ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ১৩ জনের মৃত্যু আক্রান্ত ২৪২৫

আগের সংবাদ

আওয়ামী লীগের নতুন কর্মসূচি : রাজপথ পাহারা দেয়া, দল চাঙ্গা রাখার লক্ষ্য

পরের সংবাদ

আস্থার নির্বাচন : নির্বাচনে আস্থা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ১৩, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আস্থায় ভর করে যে নির্বাচন সে নির্বাচনে আস্থা রেখেই গণতন্ত্র এগিয়ে যায়। চলমান সেই গণতন্ত্রে ভোটাধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত। নাগরিক সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ কারো কাম্য নয়। বাঙালি তাদের নাগরিক অধিকারে কারো নিয়ন্ত্রণ কখনো মেনে নেয়নি। হোক সে ভাষার অধিকার অথবা ভোটের, বাধা এলেই প্রতিবাদে ঝড় উঠে। বেসিক ডেমোক্রেসি নামে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বাঙালি মেনে নেয়নি। তারা বেরিয়ে আসে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি থেকে। যার জন্য চরম মূল্য দিতেও পিছপা হয়নি এদেশের মানুষ। নিজেদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই বাঙালিকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র থেকে বরে করে আনে। বাঙালির সেই নৈতিক পরিচয়ের ধারক ৭২-এর সংবিধান। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে শুধু এদেশ নয়, বিশ্ব রাজনীতিকে পাল্টে দেয়ার ধারণাকে বিশ্বের গণতন্ত্রমনা মানুষের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে আনে। সেই আদর্শের পথেই আমাদের রাজনীতির যাত্রা শুরু। এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শুরুও তখন থেকেই। যার পরিণতিতে ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে পাল্টে যায় দেশ এবং দেশের রাজনীতি। চালু হয় পাকিস্তানের ধারায় সামরিক নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি। যার বৈধকরণে নির্বাচন তখন থেকেই বিতর্কিত হয়ে উঠে। ’৯০-এর পর রাজনীতিতে পরিবর্তন এলেও নির্বাচনে তেমন পরিবর্তন আসেনি। নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসানে আগত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিজেই বিতর্কিত হওয়ায় উচ্চ আদালত তাকে অবৈধ ঘোষণা করে। সেটা পুনরায় ফিরিয়ে আনা সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতায় সরকারের পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া জনপ্রতিনিধিত্বহীন অনির্বাচিত সরকারের দুর্বলতা দেশের জন্য কত বড় বিপদ বয়ে আনতে পারে পরপর তিনটি নির্বাচনেই দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। অনির্বাচিত সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জার্মানিতে হিটলারের মতো দানবের আগমন ঘটে, বাংলাদেশে আসে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার। তাই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। যা হবে একটি স্থায়ী সমাধান।
প্রয়োজনে আমাদের মতো করে একটি স্থায়ী সমাধান আমাদেরই বের করতে হবে, কারো পরামর্শে নয়। সবার ভরসার স্থল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে এদেশের মানুষের কল্যাণে যার রাজনীতি। সেই আস্থাই আমাকে উৎসাহিত করে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যকরণে করণীয় নিয়ে লিখতে। নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের একক দায়িত্বে, সরকার সহায়ক মাত্র। কমিশনকে সহায়তা ছাড়া নির্বাচন-সংক্রান্ত সরকারের সব দায়িত্বই নির্বাচন কমিশনের। তাই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যকরণে কমিশনকেই তার ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সবার আস্থাই কমিশনের সক্ষমতা। সর্বোচ্চ যোগ্য যারা তারাই নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। রাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ নির্বাচনে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিতর্কিত করে। কখনো কখনো সরকার নিজেই কমিশনের বিতর্কের কারণ হয়ে উঠে, তথাপি কোনো সরকারই চায় না কমিশন বিতর্কিত হোক। অন্যদিকে বিরোধী দলের প্রত্যাশা কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা। অথচ নির্বাচনে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে বিরোধী দলই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাদের বিতর্কিত করে। কারণ সেখানে বিরোধী দলের দায়িত্ববোধের কোনো স্থান নেই। কমিশনের গ্রহণযোগ্যতায় সমস্যা সেখানেই। অথচ উভয় পক্ষের প্রত্যাশার মাঝেই আছে কমিশন নিয়ে বিতর্কের অবসান। সেই প্রত্যাশা পূরণে খুঁজে পেতে তেমন একটা কমিশন আমাদেরই গঠন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োজিত কমিশনের ওপর বিরোধী দল আস্থা রাখতে পারে না। কারণ দলমত নির্বিশেষে সবার সম্মতিতে এবং রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও শুধু দল থেকে পদত্যাগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংবিধানের আলোকে দায়সারা হয়। তাই এই আস্থাহীনতা। কমিশনের সদস্যদের নিয়োগে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া গেলে অথবা তাদের বাছাইয়ে বিরোধী দলকে দায়িত্ব প্রদানে নির্বাচন কমিশনে তাদের সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের বাছাইয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে বাছাই কমিটি গঠন করেন তাদের বাছাইয়ে সংসদে বিরোধী দলের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে সেই বাছাই কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য দশজন সদস্য বাছাই করে তাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে। সেখান থেকে একজন প্রধানসহ পাঁচজন কমিশনারকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। নির্বাচন কমিশন সদস্যদের বাছাইয়ে বাছাই কমিটি এবং কমিশন সদস্যদের নির্বাচনে তাদের যোগ্যতার পাশাপাশি প্রয়োজনে কিছু শর্তও প্রযোজ্য হতে পারে। যা তাদের গ্রহণযোগ্যতায় আস্থা আনয়নে সহায়ক হবে। কমিশনে আস্থা ফিরে এলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অনেকটাই কমে আসবে।
সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি ধারার রাজনীতি ’৭৫ পরবর্তী রাজনীতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। ফলে সব বিরোধী দলের আস্থায় গড়ে ওঠা সত্ত্বেও নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে সেই নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতায় তাদের আস্থা নাও থাকতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকারের অধিকতর সক্ষমতা বিরোধী দলের কাছে নির্বাচন কমিশনের অক্ষমতাকেই বড় করে তুলে ধরে। ফলে সেই দুর্বল কমিশনের আস্থায় ভর করে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশ নেয়ার সম্ভাবনা কম। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের অংশগ্রহণ বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে বিরোধী দলকে নির্বাচনের প্রতি অধিকতর আস্থাশীল করে তোলা সম্ভব হবে। অবশ্য দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রস্তাব বিরোধী দল আস্থায় নিতে পারেনি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদের স্বার্থেই বিরোধী দলকে আরো সচেতন হতে হবে।
সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত যেমন সুফল বয়ে আনে তেমনি একটি ভুল সিদ্ধান্ত রাজনীতিতে অনেক বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, বিএনপি মহাসচিবের এমন বোধোদয় আগামীতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএনপিকে সহায়তা করবে। সরকারের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলে সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তে তাদের মতামত প্রাধান্য পাবে। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলককরণে সরকারকে যেমন সচেষ্ট হতে হবে তেমনি বিরোধী দলকে মনে রাখতে হবে আমাদের রাজনীতিতে বা নির্বাচনে ২০০১ সালকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তাই আর নয় শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা। নিয়মের ব্যতিক্রম বা যে কোনো অনিয়মে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সবার স্বরূপ উন্মোচনে দায়িত্বে থাকবে গণমাধ্যম।
জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া অনির্বাচিত কারো হাতে দেশ মুহূর্তের জন্যও নিরাপদ নয়, যার প্রমাণ মিলে অনির্বাচিত সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে আগত ওয়ান ইলেভেন সরকারের আচরণে। তাই আমাদের সংবিধান জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া অনির্বাচিত কোনো সরকারে সমর্থন করে না। সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সংসদ ভেঙে দেয়া না হলেও নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’ বিবেচনায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্যদের সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের সব সক্ষমতা শূন্য বিবেচিত হবে। কিন্তু যেহেতু সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি তাই সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত শুধু জাতীয় যে কোনো বিপর্যয়ে সংসদ কার্যকর বিবেচিত হবে।
নিজেদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি কমিশনকে তার ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য আমাদের রাজনীতির জটিল সমীকরণে দেশের চলমান রাজনীতি সম্পর্কে কমিশনকে পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে। যা জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যকরণে কমিশনকে সহায়তা করবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাই কমিশনের যোগ্যতার মাপকাঠি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চলমান ধারাবাহিকতার সামান্য পরিবর্তন বা নতুন কোনো পদক্ষেপ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ভূমিকা রাখবে। নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে প্রতিটি কেন্দ্রে প্রত্যেক প্রার্থীর এজেন্ট নিয়োগ কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থীর এজেন্ট সংক্রান্ত সব তথ্য নির্বাচনের পূর্বেই গণমাধ্যমের সহায়তায় ভোটারদের অবহিতকরণে কমিশনের অনেক জটিলতা নিরসনে সহায়ক হবে। তাই প্রত্যেক প্রার্থীকে তাদের এজেন্টদের নাম নির্বাচনের অন্তত ১ মাস পূর্বেই আঞ্চলিক কমিশন অফিসে জমা দিতে হবে। নির্বাচনের দিন ভোট শুরুর পূর্বে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রার্থীর এজেন্ট সবাই মিলে খালি ব্যালট বাক্সসহ একটি গ্রুপ ছবি (মোবাইল ফোন ক্যামেরায়) তুলে রাখার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। সিসি ক্যামেরার আংশিক বিকল্প হিসেবে পরবর্তীতে যে কোনো জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। নিজেদের ক্ষমতা আর ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগই তাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে। সেখানে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। নিয়োগ যে প্রক্রিয়ায় হোক না কেন কমিশনকে কাজ করতে হবে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে সবার আস্থা অর্জনে। সে ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশনের প্রচেষ্টায় সরকারের যে কোনো রকম অসহযোগিতায় কমিশন এবং মন্ত্রিপরিষদে বিরোধী দলের সদস্যদের পদত্যাগের সুযোগ আছে।
দায়িত্ব পালনে অপারগতায় পদত্যাগ নৈতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও নির্ধারিত কাউকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে সেই পদত্যাগই অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। অনৈতিক সুবিধা যার জন্যই হোক দিন শেষে পদত্যাগকারীর পরিচয় হবে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ হিসেবেই। এ ছাড়া মন্দের ভালো এই বিবেচনায় পদত্যাগ ব্যর্থতা আড়ালে প্রয়াশ মাত্র। দুটি নির্বাচনের ফলাফল একই হওয়া সত্ত্বেও ’৯১-এর নির্বাচনে নিজ আদর্শের আলোয় যিনি দেশকে দেশের মানুষকে আলোকিত করে তোলেন, ২০০১-এর নির্বাচনের পর তার সেই আলোকিত জগৎ থেকে তিনি হারিয়ে যান। এ দেশের মানুষের দেশপ্রেম ’৭১-এ অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত। সেখানে বিশ্বাসঘাতকদের কোনো স্থান নেই। মীরজাফর আর মোশতাকদের মতোই তারা ঘৃণিত। এর জন্য কোনো প্রমাণ বা আদালতের রায় প্রয়োজন হয় না। মানুষ তাদের স্মরণে রাখে দুর্গা পদতলে অসুর রূপে।

মো. নাসিরুল আলম চৌধুরী : কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়