বাড়তি দামে রাজি বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো

আগের সংবাদ

ঝিনুকের দেশে রেলের হুঁইসেল > সৃষ্টি নয়, ওরা জানে ধ্বংস : প্রধানমন্ত্রী > ট্রেনে চড়ে ২৬ মিনিটে কক্সবাজার থেকে রামু

পরের সংবাদ

একমাত্র চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আমলা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

১৯৩০ সালে যার জন্ম এবং যার বাবা রাষ্ট্রযন্ত্রে নিজের পদমর্যাদার কারণে সরকারি যানবাহনের প্রাধিকারপ্রাপ্ত, সে বাবার পদায়ন যদি হয় কিছুটা দুর্গম এলাকায়, বাবার যানবাহন হিসেবে তিনি সরকারি বেতনভুক্ত হাতিচালক অর্থাৎ মাহুতসহ জবরদস্ত হাতি বাড়িতে দেখতেই পারেন। একালের আমলার সন্তানের জন্য নিরাপদ হস্তিদর্শনের উত্তম জায়গা চিড়িয়াখানা।
পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের ১৯৫২ ব্যাচের বাঙালি সদস্য মতিউল ইসলামের বাবা তখনকার নেত্রকোনা মহকুমার বারহাট্টা থানার সার্কেল অফিসার ছিলেন। অতিকায় জীবন্ত বাহনটির যখন রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততা না থাকত, যখন কংস নদীতে গোসল করতে যেত- বালক মতিউল হাতির পিঠে আসীন হওয়ার সুযোগটি গ্রহণ করত- যত ধীরেই চলুক মাহুতসমেত গজেন্দ্রগমনের স্মৃতিই তার শৈশবের প্রথম স্মৃতি। বদলিসূত্রে বাবা যখন চাকরির সদর দপ্তর ঢাকায় এলেন, তিনি ভর্তি হলেন কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন অম্বিকাচরণ প্রাইমারি স্কুলে আর বড় দুই ভাই সেকালের নামজাদা আরমানিটোলা হাই স্কুলে। বড় ভাই নুরুল ইসলাম তার দুবছর আগে ১৯৫০ সালে সিএসপি হয়ে আর্থিক শৃঙ্খলা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃতী গভর্নর হিসেবে তিনি স্মরণীয়।
১৯৫০ ব্যাচের আরো দুজন বাঙালি সিএসপি ছিলেন : কফিলউদ্দিন মাহমুদ আর বোরহানউদ্দিন আহমেদ। আর ১৯৫২ ব্যাচে মতিউল ইসলাম ছাড়াও ছিলেন আরেকজন- সাবের রেজা করিম। সে সময় পুরান ঢাকায় (তখন মোটেও পুরনো নয়) তার চোখে পড়েছে ৫/৬টি মোটর গাড়ি আর সব ঘোড়ার গাড়ি। ১৯৩৫-এর এক সন্ধ্যায় ঢাকার আকাশে আতশবাজির বর্ণিল আলো, মতিউল জানলেন লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করে ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা জিতেছেন- ঢাকা তাই উৎসবে মেতেছে।
ফুলবাড়িয়া থেকে বেরিয়ে আসা তেজগাঁও ছাড়িয়ে উত্তরগামী রেললাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঘেঁষে ঢাকাকে পুরাতন ও নতুন দুভাগ করে দিয়েছে। বালক মতিউলের একক যাত্রার দৌড় তখন ছিল পল্টন পর্যন্ত, সেখানেই ব্রিটিশ সৈন্যদের গ্যারিসন, সে কারণেই নামটা পল্টন। ভারত ভাগের ঠিক আগের বছর ১৯৪৬ সালে তিনি বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেট হয়ে কলকাতায় এলেন, তার আগ্রহ ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে দাঁতের শৈল্য চিকিৎসক হবেন, তারপর লন্ডন গিয়ে বড় বিশেষজ্ঞ। কিন্তু বাবা তার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে কলকাতা কমার্স কলেজে ভর্তি করালেন। সেখানকার তরুণ শিক্ষকদের একজন শেখ আজিজুর রহমানই পরবর্তীকালের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। ১৯৪৭- এর ভারত এবং বাংলা ভাগাভাগিতে কলেজ বন্ধ হয়ে গেল, পড়াশোনায় অনিশ্চয়তা দেখা দিল। কলেজটির পরবর্তী অভ্যুদ্বয় পূর্ব বাংলায়, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ হিসেবে। স্নাতক পরীক্ষায় মতিউল প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার জন্য আর্টিকেলশিপ শুরু করলেন, ওদিকে বড় ভাইয়ের উৎসাহে ১৯৫২ সালের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়ও বসলেন। কৃতকার্য দুটোতে- সিভিল সার্ভিসে, সিএসপিদের মধ্যে প্রথম একমাত্র চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এ এক দুর্লভ সংমিশ্রণ।
