নব্বইয়ের ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মনির মৃত্যু

আগের সংবাদ

সংলাপসহ পাঁচ দফা সুপারিশ : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশংসা মার্কিন পর্যবেক্ষক দলের

পরের সংবাদ

শাসক বদল নয়, ব্যবস্থার বদল চাই

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, জনমনে উদ্বেগ-শঙ্কা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিরোধী দল ও জোট এরই মধ্যে নির্বাচনকে উপলক্ষ করে আন্দোলনে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে আগামী নির্বাচন নিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তেমনটাই আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
ইতিহাসের নিশ্চয় পুনরাবৃত্তি ঘটে না। তাহলে গত নির্বাচনের মতো একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিশ্চয় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে এবার সম্ভব হবে না। গতবারের মতো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার সুযোগ হাতিয়ে একতরফা নির্বাচনের সুযোগ শাসক দল পাবে বলে মনে হয় না।
বর্তমান সরকারের আমলে সরকারবিরোধীদের রাস্তায় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি। বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার-মামলাসহ হরেক পন্থায় চাপের মুখে রাখার পরও দমানো সম্ভব হয়নি। বিরোধীরা একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। পাশাপাশি বিরোধীদের কর্মসূচি ঘোষণামাত্র সরকারি দলও নিজেদের ঘোষিত তথাকথিত শান্তির সমাবেশের বাতাবরণে মাঠ দখলের কর্মসূচি দিতে বিলম্ব করছে না। তাই জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রশ্নহীন ছিল না। তাই আওয়াজ উঠেছিল দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। সাংবিধানিকভাবে সেটা সম্পন্ন হওয়ার ফলে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের শাসনামলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করেছিল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করে। তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোট এর চরম বিরোধিতা করলেও নেপথ্যে ক্ষমতাসীন জোট-সরকার কর্ণপাত করেনি। ওই তামাশার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে কয়েকজন উপদেষ্টা পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারই এই ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছিল। জোট সরকারের হীন অপকীর্তির সুযোগে বিনা রক্তপাতে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব ঘটে। ফখরুদ্দিন-মইন উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকার ৩ মাসের বাধ্যবাধকতার সীমা অতিক্রম করে প্রায় ২ বছর দেশ শাসন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওই নির্বাচনে সব দল ও জোট অংশগ্রহণ করার ফলে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি। নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্ষমতাসীন হয় এবং সরকার গঠনের পর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংবিধানবহির্ভূত সব কার্যকলাপকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা হয়। ওই নির্বাচনের পর ১৪ দলীয় জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাকেই বাতিল করে দিয়েছে। এরপর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলো ক্রমাগত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন প্রহসনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে সরকার। বর্তমানে বিরোধীরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দলীয় সরকারের বিপরীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জোর দাবি জানিয়ে আসছে। অপরদিকে সরকার অনড় অবস্থানে রয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। অবস্থাদৃষ্টে এই টানাপড়েনের সমাপ্তি কোন পথে সমাধান হবে! সেটা নিয়েও জনমনে নানা কথা চাউর হচ্ছে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় যথাসময়ে নির্বাচন দিতেই হবে। এই নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ না নিলে সরকার গতবারের আদলে একতরফা নির্বাচন করতে পারবে? তেমনটি দুরাশা বলেই মনে হচ্ছে। পাশাপাশি জাতীয় পার্টিকে আবারো সরকার সমর্থক বিরোধী দলের আসনে বসানো যাবে! এবার কিন্তু তেমনটি সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। সরকারকে অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে বিরোধীরা বাধ্য করতে পারবে কিনা, নিকট ভবিষ্যৎই সেটা বলে দেবে। শুরুতে বলেছি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে না; হেরফের হয়েই থাকে। তাই আশা করা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন গতবারের ধারাবাহিক হবে না।
