জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যাংকের পরীক্ষা স্থগিত

আগের সংবাদ

ইমামদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী : তৃণমূলে শান্তি বজায় রাখতে আপনাদের সহযোগিতা চাই

পরের সংবাদ

হত্যা, ধ্বংসস্তূপ এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৩০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিবিসি-আইটিভি কিংবা স্কাই নিউজ আমার মতো অনেকেই দেখে থাকেন এই ব্রিটেনে। ব্রিটেনভিত্তিক গণমাধ্যমের এগুলো উল্লেখযোগ্য মিডিয়া। গত কয়েক মাস জেলোনস্কি নিয়ে মাতম ছিল এই গণমাধ্যমগুলোতে। জেলোনস্কির কাছে বরিস জনসনের উড়ে যাওয়া, সেখানে গিয়ে বন্ধুত্বের বার্তা পৌঁছে দেয়া দেখেছে বিশ্ব। কিন্তু ব্রিটেনের আপামর মানুষের সমর্থন নিয়ে কি টিকে থাকতে পেরেছিলেন বরিস। মাত্র কিছুদিনের মাথায় তাকেও সরে যেতে হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন ঋষি সুনাকও। তিনিও গিয়েছিলেন বিগ ব্রাদারের বার্তা নিয়ে। তিনিও দিয়েছিলেন ‘আমরা আছি’ ধরনের আশ্বাস। কিন্তু সেই আশ্বাস দিন দিন মøান হতে থাকে। যুদ্ধ যতই প্রলম্বিত হতে থাকে, ততই আশ্বাসও ঢিলেঢালা হয়ে যায়। কারণ এ যুদ্ধজয় সহজ নয়। পুতিনতো এমনিতেই পশ্চিমাদের জন্য এক অস্বস্তির নাম। সেই নামের পাশাপাশি স্বৈরতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার স্বেচ্ছাচারী কিম জং উন কিংবা চীনের জিনপিংয়ের নাম উঠে আসে এই গণমাধ্যমগুলোতে। কিন্তু পুতিনের সঙ্গে পেরে ওঠা হয়তো কঠিন। সংঘাত-সংঘর্ষ-প্রোপাগান্ডা কিছুতেই কিছু হয়নি। বরং পুতিন তার ‘স্বৈরতান্ত্রিকতা’ দিয়ে লড়েছেন, লড়ছেন এবং বলতে হবে এতে তিনি এখনো অপরাজিত।
জেলোনস্কি এখন এসব মিডিয়ায় উপেক্ষিত। জেলোনস্কির ভাগ্য কি পুতিনের সঙ্গে একটা সমঝোতার মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে? ন্যাটোর জন্য যতটুকু না প্রয়োজন ইউক্রেন, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি প্রয়োজন মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য। আর তাইতো হামাসের ইসরায়েল আক্রমণে যেন আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে গোটা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। হামাসের অতর্কিত আক্রমণে ১৪০০-এর মতো মানুষ নিহত হওয়া নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে এখন যা ঘটছে, তাতে তো বিশ্ববিবেক শুধু বিস্মিতই নয়, প্রতিদিনই আমরা দেখছি নৃশংসতার নতুন নতুন অধ্যায়। এখন পর্যন্ত সাত সহস্রাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, মরছে এখনো। যুদ্ধ বন্ধ না হয়ে এভাবে চলতে থাকলে লাশের সারি শুধু বাড়বেই। প্রতিদিন শত শত মানুষ নিহত হচ্ছে, গাজা যেন এক মৃত্যু উপত্যকার নাম।
এ নিয়ে পশ্চিমের দ্ব›দ্বটাতো আছেই ইরানের সঙ্গে, আছে তুরস্কের সঙ্গে, আছে লেবাননের সঙ্গে। আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের সভায় গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইসরায়েলে ভয়ংকর এক হামলা চালিয়েছে হামাস। তবে হামলা যে হঠাৎ কিংবা অকারণে হয়নি, এটাও সবাইকে বুঝতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার। তারা তাদের ভূখণ্ডের দখলদার অবৈধ ইহুদি বসতি দেখেছেন, এখনো দেখছেন। তারা সহিংসতায় শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
জাতিসংঘপ্রধান আরো বলেন, গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা যেমন হামাসের ভয়ংকর হামলার ন্যায্যতা দিতে পারে না, তেমনি আবার এ হামলার জেরে জাতিগতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণকে শাস্তি দেয়া কখনো ন্যায্যতা পেতে পারে না।
অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বক্তব্যের পরপরই ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানায় ইসরায়েল। ইসরায়েলের জন্য জাতিসংঘ হয়ে গেছে যেন আরেক ইরান কিংবা তুরস্ক অর্থাৎ জাতিসংঘও এখন তাদের আরেক প্রতিপক্ষ। গুতেরেসের মন্তব্যের পর সেদিনই তার পদত্যাগ দাবি করে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলার্ড এরডান। তিনি বলেন, গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নন। তার পদত্যাগ করা উচিত। গতকাল বুধবার তিনি বলেছেন, জাতিসংঘের কর্মীদের ইসরায়েলের ভিসা দেয়া হবে না। কিন্তু আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর এতে কোনো প্রতিক্রিয়াতো নেই। অর্থাৎ ইসরায়েলের আক্রমণকে কিংবা বিদ্যুৎ-জ্বালানি-খাদ্য বন্ধ করে দেয়াতে তারা কোনো দোষের কিছু দেখছে না।
কিন্তু পশ্চিমারা রাজত্ব চালালেও সারা পৃথিবীতেই আছে প্রতিবাদ। এমনকি লন্ডনের রাস্তায় ফিলিস্তিনের পক্ষে তিন লাখ মানুষের মিছিল হয়েছে, সেখানে শুধুই অ্যারাবিয়ান মানুষই ছিল না, ছিল ভিন্ন বর্ণ ও ধর্মের মানুষ। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এখানেও সংহতি জানিয়েছে ইসরায়েল বংশোদ্ভূত অনেক মানুষ। যারা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল, এরাও চাইছিল ফিলিস্তিন নামক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আর গণহত্যা রোধ। ইসরায়েলের অভ্যন্তরেই তো এমনকি ইহুদি জনগোষ্ঠীর জনপ্রতিনিধি (সাংসদ) পর্যন্ত ইসরায়েলের এই ভয়াবহ নৃশংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, এখনো বলছেন।