১৯৫২-র অক্টোবরে চাকরি শুরু। ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জাকে দিয়ে সামরিক আইন জারি করানো হলো, জেনারেল আইয়ুব খান হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ২৭ অক্টোবর তিনি ইস্কান্দর মির্জাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে লন্ডনগামী উড়োজাহাজে তুলে দিলেন, নিজে হলেন ক্ষমতার অধিশ্বর প্রেসিডেন্ট।
মতিউল তখন প্রাদেশিক অর্থ মন্ত্রণালয়ে, বিয়ের দিন ধার্য ছিল ১৪ অক্টোবর; জ্যেষ্ঠ এক সিএসপি বস মিস্টার সোবহান সেদিনই নিষ্পত্তির জন্য একটি নথি পাঠালেন। ‘আমাকে শান্তিতে বিয়েটা করতে দিন’ লিখে তিনি নথি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তার বিয়েতে হাজির ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলী এবং প্রাদেশিক সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল ওমরাও খান।
সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে অনেক উচ্চপদে রদবদল ঘটল- পুলিশের সাবেক আইজি জাকির হোসেন হলেন প্রাদেশিক গভর্নর। চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলীর জায়গায় এলেন এম আজফার, অর্থ সচিব হলেন ১৯৪৮ ব্যাচের সিএসপি ভি এ জাফরি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আইয়ুব কেবিনেটে মন্ত্রী হলেন চারজন : বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম, চট্টগ্রামের এ কে খান, বগুড়ার হাবিবুর রহমান এবং বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস থেকে আসা হাফিজুর রহমান (অধ্যাপক আনিসুর রহমানের বাবা)। মতিউল ইসলাম স্মৃতিগ্রন্থ লিখেছেন রিকালেকশনস অব অ্যা সিভিল-সার্ভেন্ট টার্নড ব্যাঙ্কার। তার স্মৃতিকথন থেকে একটি এপিসোড অনুবাদ করছি :
১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কেবিনেট অর্থনৈতিক কমিটির একটি বৈঠক ডাকলেন রাওয়ালপিন্ডিতে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গভর্নর জাকির হোসেন, চিফ সেক্রেটারি, এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি, ফিন্যান্স সেক্রেটারি এবং আমি তাতে যোগ দিলাম। রওনা হওয়ার আগে আমাকে বলা হলো পূর্ব পাকিস্তানের প্রকল্প ও প্রস্তাবগুলোর আর্থিক অনুমোদন কেন্দ্র থেকে পেতে আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হই তার বিবরণ ও সমাধানের পথ বাতলে দিয়ে একটি কার্যপত্র তৈরি করতে হবে। কথামতো আমি কার্যপত্র তৈরি করে অর্থসচিব ভি এ জাফরিকে দিই। তিনি তা দেশে যথার্থ বিবেচনা করে এডিশনাল চিফ সেক্রেটারিকে পাঠান। তার মাধ্যমে চিফ সেক্রেটারি হয়ে পেপারটি গভর্নরের হাতে যায়। সঙ্গত কারণেই গভর্নরের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে। গভর্নর জাকির হোসেন সেনাপ্রধান জেনারেল মুসার গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিলেন। (জেনারেল মুসা খান ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ এবং পরে বালুচিস্তানের গভর্নর ছিলেন।)
কেবিনেট অর্থনৈতিক কমিটির সভার আগে প্রেসিডেন্ট চাইলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদাভাবে একটি বৈঠক করবেন, সেখানে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলো শনাক্ত করে তা মোচনের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হবে। এই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী শোয়েব এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়োগকৃত মন্ত্রী এ কে খান এবং হাফিজুর রহমানকেও রাখা হলো। সভার শুরুতেই আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেখলাম আমার দাখিল করা পেপারটি হাতে নিয়ে দুলিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্ষিপ্ত কণ্ঠে গভর্নরকে বলছেন, ‘জাকির এ কাগজ কে তৈরি করেছে? তুমি জানো এটা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভয়ংকর অসন্তোষ ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করবে। এ ধরনের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করার জন্য আমি তোমাকে গভর্নর করে পাঠিয়েছি নাকি?’