আমাদের দেশে নির্বাচন মাত্রই এক ধরনের উৎস ছিল বটে। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে উৎসবের বিপরীতে জনমনে নানা শঙ্কা-আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বাচন অবাধ-নিরপেক্ষ এবং জনরায় বাস্তবায়িত হবে কিনা- এ নিয়ে জনমনে যেমন শঙ্কা রয়েছে, তেমনি আশঙ্কা করছে বিরোধী জোটও। নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের প্রতি চরম অবিশ্বাস-শঙ্কার কথা নানা সমাবেশে বিরোধীপক্ষ বলে যাচ্ছে। যদি গত নির্বাচনের অনুরূপ ঘটনা ঘটে, তাহলে দেশে স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। শাসক দল শক্তি প্রয়োগে সর্বদাই যে সফল হবে, সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। ক্ষমতার বদৌলতে প্রহসনমূলক নির্বাচন দেশবাসী বারবার মেনে নেবে না। এবারে তেমন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
এবারের নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের কেবল তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ যেমন নির্বিকার, তেমনি নির্লিপ্ত। তাদের মধ্যে তেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। তারা মূলত শঙ্কা-আতঙ্কে ভুগছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভোটার হিসেবে ভোট দিতে পারবে কিনা, সেটাও নিশ্চিত নয়। জনগণের ভোট ব্যতিরেকেও যে নির্বাচন সুসম্পন্ন হয়, সে অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। কাজেই সঙ্গত কারণে দেশবাসীর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উচ্চবাচ্য, মাতামাতি দেখা যাচ্ছে না। আর এটা তো সত্য, নির্বাচনে কে জিতল, কে হারল তাতেও তাদের যায়-আসে না। নির্বাচনের জয়-পরাজয়ে তাদের ভাগ্যবদলের একটি দৃষ্টান্তও স্বাধীন দেশে দেখা যায়নি। শাসক বদলের নির্বাচনে তাদের ভাগ্যে কেবল শাসক ও শোষকেরই বদল ঘটেছে, অবস্থার বদল হয়নি। জীবন-জীবিকার অন্বেষণে তাদের নিত্যদিন কাটে চরম অনিশ্চয়তায়। দেশে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশবাসী চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সঙ্গত কারণেই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাতামাতি দেখা যাচ্ছে না। এটাও অসত্য নয়, ক্ষমতার দল-বদলের নির্বাচন তাদের আশাবাদী করতে পারছে না। ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে ভোট দেবে তাদের ভাগ্য বদলের আশায়। কিন্তু শাসক-শোষক বদলের নির্বাচন তো কখনোই তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তাদের দেয়া ভোট কেবল নির্ধারণ করবে তারা কোন দলের মাধ্যমে শাসিত হবে।
আমাদের বুর্জোয়া রাজনীতির কেন্দ্রে কেবলই ক্ষমতা পাওয়া। ক্ষমতার মোহে নীতি-নৈতিকতা বলে কার্যত কিছুই নেই। নীতি-আদর্শহীন রাজনীতির নগ্নতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বুর্জোয়া রাজনীতিকরা একটি কথা প্রায় বলে থাকেন ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’। কথাটি জোর প্রচারণা করা হয় রাজনীতিকদের নীতিহীনতাকে বৈধতার অভিপ্রায়ে। কথাটি যে নিছক প্রতারণা ভিন্ন অন্য কিছু নয়, সেটা পরিষ্কার। ক্ষমতা পেতে তাদের স্থায়ী শত্রæ-মিত্র নেই। নেই নীতি-আদর্শের বালাই। বাংলা ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধ-মৌলবাদী, উগ্র-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এক মোহনায় মিলে যায়, ক্ষমতা লাভের টানে।
বুর্জোয়া রাজনীতিকদের স্বরূপ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়ে থাকে। ডিগবাজির রাজনীতিকদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে লিখে শেষ করা যাবে না। তাদের মূল ও একমাত্র লক্ষ্যই ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতার পাশে থাকা, জাগতিক পার্থিব লোভ-লালসার অভিপ্রায়ে। আমাদের প্রতিটি শাসকই জনবিচ্ছিন্ন তো বটেই পাশাপাশি জনবিরুদ্ধও। জনগণের সমর্থন লাভে তাদের ব্যবহার করা হয় তাদের ক্ষমতা লাভের স্বার্থে। ক্ষমতা পাওয়া মাত্র জনবিচ্ছিন্ন হতে মোটেও বিলম্ব করে না। এই ক্ষমতা-বদলের রাজনীতি ও নির্বাচন যতদিন ক্রিয়াশীল থাকবে ততদিন সমষ্টিগত মানুষের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটবে না। এদের বিপরীতে বিকল্পের কথা বলা হয়। কিন্তু সেই বিকল্প যেমনি দুর্বল তেমনি অনৈক্যে বাধা পড়ে আছে। স্বীকার করতে হবেই দেশপ্রেমিক ওই বিকল্প শক্তির ব্যাপক উত্থান ও বিকাশের ওপরই জনগণের ভাগ্যের দিনবদল নির্ভর করছে। পাশাপাশি মানতেই হবে শাসক-বদলের নির্বাচনে জনগণের ভাগ্য-বদলের উপায় বা সম্ভাবনা কোনোটিই নেই। মূলে হচ্ছে ব্যবস্থার বদল। ব্যবস্থার বদল ব্যতীত বাংলাদেশের সমষ্টিগত মানুষের ভাগ্যের বদল ঘটবে না। এটাই সারকথা।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়