রাজপথে সহিংসতা ও প্রাণহানিতে মর্মাহত ইইউ

আগের সংবাদ

খুনিদের সঙ্গে সংলাপ নয় : সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হতে সাবধান!

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

যে কোনো দেশের জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক পুনরুত্থান এক অশনিসংকেত। আর তা যদি হয় একটি দেশের জাতিসত্তা, সংস্কৃতি তথা শেকড়কে নির্মূল করার রাজনৈতিক আদর্শ, তাহলে তার পরিণাম ভয়াবহ। গত অর্ধশতকের অভিযাত্রায় বাংলাদেশের পথে পথে এমনই শ্বাপদ-বিপদের অভাব ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার রক্তবীজ বিষবৃক্ষরূপে দিনে দিনে প্রকাণ্ড থেকে প্রকাণ্ডতর হচ্ছে। আজো স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের দূষিত মত প্রকাশ করছে। প্রতিকূল লক্ষ্যের রাজনীতি করছে। দেশের ভাগ্যনিয়ত্তা হওয়ার অভিলাষ প্রকাশ করছে। এসব কারণে প্রচণ্ড খেদ হয়, চিৎকার করে জানতে ইচ্ছা করে- আমাদের পূর্বজনরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল কি এই কারণে, এই বাংলাদেশের জন্য? মুক্তিযুদ্ধ কি এই জন্য হয়েছিল যে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কীভাবে চলবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে স্বাধীনতাবিরোধীরা? দেশদ্রোহীদের গাড়িতেও উড়বে জাতীয় পতাকা?
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ নানাভাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অপতৎপরতাকে চিহ্নিত করেছিলেন। সেসবের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শনাক্তকরণ ছিল- বাংলাদেশকে বাংলাস্তান করার চক্রান্ত। অর্থাৎ স্বাধীনতাদ্রোহীরা বাংলাদেশকে বাংলাস্তান করার জন্য এ দেশের সংবিধানকে যখন বেছে নিয়েছিল তখনই হুমায়ুন আজাদ তাদের ভবিষ্যকালীন অপতৎপরতাকে উপলব্ধি করেছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির বাংলাদেশবিরোধী ক্রিয়াকলাপের শুরুটা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকেই। যেমন একাত্তরের ২১ ডিসেম্বরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগের প্রাক্কালে প্রায় ১০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ ব্যাংক নোট জ¦ালিয়ে দিয়েছিল এবং সে কাজে তথ্য জুগিয়েছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের অঙ্কুরোদ্গম পর্যায়েই তার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া। আর পলাতক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে লন্ডনে বসে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনর্গঠন কমিটি’ গঠনপূর্বক নানা রকম অপতৎপরতা চালায়। লক্ষ্য ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে আবারো পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করা।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এসব সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেশে ও দেশের বাইরে বসে অতি গোপনে তাদের কার্যক্রম চালায়। অতঃপর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে এবং নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। আর তখনই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। গোলাম আযম গং সরকারি ইশারায় দেশে ফিরে আসে। প্রথমে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ নামে এবং পরবর্তী সময়ে পুরনো পরিচয় অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে সেই অপশক্তির। অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে নারীর সমঅধিকার ও সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পথে প্রধানতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই সাম্প্রদায়িক শক্তি। নারী শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর উদার অংশগ্রহণের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা দাঁড় করায় ধর্মকে। এ দেশের ধর্মভীরু মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে পুঁজি করে তারা ধর্মীয় অপব্যাখ্যার নানাবিধ গর্হিত চর্চা শুরু করে। তাদের এই ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি বাংলাদেশের অভিযাত্রাকে অনেকাংশে পিছিয়ে দিয়েছে। তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ জনগণকে বোকা বানিয়ে ভোটের রাজনীতিতে কয়েকবার ফায়দা লুটেছে। আর ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক- ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ১৭ জন এমপি হয়েছিলেন। তন্মধ্যে ২ জন মন্ত্রীও হয়েছিলেন। যারা পালাক্রমে কৃষি, শিল্প ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কারণ এই তিন মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং এনজিওভিত্তিক রাজনীতিতে একটি পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। বলে রাখা প্রয়োজন তারা কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ধারেকাছেও যায়নি কখনো। যদিও ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচজন, কিন্তু জামায়াত কখনো এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কারণ একটাই- ধর্ম তাদের বিশ্বাস নয়, এটা তাদের ব্যবসা। আর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলে তো মসজিদ-মাদ্রাসা বানাতে হবে, যেখানে কোনো আর্থিক লাভ নেই; তবে তারা শিল্প আর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে নিজেদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আর এনজিও গড়তে পেরেছে, যা আজো তাদের মৌলবাদী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার শুধু তাদেরই আছে যারা ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে ধারণ করে, মহান মুক্তিযুদ্ধকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করে, আমাদের পবিত্র সংবিধানকে লালন করে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে ভালোবাসে, যারা জনগণের প্রতি প্রতিশ্রæতিবদ্ধ এবং বাঙালি জাতিসত্তাকে সর্বসময় ও সর্বক্ষেত্রে বহন করে। সুতরাং যারা সংবিধানকে পরিবর্তন করতে চায়, পাকিস্তানি ফর্মুলায় বাংলাদেশের রিফর্মেশন চায় তারা মূলত স্বাধীনতাবিরোধী ও দেশদ্রোহীদের এক ঐক্যজোট। বাংলাদেশ তাদের হাতে নিরাপদ নয়, কোনোদিন ছিল না, কোনোদিন হবেও না। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারো সেই অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যখন স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে তখন ক্ষতবিক্ষত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মøান হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাস এবং কলঙ্কের কালিমা লাগে নতুন প্রজন্ম হিসেবে আমাদের গায়েও।
আমরা যদি একটি সংস্কৃতিবান্ধব বাংলাদেশ চাই, রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ চর্চার পরিবেশ চাই, নারীর জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাশীল কর্মক্ষেত্র চাই, জঙ্গিবাদের করালগ্রাসমুক্ত নাগরিক জীবন চাই, সব ধর্মের সহাবস্থান চাই, ভয়মুক্ত উৎসব-পার্বণের নিশ্চয়তা চাই, তাহলে স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশবিধ্বংসী মত ও পথকে রুখতে হবে। কারণ তারা বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে চায়। এ দেশের জন্মলগ্নে পরাজয়ের যে স্বাদ স্বাধীনতাবিরোধীরা পেয়েছিল সে স্বাদ তারা ভুলতে চায়। প্রতিশোধলিপ্সু এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য হচ্ছে যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করা। কারণ বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সূচকে পাকিস্তানের পেছনে পড়লে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি তুষ্ট হবে, কিছুটা নিস্তার পাবে। বস্তুত তারা সে দেশের জনগণের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশের মতো সফল একটি রাষ্ট্র তাদের কাছে প্রত্যাশা করে। কিন্তু গত ছিয়াত্তর বছরে পাকিস্তানের যে জন্ম-মৃত্যু দর্শন মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে বিবর্তিত রাজনীতির যে গতি-প্রকৃতি তাতেও আশাব্যঞ্জক কিছু নেই। অথচ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বিষয়টি তাদের জন্য খুবই ঈর্ষা কাতরতার। তাইতো এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের পাকিস্তানি প্রভুদের খুশি করতে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে রূপ দিতে চায়। আর এটাই স্বাধীনতাদ্রোহীদের চিরায়ত লক্ষ্য। সুতরাং স্বাধীনতাবিরোধীদের থেকে সাবধান বাংলাদেশ!

শেখ ফয়সল আমীন : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়