গভর্নর দ্রুত নিজেকে দায়মুক্ত করে দুই বা তিন সারি পেছনে বসা আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্রেসিডেন্টকে বললেন, এই পেপার তৈরির জন্য মতিউল ইসলাম দায়ী। আমি ভাবলাম, সিভিল সার্ভিসে আমার দিন শেষ। প্রেসিডেন্ট এরপর কী করেন তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। প্রেসিডেন্ট বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না।
ঠিক সেই সময় চিফ সেক্রেটারি মিস্টার আজফার কথা বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক মতিউল ইসলাম পেপারটা লিখেছে কিন্তু আমরা সবাই, অর্থসচিব, এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি এবং আমি এটা দেখেছি এবং অনুমোদন করেই পাঠিয়েছি। কাজেই মিস্টার ইসলামের ওপর দোষ না চাপিয়ে আমাদের উচিত হবে যেসব পরামর্শ তিনি দিয়েছেন তা পরীক্ষা করা এবং বর্তমান পরিস্থিতি ও অচলাবস্থা কাটাতে তা যতটা সম্ভব কাজে লাগানো যায় তা বিবেচনা করা।’ প্রেসিডেন্ট তখনই পেপারটা অর্থমন্ত্রী মিস্টার শোয়েবের হাতে দিলেন এবং তা পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বললেন।
চিফ সেক্রেটারি মিস্টার আজফারই আমাকে রক্ষা করলেন এবং চাকরিরত তরুণ কর্মকর্তার দায় নিজে গ্রহণ করার একটি দুর্লভ নজির স্থাপন করলেন।
***
ভারত থেকে বাংলা ছায়াছবি আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একবার দুই লাখ রুপি বৈদেশিক মুদ্রা মঞ্জুর করল। মতিউল ইসলাম তিন সদস্যের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে কলকাতা গেলেন এবং সত্যজিৎ রায়, বিকাশ রায় প্রমুখ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দরকষাকষি করলেন। সরকার যে টাকা মঞ্জুর করেছে তাতে ১২টি বাংলা মুভি আনা সম্ভব ছিল। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’-এর জন্য সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। (তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সিনেমা হলে যারা অপুর সংসার দেখেছেন তাদের জন্য তথ্যটি কৌতূহলোদ্দীপক।) দরকষাকষির সমালোচনা এড়াতে কাজটা করলেন ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন সদস্যকেও কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন।
১৯৬১-তে জাকির হোসেনের স্থলাভিষিক্ত হলেন মেজর জেনারেল আজম খান, জাকির হোসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে যোগ দিলেন। আর মতিউল ইসলামের পদায়ন হলো চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার। ঢাকার পরই গুরুত্বপূর্ণ শহর চট্টগ্রাম এবং অনেকটাই প্রটোকল স্টেশন। ১৯৬১-তে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের রাজা-রানী চট্টগ্রাম সফর করেছেন, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান একবার এসেছেন আর গভর্নর আজম খান একাধিকবার।
তখনকার বার্মার (মিয়ানমার) সীমান্তবর্তী জেলা বিভিন্ন ধরনের সীমান্ত বিরোধ লেগেই থাকত, কক্সবাজার মহকুমার অপর প্রান্তে মংডুতে একাধিক ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে ডেপুটি কমিশনারকে অংশগ্রহণ করতে হতো। সীমান্তে চোরাচালান হতো। চোরাচালান সবটাই যে ক্ষতিকর তা মনে করার কারণ নেই, কখনো বিশেষ আইটেমের চোরাচালান অনানুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রই উৎসাহিত করত। এ নিয়ে তার স্মৃতিকথার একটি অংশ অনূদিত হলো : ‘একটি সীমান্ত বৈঠকে যোগ দিতে বার্মা গেলাম। সেখানে আমার প্রতিপক্ষ মংডুর ডেপুটি কমিশনার মেজর টিন ইউ। মেজর টিন ইউ চমৎকার ভদ্রলোক। কক্সবাজার থেকে প্রতিনিধি দল নেয়ার জন্য তিনি মংডু থেকে বোট পাঠিয়ে দেন। প্রতিনিধি দলে রয়েছেন চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এবং কক্সবাজারের এসডিও।
পূর্ব পাকিস্তানে তখন চালের ভীষণ ঘাটতি। সে সময় সরকারের উচ্চমহল থেকে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল বার্মার চাল বাংলাদেশে ঢুকতে উৎসাহিত করা হোক। বিনিময়ে তারা নেবে কোহিনূর কেমিক্যালসের (তিব্বত) প্রসাধন সামগ্রী। বার্মার ফ্যাশনদুরস্ত নারীদের কাছে তিব্বত সামগ্রীর চাহিদা অনেক। বার্মার নৌবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের দিকে চাল নিয়ে আসা বোটের গতিরোধ প্রায়ই করত। অনেক সময় সুপারির মতো বৈধ মালামাল পরিবহনেও বাধা দিত। সীমান্ত সম্মেলনে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বার্মা নৌবাহিনীর অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নালিশ জানালাম। মেজর টিন ইউ খুব নমনীয় স্বরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
