শিক্ষার্থী নির্যাতন : উইলস লিটল স্কুলের অধ্যক্ষসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে সমন জারি

আগের সংবাদ

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে আ.লীগ

পরের সংবাদ

দুর্গাপূজা ও ‘হৃদয়ের অভ্যাস’

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুর্গাপূজা বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম উৎসব। প্রতিটি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে এই পূজা স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের দুর্গাপূজা শুধু সনাতন ধর্র্মাবলম্বীদের পূজাই নয়, এ পূজা অসাম্প্রদায়িক উৎসবেরও প্রতীক। অথচ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই এই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত করে। দৃশ্যত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত করা বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর ‘হৃদয়ের অভ্যাস’। এই অভ্যাসের বশবর্তী হয়েই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ‘হৃদয়ের অভ্যাস’ বা ‘হ্যাবিটস অব দ্য হার্টস’ শব্দগুচ্ছ ১৮৪০ সালে আমেরিকার গণতন্ত্র সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আলেক্স ডি টক্ভিল ব্যবহার করেছিলেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-জামায়াতের সেই ‘হৃদয়ের অভ্যাস’-এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের দামামা বাজায় চারদলীয় জোট সরকার। শুধু সংখ্যালঘু নির্যাতনই নয় বাংলাদেশের হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সংখ্যালঘুরা ২৫ হাজারেরও বেশিবার হামলার শিকার হয়েছিল। ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা শুরু করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। যা চলে পরবর্তী পাঁচ বছর। বাগেরহাট, বরিশাল, ভোলা, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ফেনী, নাটোর, পিরোজপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালানো হয়।
এছাড়া ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৫ হাজার মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এই হামলার নেতৃত্বে ছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় ২০০৫ সালে দুর্গাপূজা না করার সিদ্ধান্ত নেয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এতে টনক নড়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের। এক প্রকার জোর করেই স্বল্পসংখ্যক মন্দিরে পূজা করানো হয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশে সর্বনিম্নসংখ্যক মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজা বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালন সম্পর্কে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর এ ধরনের ‘আগ্রাসী টেনশন বা আগ্রাসী তৎপরতা’ চূড়ান্ত বিচারে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর! ১৮৪০-এর দিকে ‘ডেমোক্র্যাসি ইন আমেরিকা’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, অ্যালেক্স ডি টক্ভিল আমেরিকানদের ‘হৃদয়ের অভ্যাস’/‘হ্যাবিটস অব দ্য হার্টস’ (তাদের রীতিনীতি এবং মূল্যবোধ প্রভৃতি)-এর মধ্যে সম্প্রদায়ের সংহতি এবং আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ভেতর গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে পারার মতো একটি উত্তেজনা লক্ষ করেছিলেন। এখানে ‘সম্প্রদায়’ বলতে টক্ভিল ‘রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে’ বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মের আগ্রাসী স্বাতন্ত্র্যবাদ রক্ষার তৎপরতা তেমনি এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর! যদিও তারা দিনরাত ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে গলা ফাটিয়ে বেড়াচ্ছে!
টক্ভিল কর্তৃক ব্যবহৃত ‘হ্যাবিটস অব দ্য হার্টস’ বা ‘হৃদয়ের অভ্যাস’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রয়োগ করতে চাই তাহলে বলা যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্প্রদায় প্রধানত দুই ধরনের হৃদয়ের অভ্যাস পোষণ করে থাকেন। একটা হচ্ছে ‘১৯৪৭-এর পাকিস্তান বা দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ভিত্তিক ‘হৃদয়ের অভ্যাস’। আর একটি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ভিত্তিক ‘হৃদয়ের অভ্যাস’। বলাবাহুল্য, বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী ‘১৯৪৭-এর পাকিস্তান বা দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ভিত্তিক ‘হৃদয়ের অভ্যাস’-এর ধারক ও বাহক। আর তাদের অনুসৃত ‘হৃদয়ের অভ্যাস’ ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গা মূর্তি ভাঙা, মন্দির ও উপাসনালয়ে আক্রমণ প্রভৃতি করে থাকে।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হয়। ফলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যেন তাদের নিজ নিজ ধর্ম সঠিকভাবে পালন করতে পারে তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দেশরতœ শেখ হাসিনার সরকার। ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরসহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলায় মোট ১৫৮ মন্দির ও শ্মশান ঘাট সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও শ্মশান নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো আছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সংখ্যা বাড়ছে। এ বছর সারাদেশে ৩২ হাজার ৪০৮টি দুর্গাপূজা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় যা ২৪০টি বেশি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। প্রতিটি সভায় তিনি স্মরণ করিয়ে দেন এ দেশে কেউই সংখ্যালঘু নয়। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবার দেশ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শিল্পীর কণ্ঠে গীত ‘আমারই দেশ সব মানুষের সব মানুষের সব মানুষের, ছোটদের বড়দের সকলের গরিবের নিঃস্বের ফকিরের; হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান দেশমাতা এক সকলের…লাঙ্গলের সাথে আজ চাকা ঘোরে এক তালে এক হয়ে মিশে গেছি আমরা সে যে কোন কালে, মসজিদ মন্দির গির্জার আবাহনে বাণী শুনি একই সুরে…।’
এই জনপ্রিয় গানের ‘এক হয়ে মিশে গেছি আমরা সে যে কোন কালে’ কথাগুলো বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জনগণের রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপ্রকাশের কথা বলে। এখানে বোঝানো হয়েছে, রাজনৈতিক সম্প্রদায় গঠনকল্পে যে কর্মকাণ্ড তা হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতি শুরু হচ্ছে নারী-পুরুষের অভিন্ন উদ্দেশ্যে সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে। আগে থেকে অস্তিত্ব না থাকলে, এ ধরনের সংগঠনের জন্য প্রয়োজন একটি সম্প্রদায়ের। সমস্ত রাজনৈতিক ধারণার মধ্যে (রাজনৈতিক) সম্প্রদায় সবচেয়ে একটি প্রারম্ভিক ধারণা। অবশ্য সম্প্রদায়ের ধারণার মধ্যে অন্যান্য অনেক দিক রয়েছে তবে সমস্ত সম্প্রদায়ই অগত্যা রাজনৈতিক, অথবা সব সম্প্রদায়কে ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত (এবং শাসিত) করা হয়। ক্ষমতা বলতে কী বোঝায় এবং একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই নিয়মগুলো কী তা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মৌলিক প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি ‘রাজনৈতিক সম্প্রদায়’ গড়ে ওঠার আগেও এদেশে একটি ‘রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের’ অস্তিত্ব ছিল বা এখনো আছে। পূর্ব থেকে চলে আসা সেই ‘রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের’ আদর্শ হচ্ছে ‘দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তানি’ আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই আদর্শ আপাত পরাস্ত হলেও তারা স্বাধীন বাংলাদেশের সক্রিয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হচ্ছে ‘হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান, এক জাতি এক প্রাণ’। এই আদর্শের বিরুদ্ধ আদর্শের অনুসারীরাই ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কৃত্রিম জন্মদিন পালন করে। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাই এই আদর্শের অনুসারী। আর এদের ‘হৃদয়ের অভ্যাস’ হচ্ছে সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার ধ্বংস সাধন করা। আর এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুসারী দেশরতœ শেখ হাসিনা সরকারের অনুসৃত আদর্শ হচ্ছে সব ধর্মাবলম্বী মানুষের মিলিত রক্তস্রোতের ফলে জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারীদের বিজয়ই আমরা আশা করি।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়