ক্ষমতার অসমতায় ঘটছে নারীর প্রতি সহিংসতা : অনুষ্ঠানে বক্তারা

আগের সংবাদ

নাশকতার পেছনে বাইরের উসকানি : ফারুক হাসান, সভাপতি, বিজিএমইএ

পরের সংবাদ

বাজার যেন অভিভাবকহীন

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাজার নিয়ন্ত্রণে যেন দেশে কোনো অভিভাবক নেই। ইচ্ছামতো অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। লুটে নিচ্ছেন মানুষের টাকা। মহামারির সংকটকাল মুখবুজে পাড়ি দিতে না দিতেই সারা দুনিয়ায় শুরু হলো যুদ্ধের উত্তাপ। মহামারি হোক আর যুদ্ধ হোক, একদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও ডলার সংকটের ইস্যু দেখিয়ে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে বাজার দর। টালমাটাল নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজার। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে কারসাজির মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে মুনাফার সুযোগ নিচ্ছেন। এক সময় এই বাংলার মানুষের খাদ্যের অভাব ছিল না। মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছু এখন বদলে গেছে। বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির হার। কিন্তু বর্তমানে অধিক মূল্যবৃদ্ধি একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আজকের বাজারে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম চড়া। এই পণ্যগুলোর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে নানা অজুহাতে। হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। এতে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের অতি দরিদ্র, হতদরিদ্র, নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজার মনিটরিং না থাকার কারণে এমন অবস্থার জন্য দায়ী করছে মানুষ। বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি নতুন নয়। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। সবমিলে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম মেটাতে ভোক্তার হাঁসফাঁস অবস্থা। তারা বলছেন, সবকিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে।
দেশের অধিকাংশ মানুষ খেটে-খাওয়া শ্রমিক। কিন্তু তারা কোনো অন্যায় করেনি তবুও তাদের আজ বড় অসহায় মনে হচ্ছে। গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসছে, দেশি পেঁয়াজের বর্তমান দাম হলো ১৪৫-১৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১১০-১১৫ টাকা, আমদানি পেঁয়াজ ১১৫-১২০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৮০-৯০ টাকা, চিনির বর্তমান দাম ১৩৫-১৪০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৩০-১৪০ টাকা। এভাবে আলু, চাল, সবজি, মাছ, ডাল, লাকড়ি, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম শুধু বাড়ছে। এদিকে সরকার চিনি আমদানি শুল্ক অর্ধেক কমানোর পর পাইকারি বাজারে চিনির দাম উল্টো বেড়েছে। অজুহাত হলো মিল থেকে বাজারে চিনির সরবরাহ কমেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চিনির সংকট বিষয়ে আমরা সারাদেশের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করে আসছি। তবে এই সংকটের বিষয় এখনো কোনো কিছু পাইনি।’ প্রশ্ন হলো তাহলে হঠাৎ করে চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠল কেন! আমরা মনে করি ভোক্তা অধিকারসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সরকারের সব সংস্থার আরো তৎপর হওয়া উচিত।
শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্য এখন মানুষের আওতার বাইরে। ওষুধের গায়ে মূল্য নির্ধারণ না করে দেয়ায় একদল দুর্নীতিবাজ মানুষকে প্রতারিত করছে সব সময়। এতে কিছু অসাধু লোকের পকেট ভারি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ দেশের সার্বিক উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আজকে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্নআয়ের প্রান্তিক মানুষ। দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হলেও দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অনেকে তিন বেলা খাবারও জোটাতে সক্ষম হচ্ছে না। এটা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কাক্সিক্ষত ফলাফল মিলছে না। বাজারের ওপর সরকারের যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আছে তা বলা যাবে না। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছেন। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমতে দেখা যায় না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করছে কিন্তু সুফল আসছে না। তাই তাদের কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
এটা স্পষ্ট যে, করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখনো বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া এখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। বাস্তব সত্য হচ্ছে, বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পরিপূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এখন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশের দরিদ্র মানুষ তাদের স্বল্প আয়ে আর চলতে পারছেন না, কিংবা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন না। এটাই এখন বোঝা যাচ্ছে। আসছে জাতীয় নির্বাচন তাই এদিকে সরকারের সুদৃষ্টি আশা করে সুজন। না হয় এই সরকারের পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলের মতো ভালো কাজও হয়তো ভালো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে না জনগণের মধ্যে। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব দরিদ্র লোকের জন্য সরকারকে কিছু করে দেখাতে হবে। সরকারের উচিত হচ্ছে এখন টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি আরো বাড়ানো। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সিন্ডিকেট এবং কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে, দুর্নীতিকে চিরতরে না বলতে হবে। প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে কেউ এ ধরনের কাজ করার সাহস না পায়। সাংবাদিকদেরও এ বিষয়ে সত্য খবর প্রকাশ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষকবান্ধব আইন করতে হবে। যাতে কৃষক স্বল্প টাকায় সার ও বীজ সংগ্রহ করতে পারে এবং কৃষি পণ্য মধ্যস্বত্বভোগী দালালমুক্তও উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে সরকারি সহযোগিতা লাভ করেন কৃষক। দেশের প্রত্যেক উপজেলায় পচনশীল খাদ্যপণ্যের জন্য হিমাগার স্থাপন করে খাদ্য যথাযথ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ বিষয়ের স্থায়ী সমাধান হবে বলে বিজ্ঞজন মনে করেন। আর সরকারের পাশাপাশি দেশের সব নাগরিক কেউ এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। সরকারের সংস্থাগুলো (আইন, বিধি, নীতিমালা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, তদারক সংস্থা) সক্রিয় থাকলে মজুতকারীরা সাহস পেত না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘœ রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।

ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়