সম্মেলন শেষে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের বুথিডং নিয়ে যাওয়া হলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী লড়াই করে অগ্রসরমান জাপানি বাহিনীকে থামিয়ে দেয়, যুদ্ধে বেশকিছু সংখ্যক ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হলে তাদের সেখানেই সমাহিত করা হয়। বিদেশের মাটিতে প্রাণ দেয়া সৈনিকদের কবর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয় ব্রিটেনের ইম্পেরিয়াল গ্রেইভ কমিশন।
প্রতিনিধি দল যখন নৌবাহিনীর বোটে প্রত্যাবর্তনের জন্য আরোহণ করে ডেপুটি কমিশনার নিজে এসে বেশ ক’বস্তা চাল বোটে তুলে দেন এবং বলেন, এগুলো নৌবাহিনীর বাজেয়াপ্ত করা চালের কিছু অংশ।
চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিদায় নিচ্ছেন। স্থানীয় এলিটরা বিদায় জানাতে এসেছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীও ডেপুটি কমিশনারকে অনুরোধ করলেন তাকে যেন অনুগ্রহ করে সেখানে ডাকা হয়। তিনি তখন সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্তদের একজন। ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে সম্মত করাতে পারলেন যে সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। সামরিক আইনের অধীনে সেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এ বাধা সরিয়ে নেয়ায় তিনি নির্বাচনের যোগ্য হয়ে উঠলেন। সাবেক গভর্নর ও মন্ত্রী জাকির হোসেন এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদেশ প্রত্যাহার হলে তিনি তার দাখিল করা মনোনয়ন তুলে নিলেন। চৌধুরী কেবল নির্বাচিতই হননি, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নিযুক্ত হলেন। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টে বললেন, আপনারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্পিকার চেয়েছিলেন, আমি আপনাদের লাউড স্পিকার দিয়েছি। তিনি প্রেসিডেন্টের সাময়িক অনুপস্থিতির সময় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও হয়েছেন।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ তিনি প্রাদেশিক অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন, সে সময় যুগ্ম সচিব পর্যায়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ ছিল। করাচির হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মালিক পাকিস্তান সার্ভিসেস লিমিডেন্ট হোটেল প্রতিষ্ঠার জন্য শাহবাগে জায়গা নিলেও জমির মূল্য ১৩ লাখ টাকা নগদ প্রদানে অসামর্থ্য প্রকাশ করল। তার বদলে ১৩ লাখ টাকার শেয়ার দিতে চাইলে যুগ্ম সচিব তাৎক্ষণিকভাবে তা গ্রহণ করলেন এবং কোম্পানিতে সরকারের মনোনীত একজন ডিরেক্টর রাখার বন্দোবস্তও করলেন। সেই সিদ্ধান্তের সুফল সরকার ভোগ করছে। কেমন করে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টালে সরকারের মালিকানা, এ তথ্য আমাদের অজানাই ছিল।
হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশন সদর দপ্তর তখন ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্যের যুক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৭৫ ভাগ গৃহনির্মাণ ঋণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ২৫ ভাগ নির্ধারিত হয়। ১৯৬৬-তে কফিল উদ্দিন মাহমুদকে অর্থসচিব করা হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতা তার ছিল না। সুতরাং চিফ সেক্রেটারির নির্দেশে তাকে ৩ মাস অর্থ মন্ত্রণালয়ে থেকে সচিবকে কার্যত প্রশিক্ষণই দিতে হলো।
তারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন। ১৯৬৭-৬৯ তিনি বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে ক্ষমতাধর একটি পক্ষকে চটিয়ে তোলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে যখন ক্ষমতাসীন হলেন তার নামও দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত বহুল আলোচিত থ্রি নট থ্রিতে (৩০৩ জন) ঢুকে গেল। তিনি চাকরি হারালেন আর তার যুগ্ম সচিব নুরুল আমিন জীবন হারালেন। সেনাবাহিনী সচিব নুরুল আমিনকে তুলে নিয়ে যায়, রাস্তায় পরিত্যক্ত পড়ে থাকে তার সরকারি গাড়ি। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়