আইজিপি : দুর্গোৎসব ঘিরে এখন পর্যন্ত কোনো শঙ্কা নেই

আগের সংবাদ

সতর্ক সরকার, প্রস্তুত দল : সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা আ.লীগের, প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ > ডেডলাইন ২৮ অক্টোবর

পরের সংবাদ

সংখ্যায় লঘু-গুরুতে সম্প্রীতি-সম্পত্তি

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শারদীয় দুর্গাপূজা চলছে ৩২ হাজার ৪০৮ মণ্ডপে, যা গত বছর ছিল ৩২ হাজার ১৬৮টি। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ও কিছু আকথা-কুকথা ছাড়া এবার এখন পর্যন্ত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সাদা চোখেই স্পষ্ট। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংখ্যালঘু দরদি ভূমিকাও দৃশ্যমান। তার মানে দেশে খুব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান। মণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেদম পরিশ্রমে পূজা শেষ করতে পারাই সম্প্রীতি মাপার মানদণ্ড? আর কোনো বিষয়-আসয় থাকতে নেই?
কেবল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নয়, সার্বিক জননিরাপত্তার সীমানা পুলিশ পাহারা ও তৎপরতায় সীমিত করার একটি মানসিকতা রয়েছে। এর মাঝে কিছু ঘটে গেলে ‘দুর্বৃত্তদের’ দায়ী করে ঘটনার ইতি টানার প্রবণতাও চলমান। আরো ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত যেন এটি কোনো বিষয় নয়। ‘কোথাও কিছু ঘটেনি, অতএব দেশে সম্প্রীতি বজায় রয়েছে’ মর্মে বাণী-বচন। আর পূজা বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আগে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পরামর্শ। কী কী করা যাবে না, সেই নির্দেশনার তালিকাও থাকে বেশ দীর্ঘ। ব্যত্যয় হয়নি এবারও। কেন পুলিশি নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়? থাকতে হয় উদ্বেগে? কেন বলতে হয়, ব্যাপক নিরাপত্তায় পূজা সুসম্পন্ন? বা কোনো অঘটন ছাড়াই কড়া পাহারায় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত? এগুলো কোনো ধর্ম বা কারো জন্য সম্মানের? সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু যেই হোক, কেন বিভিন্ন ধরনের শর্ত যোগ করা? পূজামণ্ডপে কী কী নেয়া যাবে বা ঈদ জামাতে কী কী নেয়া যাবে না- মর্মে আহ্বান বা হুকুম আরোপ?
প্রশ্নগুলোর বিহিত বা হিল্লা না করে সংখ্যা দিয়ে লঘু-গুরু নির্ণয়ের কাজটি চলে আসছে। এ বাতিক থেকে নিস্তারের লক্ষণও নেই। তাগিদও জোরালো নয়। অবিরাম চর্চায় এটি নিয়ম-নিয়তির মতো হয়ে গেছে। যে কারণে স্বাধীনতার একান্ন-বায়ান্ন বছরেও শুনতে হয় সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু শব্দযুগল। সামনে নির্বাচন। জাতীয়-স্থানীয় উভয় নির্বাচনেই এ নিয়ে হরদম রাজনীতি। হঠাৎ লঘু-গুরু প্রেম বা প্রেম রিমেকের মহড়া। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির ফল ভালো হয় না। অন্তত বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশে তা বারবার প্রমাণিত। এরপরও রাজনীতির কাণ্ডারিরা দমেন না। এবার দেবী দুর্গার আগমন ও গমন হবে ‘ঘোটকী’। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবীর এ ধরনের আগমন ও গমনকে চরম অশুভ ভাবে। শঙ্কা করে প্রকৃতি বা মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগের। তাদের এমন শঙ্কা অন্যদেরও বিশ্বাস করতে হবে- ব্যাপারটি এমন নয়। কিন্তু একটা ভয় যে তাড়না দেয়, তা আড়ালের চেষ্টা চলে। এ ধরনের বাস্তবতা অস্বীকার করা প্রকারান্তরে সমস্যাকে জিইয়ে রাখা। প্রয়োজন ও সময়দৃষ্টে আবার টোকা দেয়ার চর্চাও কম নয়। তাতে কি কারো মুখ একদম আটকে রাখা যায়? পূজা উদযাপন পরিষদ নেতাদের মুখ কি আটকানো গেছে? পূজার আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় ছোট ছোট কিছু কথা বলেছেন তারা। তাদের ছোট কথাগুলোর মাঝে বড় বড় কিছু টোকা ও টিকা রয়েছে। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যাতে কোনো হামলা না হয়; সে জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন, কিছু মানুষ চায় না দেশে হিন্দুরা থাকুক। আওয়ামী লীগেও এমন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
কেন উচ্চারিত হয় এ ধরনের কথা? আবার শুনেও না শোনার ভান ধরতে হয়? রাজনীতির পণ্য বানাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কব্জা করে রাখার একটি চর্চা বহুদিনের। আবার তারা তাদের পছন্দের দলের হাতে নিগৃহীত হয়ে কাঁতরালে তৃপ্তি পাওয়ার মহলও আছে। পুরোটাই রাজনৈতিক ব্যাপার। ক’দিন আগে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কী দেবেন-কী নেবেন এবার আগেই ফয়সালা করতে হবে। আরেক বক্তব্যে বলেছেন, সরকার চাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, না চাইলে হয় না। এ ধরনের কথার পূর্বাপরে রাজনীতির অনেক রহস্য। তথ্য ও উপাদানও কম নয়। সচরাচর নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির মাত্রা বাড়ে বাংলাদেশ এবং ভারতে। এতে কেউ লাভবান, কেউ লোকসানের শিকার হন। হিন্দু বনাম মুসলমানের স্নায়ুবিরোধ বাড়িয়ে মানবতা, সামাজিক স্থিতিশীলতার কত সর্বনাশ করা হচ্ছে, ধর্মের কত অমর্যাদা করা হচ্ছে- তা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে সময় পার করে দেয়া হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে সেই ঢোলে আবার বাড়ি পড়ছে। সম্প্রীতির তবলায় সম্পত্তির তালো থাকে। বিষয়টা ওপেন সিক্রেট। সম্প্রীতি আর সম্পত্তি শুনতে কাছাকাছি। অর্থও এক করে ফেলা হচ্ছে।
‘সংখ্যালঘুরা মার খেলে আরো খাক, খেতে থাকুক, তারা তো ওদিকেরই লোক’- এমনটি ভেবে বিকৃত স্বস্তি বোধকারীদের মতিগতিও স্পষ্ট। ভোটের আগে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন কাটাতে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা বেশ বেগবান। মেয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এসব সংগঠনের নেতাদের একটু যতœআত্তি করা হচ্ছে। পুরনো প্রতিশ্রæতি, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের অঙ্গীকার তো আছেই। আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রæতি ছিল। ২০১৮ সালে সেই নির্বাচনে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রধান প্রতিশ্রæতিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে পিঠ চুলকানো কথায় ঠিকই তাদের কাছে টানা হয় অনায়াসে। যে কোনো ধর্মাবলম্বীদের মাথা গুনে লঘু-গুরু ঠিক করার এই অঙ্কবাজি একবার দুবার নয়, বারবার। এবার ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু’ রেখা টানার পুরনো খেলাটা বেশি আগে শুরু হয়ে গেছে। তাই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংখ্যালঘুদের এ ধরনের প্রশ্নের তীর ছোড়া আচানক নয়। আকস্মিকও নয়। এর নেপথ্য নানা ঘটনা ও বেদনায় ঠাঁসা। রাজনীতি বা ভোটের অঙ্ক মেলানোর চিকন বুদ্ধির শিকার সংখ্যাগুরু-লঘু উভয়ই। বছর কয়েক ধরে হেফাজতসহ দক্ষিণপন্থি বা ইসলামি নামধারী সংগঠনগুলোও এর শিকার। সংখ্যাগুরু বিবেচনায় তাদের হিম্মতও বেশি।
