নার্ভাস নাইনটিতে সবজির দাম

আগের সংবাদ

তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় এনে দেশকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে

পরের সংবাদ

ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান কীভাবে হবে

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হামাস কেমন করে ইসরায়েলের বেষ্টনী অতিক্রম করে এত বড় হামলা করতে সমর্থ হলো- সেই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। অথচ তার আগে এই প্রশ্ন আসা উচিত, বৈশ্বিক মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের এই যুগে ইসরায়েল কেমন করে ফিলিস্তিনকে অবরুদ্ধ করে মাথা উঁচু করে চলছে। আমরা সবাই জানি, উপনিবেশিক শাসনের যুগ শেষ হয়েছে যখন ইউরোপীয় উপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিসমাপ্তি হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব সেই আমলের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্বিক শাসন প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই করছে। ঠিক এই সময়ে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জীবনপণ লড়াই করতে হচ্ছে নিজেদের মাতৃভূমিতেই।
ফিলিস্তিন দখল আর ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা হিসাব করলে দেখা যায়, পৃথিবীর কোনো দেশকে এমন নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো দেশ নেই, যে দেশে বহিরাগতরা জোর করে কোনো দেশ দখল করে সেই দেশ থেকে স্থানীয় জনগণকে শরণার্থী বানিয়েছে। যারা দখল করেছে, তাদের বলা হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী’। অথচ অত্যাচারিত-নিপীড়িত স্থানীয় জনগণ যখন প্রতিরোধ করছেন পাথর আর রকেট দিয়ে, তখন মার্কিন ও ইউরোপীয় দেশের শাসকরা বলছে ‘ইসরায়েলের হামলা করার অধিকার আছে’, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তার অধিকার আছে’। এ থেকেই বোঝা যায়, পুরো বিশ্বের ‘মানবাধিকার’ আর ‘স্বাধীনতা’ সাম্রাজ্যবাদী শাসকবর্গের রাজনৈতিক নীতির অধীন। ইউক্রেন যখন রাশিয়া দ্বারা আক্রান্ত, তখন ইউক্রেনবাসীকে ‘স্বাধীনতাকামী’ বলে আখ্যায়িত করেছে আমেরিকা ও ইউরোপ। তারাই ইউক্রেনের ‘স্বাধীনতার’ জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্র সরঞ্জাম ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে; আর বলছে, তাদের লড়াই ‘মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ ১৯৪৮ সালে বহিরাগত ইসরায়েলিরা ইংল্যান্ডের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়, আর ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিম তীর ও গাজার ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ইসরায়েলি জেনোসাইডের ফলে ১৯৪৮ সালের পরেই ৭ লাখের অধিক ফিলিস্তিনি গৃহহীন হন। সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানেই আছে ৩৫টি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির, যেখানে প্রায় ৩০ লাখের অধিক শরণার্থী নিবন্ধিত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজেদের মাতৃভূমি গাজা ও পশ্চিম তীরে রয়েছে ২৭টি শরণার্থী শিবির; যেখানে ১৮ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী নিবন্ধিত হয়েছেন। এ থেকে কি বোঝা যায় না, কেমন করে ফিলিস্তিনিরা কয়েকটি আরব দেশ ছাড়াও নিজ ভূখণ্ডে শরণার্থী হয়ে বসবাস করছে। এর মানে তাদের মাতৃভূমি বলতে কিছু নেই। উপরন্তু প্রতি বছর পশ্চিম তীরে ইসরায়েল তাদের আবাসন সম্প্রসারণের কাজ করে চলছে পুরোপুরি অন্যায়ভাবে। ফিলিস্তিনি কোনো নাগরিক বাধা দিলেই তাকে হত্যা করা হয়, জেলে নেয়া হয়, জেলে অত্যাচার আর নির্যাতন করা হয়। ‘নাদিল আসির’ নামক ফিলিস্তিনি সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, ইসরায়েল ১৯৬৭ সাল থেকে ১৬ হাজার ফিলিস্তিনি নারীকে গ্রেপ্তার করে এবং কারাগারের অভ্যন্তরে তাদের অমানসিক নির্যাতন, এমনকি যৌন নিপীড়ন করা হয়। এ থেকে কি স্পষ্ট হয় না, ফিলিস্তিনিরা কেন ইসরায়েলের ওপর ক্ষুব্ধ! বিষয়টি শুধু ক্ষুব্ধ হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ইসরায়েলের হাতে যে ফিলিস্তিনিরা নিরাপদ নয়, তা ফিলিস্তিনিরা ভালো করেই জানে।
