কাপাসিয়ায় গ্রেপ্তার ৭৬, বিএনপির দাবি শতাধিক

আগের সংবাদ

ভুল চালে ব্যাকফুটে বিএনপি : দিতে হচ্ছে সহিংসতার খেসারত > নতুন করে আন্দোলনে গতি ফেরানো কঠিন হবে

পরের সংবাদ

হামাসের হামলা শূন্য থেকে হয়নি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছিল, তা ‘শূন্য থেকে’ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে এসব কথা বলেন তিনি। গুতেরেস বলেন, ‘হামাসের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। তারা তাদের ভূখণ্ড বসতিতে পরিণত হতে এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।’

দুই.
ধনবানের আর্থিক-জোর আর সামরিক বল তাদের ক্ষুধাই কেবল বাড়ায় না, নতুন নতুন পরিকল্পনাও তারা আঁটেন। তারই একটি ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র স্থাপন। ব্রিটেন ও আমেরিকা তাদের বিপুল পরিমাণ জায়গার একটি অংশে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারত, যদি সত্যিই তাদের মনে ইহুদিদের জন্য মানবিকতার উপাদান থাকত। না, সেটা তারা করেনি। কিন্তু তারা কেন ফিলিস্তিনিদের বুকের মাঝখানে এই ঘাতক রাষ্ট্র কায়েম করল? সেটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। শিখণ্ডি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কারণ যে মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যের বুকে একটি দারোয়ান নিয়োগ করা, এটা ইসলামি উম্মাহর দেশগুলো উপলব্ধি করতে পারলেও সেই সময় তারা ওই বিজয়ী পরাশক্তিকে থামাতে পারেনি। না, করার পেছনে ওইসব দেশ ছিল এবং আজো আছে। আমেরিকারই পরোক্ষ সহযোগী, অনেকটাই অপ্রকাশ্য করদরাষ্ট্র। না হলে আরব আমিরাত ও সৌদিদের তৈরি নাম সৌদি আরবের রাজতন্ত্র টিকে থাকতে পারত না। তার মানে ওই ক্ষমতাবানরাও সামাজিকভাবে শিখণ্ডি, আর তারই ফল হচ্ছে ইসরায়েলেই অংশীজন। একা ইসরায়েলের টিকে থাকা অসম্ভবপ্রায়। সেই বিবেচনায় মার্কিনি-ব্রিটিশ তিন পাশের মুসলমান দেশগুলোর চেতনায় এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে তোমরাও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শিখণ্ডি। তোমাদের শাসন ও প্রশাসনও তোমাদের জনগণের মধ্যে প্রোথিত নয়। ফলে তোমরা যদি আমাদের পরিকল্পনা মোতাবেক না চলো, তাহলে তোমাদের উৎখাত করা হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিকল্পিত বিষয়টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পার করেছে, কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্র কায়েমের চিন্তা ও তৎপরতা বাতিল হয়নি।
অ্যান্তোনিও গুতেরেস তো কেবল ৫৬ বছরের কথা বলেছেন, আসলে ওই শিখণ্ডির সূচনা আরো আগে থেকেই প্রোথিত পুঁজিবাদী বিশ্বের অন্তরে। তারা কেবল মানুষ হননকারীই নয়, তারা সম্পদ লুটেরাও। তাদের, মানে পুঁজির ধর্মানুযায়ী বিভিন্ন দেশের সম্পদ লুটে নিয়ে নিজেদের সম্পদশালী করাই মূল লক্ষ্য। গত শতকের ৩০-৭০-এর দশক পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের খনিজসম্পদ শুষে নিয়েছে ব্রিটিশ ও আমেরিকা। আজো তা অব্যাহত, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ভাব ও দর্শনগত আলোকে তা অব্যাহত। কালচারালি মধ্যপ্রাচ্যকে পদানত করতে পারেনি, কিন্তু তাদের কালচারের বহু রকম উপাদান উপকরণ ঢুকিয়ে দিয়েছে ওইসব দেশের সাংস্কৃতিক চেতনায়। লক্ষ্য, কালচারালি মধ্যপ্রাচ্যকে পদানত করা। ইন্দো-মার্কিনি চিন্তার প্রবাহেই তাদের সাংস্কৃতিক বয়ান রচিত হলে ওই পদানত চেতনা তো শতাব্দীকাল ধরেই চলতে থাকবে। আমরা যেমন ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশক শাসনমুক্ত হয়েছি; কিন্তু আমাদের চিন্তা ও চেতনা থেকে তাদের শেকড় উৎপাটন সম্ভব হয়নি। আমাদের ভাবনাস্রোত তো পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতিরই অন্তর্গত। আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো তাই অর্জিত হলেও কালচারাল স্বাধীনতা আজো অর্জিত হয়নি। ঠিক একই কারণেই তেল উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক ঐক্যে পৌঁছাতে পারেনি, পারে না। জর্ডান, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক কেন এক হয়ে শিখণ্ডি ইসরায়েলকে উৎখাত করতে পারে না? আরব দেশগুলোর এই অনৈক্যই শিখণ্ডি ইসরায়েলের টিকে থাকার একদিকের বহিরাবরণ। আর মৌলিক দিকটি হচ্ছে আমেরিকার মানবতাবিরোধী তৎপরতা।
৭ অক্টোবর হামাস দৃশ্যত তেল আবিবে হামলা চালালেও আসলে ইসরায়েলই প্রথম আক্রমণ করেছে জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে। সেই ভাষণে বেনজামিন নেতানিয়াহু বলেছেন হামাস বা ফিলিস্তিনকে পারমাণবিক সংঘাতের স্বাদ পেতে হবে। তবে তার অফিস সংশোধন করে বলেছে মারাত্মক সামরিক সংঘাতের স্বাদ পাবে।
এরপরই মূলত দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হামাসের চিন্তায় ইসরায়েলকে আক্রমণের দুয়ারে নিয়ে আসা। হামাসের পেছনে ইরান আছে। এই তথ্য সত্য হলেও তা অভিযোগের কিছু নেই। এটা প্রকাশ্য যে লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরানের সামরিক শক্তিতেই চলছে। আমেরিকা যদি প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা হয়ে থাকে, তাতেই তো প্রমাণ হয়, ইসরায়েল কোনো রাষ্ট্র নয়, ফিলিস্তিনিদের জমিতে একটি সামরিক বীজ বপন করেছে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষার জন্য।
হামাসের তেল আবিব আক্রমণের পরই মার্কিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন জানালেন ইসরায়েলের প্রতি। উড়ে গেলেন তেল আবিব। মানুষ হত্যার এই সামরিক খেলায় জো বাইডেনের চোখে জল আসে না। তিনি মায়া কান্না কাঁদতে পারেন। সেই মিথ্যা ভেদ করে তার নগ্ন ইসরায়েলের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন মানবতাকে টিটকারী দিচ্ছে।
আর জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি প্রতিনিধি হামাসকে সমর্থন তথা মানবতার প্রতি গুতেরেসের মানবিকতা প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। গুতেরেসের নাম না নিলেও তিনি যে কথা বলেছেন, তার মর্ম হচ্ছে বিশ্ব সংগঠনের নেতা হিসেবে গুতেরেসকে বের করে দেয়া উচিত। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের ভেতরে বসে, এই আহ্বান জানানোর পরও কী করে তা পৃথিবীর বড় দেশগুলো, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য দেশ সহ্য করল?
স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করতে পারত। কিন্তু তারা তা নেয়নি। নীরবতার অন্য মানে হচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিনিধির কথাগুলোকে মেনে নেয়া। জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য তো অনন্য এক নির্মম-সত্য, যা মুছে ফেলা যাবে না। এই রকম এক জটিল সামরিক ও রাষ্ট্রনৈতিক মনস্তত্ত্বের ভেতরে প্রবহমান ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ হতে হতে এখন একেবারে অস্তিত্ব হারানোর স্তরে এসে পৌঁছেছে।
মার্কিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন জাতিসংঘের বক্তৃতায় বলেছেন তিনি উদগ্রীব হয়ে আছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েন ইয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। বিষয় ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত করা। চীন বলেছে, ইসরায়েলকে মানব হত্যার এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। হামাস বলেছে তেল আবিব যদি ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধ করে তাহলেই কেবল বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে। তা না করলে এদের কী হবে তা তারাও বলতে নারাজ।
আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছি ইসরায়েলের অস্ত্রের মুখে ফিলিস্তিনিরা কতভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়ে আসছে। ফিলিস্তিনি মানুষের ঢিলের বদলে ইসরায়েল বাহিনীর গুলি এসে রক্তাক্ত করেছে মানুষের জীবন। তারা ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না। ইসরায়েলে এই নৃশংতা ও তাদের ভূমি দখলের দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে দেখব ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রটিকে নিশ্চিহ্ন করাই মূল লক্ষ্য।
আমেরিকা ও তার রাজনৈতিক ও সামরিক অ্যালিদের উচিত ইসরায়েলের মতো একটি শিখণ্ডিকে সমর্থন বন্ধ করে বৃহত্তর মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।
প্রথম কাজ হবে জাতিসংঘে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সদস্যপদ বাতিল করা। কারণ ওই দেশটির কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ওই দেশের মাটিতে ছিল না, আজো তা নেই। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে ওই শিখণ্ডি রাষ্ট্রের, যারা বাসিন্দা তাদের মূল দেশে পুনর্বাসিত করা। কারণ এরা কেউই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে সেমেটিক সভ্যতার মানুষ নন। অধিকাংশই এসেছে পূর্ব ইউরোপের দেশ থেকে।
তবে এটাই সত্য যে জাতিসংঘের নিয়ন্তাশক্তি হচ্ছে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ। তাদের সঙ্গে আছে পশ্চিম ইউরোপিয়ান সামরিকভাবে বলশালী ন্যাটোর সদস্য দেশ, যারা কনফ্লিক্ট জিইয়ে রাখার স্ট্যাটেজিতে বিশ্বাসী। কনফ্লিক্ট জিইয়ে রাখার সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহ, অস্ত্র বিক্রি-বাণিজ্য অন্যতম কারণ। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে তা করে। আমেরিকার রাষ্ট্রনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট ও ভাষা বিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি বলেছেন আমেরিকা হচ্ছে একটি সন্ত্রাস উৎপাদক দেশ।’
সে সন্ত্রাস উৎপাদন ও রপ্তানি করে এবং বাণিজ্য করে অস্ত্রের। এটা আমার ধারণা। মানবতা রক্ষা নামে চলে তার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবসাও। সে মানবাধিকার রক্ষার এক বড় ব্যবসায়ী এবং মানবতা হরণেরও বড়দেশ। নিজ দেশে তো বটেই, পৃথিবীর ছোট ও উন্নয়নশীল দেশেও সে তার রাজনৈতিক মানবতাবাদের নিশান তুলে মানুষের মনে বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়ে থাকে। কম্বোডিয়া তার এক বিজয় হয়েছে সম্প্রতি, এখন চলছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভিসানীতির প্রয়োগ।
কিন্তু ফিলিস্তিনি জনতার রাজনৈতিক স্বাধীনতায় আমেরিকা সাহায্য করবে না। তাহলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে এতটা উদগ্রীব কেন ব্লিঙ্কেন?
আমেরিকা চায়, আমার ধারণা, ইসরায়েল ফিলিস্তিনির হামাস যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক। মানুষ হত্যাই হোক বা ধ্বংস হোক গাজার মতো প্রাচীন এই শহর। এতে করে ইসরায়েলেরই লাভ। সে গোটা ফিলিস্তিনই দখল করে নিয়ে দেশের প্রকৃত মালিকদের আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত করবে। তাদের ওপর জার্মান নেতা হিটলার যে নৃশংসতা দেখিয়ে ইহুদিদের উদ্বাস্তু করেছিল, আজ ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদেরও সেই পরিণতি পুনর্জন্ম দিতে চায়। এইটাই মূল চেতনা বলে আমার বিশ্বাস। ইতিহাসে আর কী কী হবে, তার জন্য আমরা বেঁচে থাকব?

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়