জল হোসেন তার শিক্ষক মোহিতলালের পাণ্ডিত্যাভিমানের কথা লিখেছেন। তিনি চটে গেলে প্রতিদ্ব›দ্বীর প্রতি ‘অবজ্ঞাসূচক’ উক্তি করতেন। প্রথম জীবনে প্রচুর আরবি ফার্সি শব্দ রপ্ত করার পরও পরবর্তী জীবনে এ ধরনের শব্দের ব্যবহার দেখলে মারমুখী হয়ে উঠতেন।
পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত একজন কবি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ মোহিতলাল মজুমদারের হাতে দিয়ে তার কাছে একটি ভূমিকা প্রার্থনা করলেন। এই শিক্ষকের বাসায় তাফাজ্জল হোসেনের আসা-যাওয়া ছিল বলে তিনি তাকেও সঙ্গে নেন। প্রচ্ছদ ছিল তরুণ কবি প্রতিকৃতি, তা দেখে ‘মোহিত বাবু অকস্মাৎ অগ্নিশর্মা মূর্তি’ ধারণ করলেন। ‘তুমি ছোঁড়া কে হে যে তোমার ছবি বইয়ের মলাটে ছেপে সাধারণে প্রচার করতে পার? কোন ঘৃণ্য দুর্বুদ্ধি তোমাকে এই ইস্ট-দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত করিয়েছে? কালচার কাকে বলে জান? কালচার প্রকাশ পায় আত্মসংবরণে, আত্মপ্রচারে নয়- বুঝলে? আত্মপ্রচারের এই কাঙালিপনাকে আমি ঘৃণা করি।’
যত কটু কথাই মোহিতলাল বলে থাকুন না কেন, স্বীকার করতেই হবে বাঙালির পরিমিতি জ্ঞানের ঘাটতির কারণে এ ধরনের বকাঝকা খাবার দাবি রাখে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড. মাহমুদ হাসানের (পরে ভাইস চ্যান্সেলর) বাড়িতে বিলেত থেকে সাহিত্যামোদী একজন গ্রিনউড সাহেব বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হতে আসেন। প্রভোস্টের আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন জসীমউদ্দীন, মোহিতলাল মজুমদার, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কথা বলতে গিয়ে সাহেব জানালেন ‘জসীমোড্ডীন, বুডাডেব বাসু’র নাম আগে শুনেছেন।
মোহিতলালের নাম শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘নো সরি’।
মোহিতলাল মজুমদারের প্রভোস্টের বাড়ি থেকে তৎক্ষণাৎ স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রান্ত হওয়ার জন্য এই ‘নো’-ই ছিল যথেষ্ট। ‘তিনি বুডাডেবকে চেনেন, মোহিতলালকে চেনেন না, সব প্রপাগান্ডা।’ বলতে বলতে তিনি বেরিয়ে গেলেন। সেখানে কী ঘটেছে তা বুঝতে পারেনি বলে যখন একজন তাকে জানালেন তিনি বললেন, ‘বুঝবে আবার কী? কে এক ছোঁড়া বিলেত থেকে এসে হাসান সাহেবের ওখানে উঠেছেন- অজমূর্খ। তিনি আবার বাংলা সাহিত্যের সমঝদার সাজতে চান। তিনি আমার অপদার্থ ছাত্র বুদ্ধকে চেনেন অথচ তার গুরু মোহিতলালের নাম শোনেননি।’ এ কী অনাচার!
এদিকে মোহিতলাল নতুন মেধাবী প্রায় সব লেখকের ওপরই খড়গহস্ত ছিলেন। তাকে নিয়ে একটি প্রচলিত ছড়ার উল্লেখ করেছেন তার ছাত্র তাফাজ্জল হোসেন :
নজরুল আমার বিদ্রোহী শিষ্য
দাহন করিতে চায় বিশ্ব।
বুদ্ধ, অচিন্ত নিত্য নিমিত্ত
বিলাইছে কেবল বিলাতী বিত্ত
নিজেরা কিন্তু নিতান্ত নিঃস্ব
যদিও শুরুতে ছিল মোর শিষ্য।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় একজন চীনদেশীয় চিত্রশিল্পীর একটি প্রদর্শনীতে ডক্টর শহীদুল্লাহ ছিলেন, তাফাজ্জল হোসেনও ছিলেন। শিল্পী অবশ্যই চীনা ভাষা জানতেন আর জানতেন ফরাসি বা ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি একদমই না। শহীদুল্লাহকে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন শিল্পীর সঙ্গে চীনা বা ফরাসিতে কথা বলে তার আঁকা ছবিগুলোর তাৎপর্য বুঝিয়ে দেন। শহীদুল্লাহর তখন কলকাতা যাওয়ার তাড়া। তিনি তখনই কলা ভবনে গিয়ে শিল্পীর সঙ্গে ফরাসি ভাষায় অনেকক্ষণ কথা বললেন। ‘অতঃপর ফরাসি ভাষার অনুনাসিব ধ্বনিতে সমগ্র ভবনটি মুখর হয়ে উঠল। ফরাসি ভাষার কথ্যরীতির সঙ্গেও তার যে এমন সহজ পরিচয় ছিল তখন সবাই তা ভালো করে জেনেছি।’
