পুলিশ হত্যা মামলা : খসরু-স্বপনের জামিন শুনানি ২৯ নভেম্বর

আগের সংবাদ

নাশকতা ঠেকাতে হার্ডলাইন : আগুনসন্ত্রাস মোকাবিলায় কঠোর পুলিশ, সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে নির্দেশ আ.লীগের

পরের সংবাদ

রোহিঙ্গা বোঝা না বিপদ?

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুটি ঘটনার উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য কোনোটারই মিল নেই। শুধু মিল থাকতে পারে তার পরবর্তী কার্যক্রমে। তাই একটির উদাহরণ জরুরি অপরটিকে সঠিকভাবে বুঝতে। একটি ঘটেছিল আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে। অপরটি ঘটে চলেছে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে। পাকিস্তান আর আফগানিস্তান সেই কবে থেকে আজো বয়ে চলেছে তাদের সৃষ্টি করা তালেবান অভিশাপ। আরো গোড়ায় তাকালে ইতিহাস বলে দেবে- কবে, কখন, কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে জব্দ করতে আমেরিকা সৃষ্টি করেছিল আফগানিস্তানের তালেবান শক্তিকে। আফগানিস্তানে তারপর সব সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘটেছে। ব্রিটিশরা পারেনি, সোভিয়েতও হেরে গিয়েছিল এবং সবশেষে আমেরিকাও হার মানতে বাধ্য হয়েছে। এবার বাকি রইল পাকিস্তান। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগির হারবে পাকিস্তানও। কেননা ইতোমধ্যেই তালেবান হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।
একজনের মৃত্যুর বদলা নিতে ৯০ জনকে খুন করার ইতিহাস পৃথিবীতে পাকিস্তানই হয়তো বহন করে চলেছে। পাকিস্তানের পেশোয়ারে মসজিদে আত্মঘাতী হামলার পর হুংকার দিয়ে দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল তেহরিক-এ-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ মসজিদে মুসল্লিদের নামাজের সময় হামলা করে টিটিপি ঘোষণা করেছিল, এটি তাদের নেতা উমর খালিদ খুরাসানির মৃত্যুর বদলা। ২০২২ সালের আগস্টে পাকিস্তান সেনার গুলিতে নিহত হয়েছিল খালিদ। ঘটনার পর পাকিস্তান দাবি করে, টিটিপিকে মদদ দিচ্ছে আফগানিস্তান। সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিবাদ করে জানান, ‘আমাদের দোষবেন না; আগে নিজেদের ঘর সামলান।’ আজকের এ চিত্রটি এমনটা ছিল না। আফগানিস্তানে তালেবান ফিরে আসায় উচ্ছ¡সিত ছিল পাক-প্রশাসনের একাংশ। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ তো বলেই ফেললেন, পাকিস্তান তাদের দ্বিতীয় বাড়ি। অথচ সেই তালেবানই এখন পাকিস্তানের মস্ত বড় শত্রæ। আগুন নিয়ে খেললে সেই আগুনেই যে পুড়ে মরতে হয়, পাকিস্তান কি তাই শিখছে নতুন করে? লস্কর-ই-তৈয়বা, হিজবুল মুজাহিদীন, জয়েশ-ই-মহম্মদের আশ্রয়দাতা ইসলামাবাদও এবার তাদের ভুল বুঝতে পেরে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে প্রতিশ্রæতির কথা বলছে। ‘পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ’ (পিআইসিএসএস) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাকিস্তানে অন্তত ২৭১টি জঙ্গি হামলায় ৩৮৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। টিটিপিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার পারদ এবার প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে ইসলামাবাদ-কাবুল সংঘাতে। প্রায় ১৭ লাখ ৩০ হাজার আফগান শরণার্থীকে আগামী নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে পাক-সরকার। তাদের পক্ষে জারি করা নির্দেশিকায় হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে- ওই সময়সীমার মধ্যে অবৈধভাবে পাকিস্তানে বসবাসকারীরা স্বেচ্ছায় চলে না গেলে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে। আফগান শরণার্থীরা ছিল পাকিস্তানের একসময়ের নয়নের মণি, আজ তাদেরই পাকিস্তান ত্যাগের চরমপত্র দিয়েছে দেশটি।
সম্প্রতি কয়েকটি আত্মঘাতী মানববোমা হামলায় আফগান শরণার্থীদের জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে পাকিস্তানের হাতে। এমনকি আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া চিত্রাল জেলাও ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে টিটিপি। এ রকম অবস্থায় আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মধ্যে ঘনাচ্ছে যুদ্ধের মেঘ। দুই দেশের সীমানা ‘ডুরান্ড লাইন’-এর বিস্তৃতি ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। গত বছরের আগস্টে কাবুলে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তান এই সীমান্তে কাঁটাতার বসাতে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু তালেবান শাসকদের প্রবল বাধায় সে কাজ শুরু করতে পারেনি। পাকিস্তান একমুখে আমেরিকার সঙ্গে ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের ‘ওয়ার অন টেরর’-এ অংশ নিয়েছে, অন্য মুখে সেই পাকিস্তানই আবার তালেবানের সবচেয়ে বড় মদদদাতা হিসেবে কাজ করেছে। বছরের পর বছর অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে তালেবানকে আগলে রেখেছিল পাকিস্তানই। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে সোভিয়েতকে আফগানিস্তানের মাটিতে যে কোনো মূল্যে পর্যুদস্ত করাই ছিল একমাত্র মার্কিন লক্ষ্য। সন্ত্রাসবাদ তখন আমেরিকা আর পাকিস্তানের কাছেও ভালো ছিল। আমেরিকা দুধ-কলা দিয়ে যে বিষাক্ত সাপ পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে আফগানিস্তানে বড় করেছিল, সেই তালেবানই একদিন ছোবল মারা শুরু করল। ততদিনে পরিস্থিতি ওয়াশিংটনের হাতের নাগালের বাইরে। ইসলামাবাদ তখনো স্বপ্ন দেখেছিল, ধর্মের দোহাই দিয়ে আফগানিস্তানকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু তাদের সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে টিটিপি। রোহিঙ্গা সমস্যাটির সৃষ্টি তালেবান কিংবা টিটিপির সমস্যার মতো করে হয়নি। বাংলাদেশের ওপর মিয়ানমার চাপিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যাটি। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনা অভিযানের মুখে পর্যায়ক্রমে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এরও আগে এসেছিল ৪ লাখ রোহিঙ্গা। গত ৬ বছরে নতুন করে জন্ম নেয় আরো ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশু। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান একটি সামাজিক সমস্যা। তবে এ সমস্যার সৃষ্টি বাংলাদেশের হাতে ছিল না। চাপিয়ে দেয়া এ সমস্যা বাংলাদেশ মানবিক কারণে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এখানেই পার্থক্য পাকিস্তানের টিটিপি কিংবা তালেবান সমস্যা এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার। বাংলাদেশ বরং ভিন্ন আঙ্গিকের কথা ভেবেছিল। লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিলে তারা লাভ করবে বিশ্বের মানবিক সমর্থন। দেশে দেশে বৃদ্ধি পাবে তাদের মানবিক কাজের স্বীকৃতি। জাতিসংঘসহ পৃথিবীর সেরা সেরা প্রতিষ্ঠান বাহবা দেবে বাংলাদেশকে। শুকনো কিছু সাধুবাদ পেলেও বাংলাদেশ এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে লাভ করেনি কোনো দেশেরই সরাসরি সাহায্য। সবাই বলেছে- ‘ভালোই করেছ। তবে শরণার্থীদের যেন কোনো অভাব না থাকে।’ কিন্তু কোনো দেশই মিয়ানমারকে চাপ বাড়াতে এগিয়ে এসে বলেনি- ‘তোমরা তোমাদের রোহিঙ্গাদের ফেরত নাও অবিলম্বে।’ এমনকি বাংলাদেশের প্রিয় বন্ধু ভারতও সেদিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশের আরেক বন্ধু চীনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে, যার ব্যথা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রধান দুই ধরনের সমস্যায় জর্জরিত এখন বাংলাদেশ। প্রথমত তহবিল সংকটের কারণে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ায় দিন দিন বাড়ছে আর্থসামাজিক অস্থিরতা। যথার্থ অর্থের জোগান না থাকায় আগের তুলনায় অধিক হারে অপরাধে জড়াচ্ছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর। ২০১৮ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যেসব দাতা সংস্থাগুলো এগিয়ে এসেছিল, তারাও এখন চাহিদানুযায়ী সহায়তা প্রদানে সমর্থ হচ্ছে না। চলতি বছরে দুই দফায় কমানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের রেশন বরাদ্দ। প্রথম দফায় ১ মার্চ থেকে রেশন বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ১ জুন থেকে আরো ২ ডলার কমিয়ে এখন ৮ ডলারে আনা হয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যাটি আরো ব্যাপক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। একের পর এক রোহিঙ্গা নেতা খুন হয়েছে। মূলত শরণার্থী শিবিরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লড়াই চলছে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের মধ্যে। মিয়ানমার জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) ও মিয়ানমার বিদ্রোহী সংগঠন ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনে’র (আরএসও) মধ্যে চলছে এ লড়াই। ইতোমধ্যে জানা গেছে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরসা’র কিলার গ্রুপের প্রধান নুর কামাল ওরফে সমিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তার কাছ থেকে দেশি-বিদেশি কয়েকটি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটসে’র সভাপতি মহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। রোহিঙ্গা ফিরিয়ে না নিতে মিয়ানমারের অনমনীয় মনোভাব, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বিশ্বসংস্থার উদাসীনতা, মিয়ানমার রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর জঙ্গি তৎপরতা, অতিরিক্ত চাপে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে অস্থিরতা- সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে এক দুর্বিষহ সমস্যায় ফেলেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাংলাদেশের এখন জানা নেই। মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে এখন বাংলাদেশই মানবিক বিপর্যয়ের মুখে।
এ সমস্যার ভবিষ্যৎ ভয়টা আরো ভয়াবহ হতে পারে। আজ পাকিস্তান যে টিটিপি আর তালেবান নিয়ে জঙ্গি তৎপরতার অত্যাচারে জর্জরিত, বাংলাদেশও একদিন এই আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তৎপরতার শিকার হতে পারে। ‘আরসা’ আর ‘আরএসও’র জঙ্গি তৎপরতা অস্থির করে তুলতে পারে বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠীকে। পাকিস্তান আজ যা বুঝতে পারছে, বাংলাদেশ আগামী কোনো একদিন কি নিজেকে প্রশ্ন করবে- রোহিঙ্গা বোঝা, না বিপদ?

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়