শিক্ষার্থী নির্যাতন : উইলস লিটল স্কুলের অধ্যক্ষসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে সমন জারি

আগের সংবাদ

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবে আ.লীগ

পরের সংবাদ

ইউরোপের জীবনযাপনের সঙ্গে তুলনা না করি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী দাবি করে বলেছেন, বাংলাদেশের ৪ কোটি মানুষের জীবনযাপনের মান ইউরোপের মানুষের মতো। তিনি বলেন, দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৪ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের মানুষের সমান। অর্থাৎ এই ৪ কোটি মানুষ দাম দিয়ে ভালো পণ্য কিনতে পারে। ১৭ অক্টোবর ১৮তম জাতীয় ফার্নিচার মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। আবার এর দুদিন পরই অর্থাৎ ১৯ অক্টোবর তার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে জাতীয় চা দিবস ২০২২-এর এক প্রেস ব্রিফিং সভায় তিনি বলেন, দেশের সাড়ে ৪ কোটি থেকে ৫ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপ দেশগুলোর মতো। এমন সংবাদ জাতীয় দৈনিকের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। অল্প দিনের ব্যবধানে ইউরোপের দেশগুলোর মানুষের মতো ক্রয়ক্ষমতা ৫০ লাখ বৃদ্ধি পায় কী করে? মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে যে, আদতে এ বিষয়ে কোনো জরিপ ও পরিসংখ্যান আছে কিনা, নাকি অনুমানে তিনি কথাটা বলছেন, বলেছেন। কথাটা অনুমানে বললেও এর সত্যতা রয়েছে। যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে একটা শ্রেণির মানুষের ‘আলট্রা ওয়েলদি’ বা অতি ধনী হওয়ার ঘটনা আজ আর কারোর অজানা নয়। তাদের জীবনযাপন প্রণালি প্রাচুর্যে ঐশ্বর্যে মোড়ানো। রাতারাতি তারা লাগামহীন ধনসম্পদের মালিক হয়ে যায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক মন্দা অবস্থা এদের স্পর্শ করতে পারে না। এদের অভিজাত জীবনযাপনে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী এমন এক সময়ে এমন একটি সত্য বক্তব্য দিলেন যখন দেশের নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে অনেক দিন ধরে এই বাজার। স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। প্রতিদিন হিমশিম খাচ্ছে তারা বাজারে গিয়ে। ফলে তাদের ভেতর বাজার বিমুখতা বাড়ছে। তারা টাকা দিয়ে ভালো বা উন্নত জিনিস ক্রয় করতে পারে না। এমন অনেক পরিবার রয়েছে যারা স্রেফ ডাল, ভাত খেয়েই জীবনযাপন করছে। বহুদিন আমিষ খাওয়া হয়নি তাদের, ভালো শাকসবজির স্বাদ নেয়া হয়নি, জরিপ করলে এমন পরিবারের তালিকা বড় হবে বৈকি। আবার যেসব পরিবারে শিক্ষার্থী সন্তান রয়েছে, অসুস্থ পারিবারিক সদস্য রয়েছে, সেসব পরিবারের অবস্থা আরো শোচনীয়। নিত্যপণ্যের বাজার যেমন ধরাছোঁয়ার বাইরে, তেমন সাধ্যের বাইরে থাকছে শিক্ষাব্যবস্থা ও চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির সব ব্যবস্থা। বাধ্য হয়ে পাবলিক বা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করা ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করাই অন্যতম উপায় হিসেবে তারা মনে করে থাকে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা এবং বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর বিষয়টি রীতিমতো কষ্টসাধ্য ও কল্পনাতীত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি হাসপাতালে যে তারা উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকছে, তাও কিন্তু নয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিয়মিত উপস্থিতি যেমন নেই, তেমন নেই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির উপযুক্ত ও সঠিক ব্যবহার এবং টেকনিশিয়ান। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে যে শ্রেণির কথা বলা হয়েছে, তারা কিন্তু চিকিৎসাসেবা পেতে বিদেশ পাড়ি দেয়। কারণ বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের সামর্থ্য তাদের হয়েছে। কেনইবা তারা দেশে চিকিৎসাসেবা নেবে।
১৭ কোটি মানুষের ভেতর ৪ কোটি বা ৫ কোটি মানুষের সামর্থ্য, ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের মানুষের মতো, এর মধ্যে অর্জনটা কী তা যদি মন্ত্রী বিস্তারিত বলতেন, তাহলে ভালো হতো বৈকি। আর এতে গর্ব অনুভব করারইবা কী আছে? যদি বাজার ব্যবস্থাপনা ১৭ কোটি মানুষের আয়ত্তে ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভব হতো, তাহলেই না বিশাল অর্জন হতো, তাই না? বাংলাদেশের ৪/৫ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপ দেশগুলোর মানুষের মতো হওয়ার চেয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি ছিল বৈকি। তার বক্তব্যে মনে হয়েছে, এই ৪/৫ কোটি মানুষকেই সম্ভবত তারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সেবাগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। দিয়েছে রাষ্ট্রের বড় বড় সুবিধা। তাই কী? মধ্যবিত্ত মধ্যবয়স্ক একজন ব্যক্তি প্রশ্ন করছিল, টাকা দিয়ে ভালো জিনিস কিনতে পারে না, এটা কী তার অপরাধ? অযোগ্যতা বা অক্ষমতা? কী বলবে সংশ্লিষ্টরা। বলার কিইবা আছে কিংবা থাকে। আজ যদি বাণিজ্যমন্ত্রীর বলার সুযোগ থাকত যে, দেশের ১৫ কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ক্ষয়ক্ষমতা বেড়েছে। তারা চাইলেই টাকা দিয়ে ভালো জিনিস কিনতে পারে। বাকি ২ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার উপরে তোলার জন্য এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বাজার রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে, তাহলে সাধারণ জনগণের ভেতর স্বস্তির পথটা খুলে যেত।