শহীদুল্লাহর তাৎক্ষণিক তামাশাপূর্ণ জবাবের একটি চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই লেখক- অধ্যাপক একজন সৃজনশীল চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যজন মননশীল কবি-প্রবন্ধকার মোহিতলাল; সাহিত্য বিচারে দুজনের যথেষ্ট তারতম্য ছিল, আর শহীদুল্লাহ তাদের মাঝে থেকে ভারসাম্য রক্ষা করতেন বলে তিনি মনে করেন। একদিন মোহিতলাল বাঙালির পোশাক ধুতি ও চাদর পরে শহীদুল্লাহকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বললে তিনি তাকে অধিকাংশ বাঙালির পোশাক লুঙ্গি ও টুপি পরে আসার আহ্বান জানালেন, তাহলে তিনিও ধুতি-চাদর পরবেন।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মিলনায়তনে নজরুলকে নিয়ে অনুষ্ঠান। লেখক ক’জনকে নিয়ে মোহিতলাল মজুমদারকে সভায় আমার আমন্ত্রণ জানাতে গেলে তিনি বললেন, ‘আমি যাব নজরুলের সভায়। তোমরা অর্বাচীন বালক।’
তিনি অধ্যাপক খান বাহাদুর ফিদা আলী খাঁর কথা লিখেছেন। তিনি ছিলেন রোহিলা পাঠান। তিনি বলতেন, ‘আমার সাত পুরুষের মধ্যে কেবল আমিই অসি ছেড়ে মসি ধরেছি। অসীম পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও ফিদা আলী খাঁ তার সৈনিকসুলভ মন ও চেহারাটি বদলাতে পারেননি। দলাদলি, তোষামোদ বা কারোর নিন্দা করতেন না বলে বিশ্ববিদ্যালয় চক্রে তার বিমেষ সুনাম ছিল।’

পড়াশোনার নিউ স্কিম
পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানিয়েছে। যখন বঙ্গবঙ্গ রোধ আন্দোলন শুরু হলো মুসলমানরা সে আন্দোলনের বিরোধিতা করে ১৯১১-তে চূড়ান্তভাবে হেরে গেল। বঙ্গবঙ্গ রোধের খুচরো ক্ষতিপূরণের আশ্বাস সরকার দিল, তবে পরাস্ত মুসলমানদের অনেকেরই বোধোদয় হলো আরবি-ফারসিতে ডুবে না থেকে ইংরেজির পথ ধরতে হবে। মুসলমান সন্তানদের ধীরে ধীরে ‘নাসারা’দের স্কুলে ভর্তি করানো শুরু হলো। সে সময় স্কুলগুলোর নামের সঙ্গেই যুক্ত ছিল মিডল ইংলিশ স্কুল, হাই ইংলিশ স্কুল। মুসলমানদের শিক্ষার ক’টি মাত্র কেন্দ্র : আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতায় ওয়েলেসলি স্ট্রিটে ইসলামিক কলেজ, ঢাকায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, মহসিনিয়া মাদ্রাসা- রূপান্তরিত ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও রাজশাহী কলেজ। তাফাজ্জল হোসেন লিখলেন, তারপরও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি মুসলমান সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল না। এ অবস্থায় প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ঢাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সামছুল ওলেমা আবু নসর ওহীদ ইংরেজির সঙ্গে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা মিশিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন- বহু বছর চালু থাকা এই শিক্ষাব্যবস্থাই নিউ স্কিম নামে পরিচিত ছিল। স্মৃতিকণাতে অধ্যক্ষ তাফাজ্জল হোসেন লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হোসেন, বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর আবদুল হাই, ড. কাজী দীন মুহম্মদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল, সৈয়দ আলী আহসান, ড. এনামুল হক প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ প্রথম দিকে নিউ স্কিমের ছাত্র ছিলেন।

শিক্ষা সফর
তাফাজ্জল হোসেন কিছুকাল ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকার পর ১৯৪৯ সালে চৌমুহনী কলেজের অধ্যক্ষ হলেন। তার সঙ্গে যারা এই কলেজে শিক্ষকতায় সহকর্মী ছিলেন অনেকেই কলেজ ছেড়ে যান। কফিলউদ্দিন মাহমুদ সিএসপি হয়ে সচিব ও উপদেষ্টা হন। তিনি কলেজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তিনি কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি হন আর তখন সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রবাদপ্রতিম অধ্যক্ষ আকতার হামিদ খান। একবার শিক্ষক প্রতিনিধিরা গভর্নর হাউসে আমন্ত্রিত হন। দলের একজন সদস্য শওকত ওসমান প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের দুটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করলে গভর্নর আবদুর রহমান সিদ্দিকী বিরক্ত হয়ে তাকে বলেন, ঈধহ’ঃ ুড়ঁ য়ঁড়ঃব ভৎড়স ঐধভরু, জঁসর ড়ৎ ঝধধফর?