প্রতিবেশী ভারতে ক্ষমতাসীন দলের কিছু এজেন্ডার জেরে মনিপুর-আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সহিংসতা চলমান। এ নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে রয়েছে বিজেপি-কংগ্রেস পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও নানা তিক্ত কথা। এর গোটা রসদই লুকানো ক্ষমতার রাজনীতির পেটে। এ নিয়ে সাতচল্লিশে দেশভাগের মর্মন্তুদ বেদনা নিয়ে লেখা উর্দুভাষী ঔপন্যাসিক কৃষণ চন্দরের দাঙ্গার গল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’র ভূমিকায় উর্দু কবি আলি সরদার জাফরির লেখা বড় প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিকও। জাফরির লেখার কয়েকটি লাইন এমন- ‘ভারত ও পাকিস্তানে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আগুনের লেলিহান শিখায় মানুষ, ঘরবাড়ি আর পাঠাগারের পাশাপাশি আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, সভ্যতা এবং কৃষ্টি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে এর তীব্রতা কিছুটা কমলেও এখনো সম্পূর্ণ কমেনি। ছাইয়ের নিচে আগুন এখনো চাপা পড়ে আছে, যা একটু ফুঁ দিলেই আবার জ্বলে উঠতে পারে। এই ছাইয়ে বাতাস দেয়ার লোকেরও অভাব নেই।’
‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’-এ ভারত-পাকিস্তানের কথা এসেছে। তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। আজকের প্রেক্ষাপটে যা ভারত-বাংলাদেশ। দেশ দুটিতে ধর্মীয় রাজনীতির রূপ-বৈশিষ্ট্য প্রায় কাছাকাছি। যার যার সুবিধা মতো সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দলকে কাজে লাগানোর নোংরামি সাতচল্লিশের চেয়ে এখন বরং আরো বেশি। কেবল ধরন পাল্টেছে মাত্র। কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লা বা রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা জায়গায় কুরআন পোড়ানো, মন্দিরে হামলা ইত্যাদি ঘটনা রাজনীতির ফায়দা উশুলে সময়োপযোগী এক কদাকার স্মার্টনেস। ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেলে কয়েক দিন হম্বিতম্বি, এরপর সব স্বাভাবিক। হোতাদের কিছু হয় না। সাধারণ মানুষ ভুলেও যায়। দগদগে ঘায়ের মতো ভোগে শুধু আক্রান্তরা। এগুলো মোটেই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর চশমা দিয়ে দেখার বিষয় নয়। তা চলতে থাকলে লঘু-গুরুসহ সবার নিরাপত্তা পুলিশ পাহারা বা নিরাপত্তার ফেরেই ঘুরবে। পুলিশি নিরাপত্তার চাকায় জড়িয়ে থাকবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি-সম্পত্তিসহ আরো অনেক কিছু। ধর্ম বা ধর্মীয় আয়োজন পুলিশ পাহারা বা রাজনৈতিক দলের দরদি তৎপরতায় ঘুরলে যা হচ্ছে তা হতেই থাকবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান-আনুষ্ঠানিকতা বা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বিষয় নয়। এটি সব সময়ের বিষয়। সাম্প্রদায়িকতা তৈরি এবং ছড়ানোর ফ্যাক্টরিগুলোতে হাত না দিয়ে সম্প্রীতির আওয়াজ কেবল নিরর্থক নয়, নিষ্ঠুর তামাশাও। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের পার্থক্য ভুলে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও তা সমাদৃত। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে একটি মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। সংবিধানে আরো বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মের চর্চায় সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার নিশ্চিত করবে। এরপরও ভাগ-বিভাজন তৈরি কোন উদ্দেশ্যে, কাদের স্বার্থে? তা বোঝা মোটেই দুর্বোধ্য নয়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়