আমার জানা নেই যে, বর্তমান বাজার অবস্থায় এই মানুষগুলো কী খেয়ে বেঁচে আছে, তার কোনো পরিসংখ্যান ও পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন মন্ত্রী বা তার মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে কিনা, যেমন তার কাছে তথ্য আছে ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপ দেশগুলোর মানুষের মতো হয়েছে। আর এটা বলাবাহুল্য যে, জনগণ জানতে ইচ্ছুক এই ৪ থেকে-৫ কোটি মানুষ কারা? যদি জনগণকেই উত্তর খুঁজে নিতে বলা হয় তাহলে এই তালিকায়- রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের লোকজনের নামই উঠে আসবে। বাদ যাওয়া লোকের সংখ্যা কমই হবে।
যা হোক, আর কিছুদিন পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে যারা ভোট দেয়ার অধিকার অর্জন করেছে, তারা তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেবে এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম ও রীতি। জনগণের রায়ই এখানে মুখ্য, যে রায়টা তারা তাদের স্বস্তি, শান্তি, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তার মানদণ্ডের ভিত্তিতে দিয়ে থাকে। এখানে দলের গায়ের জোর কিংবা অনিয়ম কোনো কাজে আসবে না, যদি না প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বরাবরই এই চর্চা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে কখনো কেউ থাকতে পেরেছে বলে অনেকেই তা মনে করে না। এখন বিএনপি যে গণতন্ত্রের ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমেছে, মাঠ উত্তপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাদের শাসনামলে কিন্তু সেই গণতন্ত্র দেখা যায়নি। জনগণকে ধোঁকা দেয়া ও বোকা বানানোর অপচেষ্টা প্রায় সব রাজনৈতিক দলের একটা রুটিনমাফিক কাজ। আর এই ধোঁকা দেয়া ও বোকা বানানোর খেলা চলে নির্বাচন প্রাক্কালে এবং তা বিভিন্ন প্রতিশ্রæতির মাধ্যমে। বিরোধী দলগুলো এখন যে কথাবার্তা বলছে তা পুরনো কথা। তারা তাদের শাসনামলে কাজের কোনো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা দিতে পারেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারেরও ব্যর্থতা আছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন শতভাগ হলেও সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো, বিশেষ করে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি শতভাগ পূরণ হয়নি। তার দৃষ্টান্ত, বর্তমান নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবার আড়ালে বিশাল ব্যবসা পরিচালনা সাধারণ জনগণকে কঠিন বাস্তবতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই দুটি বিষয়ে সাধারণ জনগণ যে কতটা অসহায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যতদূর মনে পড়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ক্রেতাদের অনুরোধ করে বলেছেন, বাজারের এই নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্য যেন ব্যালট পেপারে না পড়ে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মানুষের এই অসহায় অবস্থা তিনিও বুঝেন, উপলব্ধি করেন। তারও সম্ভবত আশঙ্কা রয়েছে জনগণের বর্তমান চিন্তা, চেতনা নিয়ে। একজন সচেতন মানুষেরই তা থাকার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তিনি বলছেন, দেশের ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষ ইউরোপের মানুষের মতো সামর্থ্যবান হয়ে উঠেছে, টাকা দিয়ে তারা ভালো জিনিস কিনতে পারে, তখন কিন্তু বাকি ১৩ থেকে ১২ কোটি মানুষ মনের দুঃখে, অমর্যাদার সাগরে তলিয়ে যায়। তারা ভেবে নেয়, বছরের পর বছর তারা কেবল বঞ্চনার ভেতরই থেকেছে, যা তারা বুঝতে পারেনি। যা হোক, এই ১৩ থেকে ১২ কোটি মানুষের মনের প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা বোঝার, জানার কোনো কৌশল বা উপায় সংশ্লিষ্টদের আছে কিনা। থাকলে অন্তত কোনো কথার কী মানে দাঁড়ায়, কী প্রভাব ফেলে জনগণের মনে, কিংবা সংশয়ের জন্ম দেয় তা বোঝার একটা সুযোগ হতো কিংবা থাকত। ফলে পরে কী ধরনের কথা বলতে হবে বা বলা যায়, কোন কথাটা ঝুঁকি কমায়, কমাবে তা বুঝে সংশ্লিষ্টরা কথা বলতে পারেন।
পরিশেষে বলব, নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন কথা সবারই বলা উচিত, যা জনগণকে বিভ্রান্ত না করে, জনগণকে সংশয়ে না ঠেলে দেয়। কারণ জনগণই সব ক্ষমতার উৎস।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়