১৯৫২’র শেষ দিকে একটি শিক্ষক প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান সফরে যান। সোয়াতের রাজবাড়ীতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণে যোগ দেন। এ পরিবারের আত্মীয় তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানও এসেছিলেন। তিনি খাবার টেবিলে মন্তব্য করেছেন, তৌহিদ ও রেসালাত পূর্ব পাকিস্তানিদের মজ্জাগত হয়নি, তারা হিন্দু ভাবাপন্ন।
গভর্নর খাজা শাহাবুদ্দিনের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে সীমান্ত প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী জাফর খাঁ যোগ দেন। তিনিও বলেন, বাঙাল মুলুকের জন্য পাঠানদের অনেক দরদ, কিন্তু দুর্ভাগ্য তারা হিন্দুদের বুদ্ধিতে পরিচালিত হয়। তখন তাকে বলা হয়, গুজবটা সত্য নয়। বরং পাকিস্তান আন্দোলনের সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশই ছিল শিরঃপীড়ার কারণ। কারণ আপনারা কংগ্রেসে যোগ দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। এই মন্তব্য শুনে খাজা শাহাবুদ্দিন বরং সন্তুষ্ট হয়ে টেবিলের নিচ দিয়ে অধ্যক্ষের উরুতে চাপ দিয়ে তার মনোভাব প্রকাশ করলেন। জাফর খাঁ কংগ্রেসেই ছিলেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ক’দিন আগে মুসলিম লীগে যোগ দেন।
খাজা শাহাবুদ্দিন ম্যাট্রিকও পাস করেননি। কিন্তু তিনি ‘বিশুদ্ধ ইংরেজি লিখতে ও বলতে পারতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে পালন করেন। গভর্নরের সচিব সিএসপি আবদুর রশীদ তাকে বলেছেন খাজা শাহাবুদ্দিন নথিপত্রে যে আদেশ দিতেন তা সর্বতোভাবে ইংরেজ আইসিএসদের লেখার সমতুল্য ছিল।’
স্মৃতিকথায় একদিকে যেমন লেখকের সময়ের টুকরো টুকরো ইতিহাস ধারণ করেছে, তেমনি তুলে ধরেছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কাহিনি। এতে বাঙালি কর্মকর্তাদের আচরণগত একটি দিকও উঠে এসেছে- ‘ঢাকায় শিক্ষা সচিব তো দূরের কথা, ডিপিআইর পেছনে পেছনে কলেজের আর্থিক সাহায্যের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে কত যে জুতার তলি ক্ষয় করেছি তার কি কোনো লেখাজোখা আছে।’ অথচ দেশের অপর প্রান্তে গিয়ে দেখলেন শিক্ষা সচিব ও ডিপিআই তাদের খেদমতে নিয়োজিত।

খানাপিনার স্মৃতি
খানা জিয়াফতে ফরাস বিছিয়ে তার ওপর দস্তর দিয়ে বর্তন পাতা হতো। সুরম্য কাপড়ের দস্তরের ওপর অনেক ক্ষেত্রে ভোজনরসের ওপর লেখা ফার্সি কবিতা মুদ্রিত থাকত। খাওয়া আরম্ভ হলে কোনো একজন রসিক ব্যক্তি সেগুলো রসিয়ে রসিয়ে আবৃত্তি করে ভোজনরসকে আরো জমিয়ে তুলতেন। এরূপ খাওয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভোজনরীতির নাম ছিল ‘তারাবন্দি খানা’ অর্থাৎ আমন্ত্রিত মেহমানের জন্য পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যেকের সামনে কয়েকটি বর্তনে নানাবিধ অতি উৎকৃষ্ট খাদ্য সাজানো থাকত। মেহমানগণ নিজ নিজ রুচিমতে খাবার খেয়ে নিতেন। তবে ব্যয়বহুল বলে অভিজাত পরিবারের বিভিন্ন উৎসবেই এ খানা পরিবেশিত হতো।
মুসলমান নবাব-বাদশাহ ও অভিজাতদের খানাপিনা সাধ্যমতো গ্রহণ করা হয়েছে- পোলাও, কোর্মা, জর্দা, ফিরনি, কাবাব, কালিয়া, কোপ্তা, মুরগি মোসাল্লাম, মোরগ পোলাও, শিক কাবাব, বিরিয়ানি, বুরহানি শিরমল এখনো অটুট আছে- ‘এমনকি এক শ্রেণির আত্মভ্রষ্ট উগ্রবাঙালি জাতীয়বাদীরাও এসব খানা খেতে ভালোবাসেন।’ -‘হিন্দুর বাড়ি ইংরেজের বাড়ি, মুসলমানের হাড়ি মিথ্যা ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের (মুসলিম বিযুক্ত হয় অনেক পরে) উন্নত খাবারের কথাও উঠে এসেছে এই স্মৃতিচিত্রে।
(স্মৃতিকণা : অধ্যক্ষ তাফাজ্জল হোসেন, ১৯৭৮)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়