ইসরায়েলের বোমা হামলায় ১৪০০ মানুষের নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পাল্টা প্রতিশোধে নেতানিয়াহু দ্বারা প্রতিদিন ঘটে যাওয়া শত শত মানুষের খুন হওয়াকে গণহত্যার পর্যায়েই নিয়ে আসছে না। যুদ্ধে জর্জরিত সাধারণ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, খাদ্য সরবরাহে রীতিমতো ইসরায়েলি শাসকরা প্রতিবন্ধকতা নয়, বন্ধ করে দিয়েছে, শিশুদের হত্যা করছে, হত্যা করছে নারীদের, জাতিসংঘ পর্যন্ত বলছে এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব নির্বিকার। ইউক্রেনে যখন এর এক-তৃতীয়াংশ মানুষও নিহত হয়নি, তখন এটাকে তারা পুতিনের মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখিয়ে এর বিচার করার অঙ্গীকার করেছে। পৃথিবীর অনেক মানুষও স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের এ মানবিক দাবির সঙ্গে একাত্মও থেকেছে, কিন্তু তারা ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের দ্বারা ১৪০০ মানুষ নির্মমভাবে হত্যার কিচ্ছা শোনাচ্ছে বারবার মিডিয়ার প্রতিটি পাতায় পাতায় এবং ঔদ্ধত্যের সঙ্গে যেন জানান দিচ্ছে, গাজায় প্রতিদিনের লোম জাগানিয়া বিমান হামলায় বীভৎসভাবে আহত-নিহত হওয়ার সংবাদ।
সব দেশেরই একটা নিজস্ব রাজনৈতিক পর্যালোচনা থাকে, লক্ষ্য থাকে। ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বটাও থাকে আলাদা আলাদা। আন্তর্জাতিক স্বার্থ কোন জায়গায় কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাবে, তা নিয়ে থাকে তাদের নিজস্ব পদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনমুখী করে তুলতে ব্যবহৃত হয় গণমাধ্যমগুলো। লেবার-টরি রাজনৈতিক দ্ব›দ্বটাতো আছেই। সেই জায়গায় গণমাধ্যমগুলো সব সময় এক হয় না, যা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়া থেকে শুরু করে হালের ইউক্রেন কিংবা মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে গণমাধ্যমগুলোতে কোনো দ্বিধা নেই। রাজনৈতিক মতদ্বৈততাও নেই। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণতো আমরা দেখছিই।
এমনকি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হামাস তথা ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে কথা না বলার নির্দেশনা এসেছে। সেজন্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ নিয়ে কোনো কথা বলেন না এমনকি শিক্ষকরাও। লন্ডনের রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে ‘জিহাদ’ শব্দটি ফেস্টুনে দেখা গেছে। সন্দেহ নেই সারা পৃথিবীজুড়েই এ শব্দটি একটা নেতিবাচক শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হয় বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলোতে কিংবা প্রগতিবাদী মানুষগুলোর মুখ থেকে। ব্রিটেনে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ এই শব্দটা। আর সে জন্যই হয়তো ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোয়েলা ব্রেবারম্যান ফেস্টুনে এই শব্দটা লেখার কারণে কেন কোনো গ্রেপ্তার করা হলো না- এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু লন্ডনের ম্যাট পুলিশ এ নিয়ে কোনো তর্কে না জড়িয়ে শুধু বলেছে, ‘জিহাদ’ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আছে, আর সে জন্য তারা এই লেখার জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। তবে জিহাদ শব্দটা দিয়ে ফিলিস্তিনি জনযুদ্ধকে ইসলামিক সেন্টিমেন্ট নিয়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ ফিলিস্তিনি জনগণের দাবি শুধুই ইসলামিক স্পিরিট নয়, এ এক মানবিক আকুতি, এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতে হবে ইসরায়েলের আগ্রাসনকে। অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিবাসী মানুষের আস্থার জায়গা লেবার পার্টির প্রধান স্যার কিয়ার স্টারমার ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত উক্তি করেছেন। তিনিও সেই একইভাবে গাজার মানুষের হত্যাযজ্ঞ না দেখে বলেছেন ইসরায়েলেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে।
ব্রিটেনে ফিলিস্তিনি মিশনের প্রধান হুসাম জোমলট ‘বিবিসি নিউজনাইট’-এর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার পরিবারের সাত সদস্য ইসরায়েলি বোমার আঘাতে নিহত হয়েছেন, তখন তার সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একটা লোক দেখানো সমবেদনা জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সংযোগ করেন এবং বলেন, ‘আপনি ইসরায়েলে বেসামরিক হত্যাকাণ্ডকেতো ক্ষমা করতে পারবেন না’। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে আশাবাদ এর চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়