ইসরায়েলি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি এখন বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষার মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ৭৫ বছর কেটে গেল, ফিলিস্তিনের মুক্তি নিয়ে না ভাবছে ‘মানবাধিকারের’ স্লেøাগানধারী পাশ্চাত্য, না ভাবছে আরব দেশের শাসকবর্গ। আরব দেশগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চেপে বসা রাজতান্ত্রিক শাসনের মূল্যবোধ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সবার কাছে। কেননা রাজতান্ত্রিক শাসনে ‘ইসলাম’ আর ‘জাতীয়তাবাদ’ কে ব্যবহার করা হচ্ছে আরবের জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। ফিলিস্তিনিরা সেই ধোঁকা বুঝতে পেরেছে। অন্যদিকে, সারা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘প্রতিভূ’ হিসেবে সমাদৃত ইউরোপীয় দেশের শাসকবর্গ ও মার্কিন সরকার ইসরায়েলের সব অপকর্ম, গণহত্যা, জবরদখলের সাক্ষী হয়ে ইসরায়েলের শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর।
ইসরায়েলের দখলদারিত্ব আর অত্যাচারী কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতিকে পাশ্চাত্যের শাসকরা ইসরায়েলের ‘অধিকার’ মনে করে। এমনকি জাতিসংঘের সব নিয়মনীতিকে অগ্রাহ্য করাকে ইসরায়েলের জন্য বৈধ মনে করে ইসরায়েল সমর্থক ‘গণতন্ত্রমনা’ শাসকরা। চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল গাজার অধিবাসীদের জন্য পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়। ইসরায়েলের অবরোধে গাজায় কোনো খাবারসামগ্রী প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও এসব জাতিসংঘ প্রণীত যুদ্ধনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন, তবুও মানবাধিকারের কথা এখানে প্রযোজ্য নয়- এমন মনোভাব পোষণ করে চলছে পাশ্চাত্যের শাসকবর্গ।
৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি হানাদার কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত, দেশান্তরিত ও নিজ দেশে পরবাসী হয়ে বাস করছে; এমনকি গণহত্যার শিকার। তবুও পাশ্চাত্য নির্বিকার; রাষ্ট্রযন্ত্র ইসরায়েলের প্রকাশ্য সমর্থক। পাশ্চাত্যের ‘আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব’ এখানে অচল হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্যে ‘গণতান্ত্রিক’ মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ হানাদার বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করছে। শুধু তাই নয়, মার্কিন ‘গণতান্ত্রিক’ শাসকরা ইসরায়েলের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতাসীন হওয়ার কল্পনাও করতে পারছে না। এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য জাতিসংঘ অথবা পাশ্চাত্যের ‘লিবারিলজম’ নীতি ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে আরব-শাসকদের মার্কিন শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব ফিলিস্তিনিদের হতাশ করেছে। আরবের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এতটাই বিলাসনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ছাড়া অন্য উপায় পাচ্ছে না।
এদিকে বৈশ্বিক রাজনীতির দ্বিমেরুকরণ ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরো গতিশীল করেছে। মার্কিন-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী জোটের বিপরীতে রাশিয়া, চীন, ইরান শক্ত প্রতিপক্ষরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনের মতো আরব দেশগুলো সৌদি ও মার্কিন প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সম্পর্কের এই মানচিত্র দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করেছে ইরান। এই সম্পর্ক ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলনকে আরো গতিশীল করেছে। আরবের দেশগুলোতে জনগণের মধ্যে মার্কিনবিরোধী ও আরব রাজতন্ত্রবিরোধী চেতনা বিকশিত হলে ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি আন্দোলন আরো তীব্রতর হবে।
আগামী প্রজন্ম দেখতে পাবে, তথাকথিত ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ আর ‘নিউলিবারালিজম’ এর ধারণা অত্যাচারিত-নিপীড়িত জনগণের মুক্তি দিতে অক্ষম। মূলত স্বাধীনতা আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যে নৈতিক আন্দোলন দরকার- সেই আন্দোলনের মূল্যবোধ-মূল্য কখনো কখনো জীবনের মূল্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির নিগূড়তা এখানেই নিহিত।

ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়