বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা : ড. বদিউল আলমের শ্যালক গ্রেপ্তার

আগের সংবাদ

নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এত উদ্বেগ কেন, প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

পরের সংবাদ

আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এবং বাঁশের কেল্লার আস্ফালন

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এই মুহূর্তে ‘বাংলাদেশের ৪০ লাখ সরকারি কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে’ এমন একটি খবরের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? আমরা মাথা খাঁটিয়ে তার একটি চিত্র দাঁড় করাতে পারি। যেমন- দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকা ৮ কলাম (ওদের সেটা ৬ কলাম) ব্যানার হেড লাইন করবে, ‘গণতন্ত্রের অভাবে দেউলিয়া হলো বাংলাদেশ’। বিরোধী দল বা জোটগুলো ৪০ মাইল দীর্ঘ মানববন্ধন করবে সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত। আর ক্ষতিগ্রস্ত ৪০ লাখ মানুষ বিমানবন্দরে গিয়ে শুয়ে থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যেন নামতে না পারে। আর এদের পানীয়, খাদ্য, বিছানা-তোশক, ওষুধ সরবরাহের জন্য শত শত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, মান্না-রব-নুরু-সাকীরা গভীর তৎপরতা অব্যাহত রাখবে। সে সঙ্গে সারা বাংলায় যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মাঠে নেমে যাবে আওয়ামী লীগ নিধনে।
এটা নিছক কল্পনা। বাস্তব আরো ভয়াবহ হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক শক্তি বা জোট এবং জনগণের একটি অংশ কায়মনোবাক্যে দেশের এমন পরিণতির জন্য প্রার্থনা করে। উক্ত পত্রিকার প্রতিদিনের শিরোনাম ও উপসম্পাদকীয় লেখা পাঠে তার শোভন একটি সংস্করণ লক্ষ করা যায়।
তবে শতসহস্র শত্রæর মুখে ছাই দিয়ে এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে না। ঘটছে খোদ মার্কিন মুল্লুকে, যারা সকাল-বিকাল বাংলাদেশকে তোপের মুখে রেখেছে। কিছুদিন আগেই প্রকাশ হওয়া সংবাদটি হলো- ‘যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারকে অর্থায়ন করার যে বিল আনা হয়েছিল, কট্টরপন্থি রিপাবলিকানরা তা বাতিল করেছে। ফলে এটা এখন নিশ্চিত যে ১ অক্টোবর থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর কার্যক্রম আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, যাকে বলে শাটডাউন। এতে জাতীয় পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ৪০ লাখ কেন্দ্রীয় কর্মীর বেতন-ভাতা পরিশোধ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আর্থিক খাতের নজরদারি থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার তহবিল। রয়টার্স জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর কার্যক্রম যাতে বন্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে তহবিল জোগানোর মেয়াদ ৩০ দিন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিল আনা হয়েছিল হাউসে। কিন্তু সেই বিল ২৩২-১৯৮ ভোটে পরাজিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন বলেছেন, সরকারি দপ্তরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও শিশুদের জন্য পরিচালিত কর্মসূচির গতি কমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে থমকে যেতে পারে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের গতিও।
এবারো শাটডাউন হলে তা হবে এক দশকের মধ্যে চতুর্থ শাটডাউন। মাত্র চার মাস আগে জাতীয় ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে দেশটির প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যেভাবে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিল, তখনো এই শাটডাউনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তখন তা এড়ানো গেলেও এর জেরে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমানে প্রভাব পড়েছে- ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশটির ভাবমূর্তি।’
বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ আমেরিকার যখন এই অবস্থা তখন দুই নম্বর অবস্থানে থাকা চীনের অবস্থা কী তা জানতে সামান্য কয়েকটি লাইন পড়তে হবে। ‘চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে ১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস এই দেশে। বিবিসি জানাচ্ছে, চীন বর্তমানে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন, যার মধ্যে আছে অর্থনীতির ধীরগতি, বেকারত্ব ও অস্থিতিশীল আবাসন বাজার।
বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত। তবে বহুজাতিক করপোরেশন, তাদের কর্মী ও চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগহীন মানুষও এর প্রভাব কিছুটা অনুভব করবে।
দেশকে নিয়ে নেতিবাচক খবরে অনেকের খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায়। এই আগ্রহের পেছনে কাজ করে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। তার চেয়ে আরেকটু স্পষ্ট করে বলি, শেখ হাসিনা বিরোধিতা। একটি উদাহরণ দিই, গত সোমবার দেশের পত্রিকাগুলোর অন্যতম শিরোনাম করেছে গত তিন মাসে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি নিয়ে। বেশির ভাগ পত্রিকার শিরোনাম অনেকটা এমন, ‘তিন মাসে রপ্তানি আয় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার, বেড়েছে তৈরি পোশাকেও’। আর সে পত্রিকা এ খবর ছেপেছে অর্থ-বাণিজ্য পাতায়, ‘পোশাক ছাড়া সব খাতে দুশ্চিন্তা’ শিরোনামে।
সেদিনের খবরটি ছিল এরকম, ‘চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তিন মাস রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৬৮৫ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে রপ্তানি আয় ছিল ১২ দশমিক ৪৯৭ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ৩ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১১ দশমিক ৬১৭ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আগের বছর একই সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১০ দশমিক ২৭৪ বিলিয়ন ডলার। জুলাই-আগস্ট দুই মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সে হিসাবে সেপ্টেম্বর মাসে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে।’ অবশ্য অন্যান্য পণ্যে রপ্তানি আয় কিছুটা কমেছে।
প্রায় এক যুগ ধরে বদলে যাওয়ার সেøাগান দেয়া পত্রিকাটি একটি ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, তা হলো- বাংলাদেশের সব সমস্যার মূল একটি অবাধ নির্বাচন না হওয়া। তাদের ভাষায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা থাকবে না। সে লক্ষ্যে তারা কিছু লেখক জড়ো করেছে, যাদের কাজ হচ্ছে প্রতিদিন ওই একটি কথাই বলে যাওয়া। তাদের কিছু নির্দিষ্ট ও রক্ষিত লেখক আছেন। এর বাইরে আর কারো লেখা সে পত্রিকায় ছাপা হয় না। তাদের মনমতো লেখক পাওয়া না গেলে ইনহাউস থেকে লেখক তুলে আনা হচ্ছে। সোহরাব হাসান, কামাল আহমেদ সাহেবরা লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এখন পত্রিকার সহসম্পাদকদের দিয়েও কলাম লেখানো হচ্ছে। তারাও সে পুরনো রেকর্ডটি বাজাচ্ছেন। সোমবার সে পত্রিকায় আসিফ নজরুলের একটি কলাম ছাপা হয়েছে। অবশ্য এ লেখায় নতুন কিছু নেই। পত্রিকার সম্পাদক যা বলতে চান সে কথাই ঘুরেফিরে বিভিন্ন কলামিস্টরা লিখে যাচ্ছেন। তাই যে কোনো একজনের লেখার উত্তর দিলে মোটামুটি সবাইকে দেয়া হয়ে যায়।
আসিফ নজরুল লিখেছেন, ‘আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সবচেয়ে জোরালো প্রেরণা ছিল অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা। আমাদের আদি (ও বর্তমানের) সংবিধান অনুসারে, প্রত্যেক নাগরিকের একটি ভোট এবং কোনো অজুহাতেই (যেমন সরকারবিরোধী বা পশ্চাৎপদ চিন্তার অধিকারী) এটি থেকে তাকে বঞ্চিত করা যায় না। অবাধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দল দেশ শাসন করবে, এই স্পষ্ট নিদর্শন আমাদের সংবিধান ও বিভিন্ন আইনে রয়েছে। বিরোধী দল জিতে এলে তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হবে- ১৯৭২ সালের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর এই অঙ্গীকার প্রকাশের মধ্যেও আমরা এর প্রতিফলন দেখি।’
চমৎকার আসিফ নজরুলের সংবিধান দর্শন। তিনি সংবিধানের এই অংশটি দেখলেন কিন্তু সংবিধানের মূল চারটি স্তম্ভকেই ভুলে বসে আছেন, যার ওপর ভিত্তি করে সংবিধান প্রণীত হয়েছে। সে চার মূলনীতি হলো, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আসিফ সাহেব ভোট তো পরের কথা আগে মূলনীতি ঠিক করবেন না? সংবিধানে যে সমাজতন্ত্র ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল সেসব কোথায়? আগে সেসব ফিরিয়ে আনুন তারপরে ভোটের কথা বলুন। আপনারা অন্তত দুই দশক ধরে যে রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চাইছেন তারাই তো সংবিধানের মূল চার নীতির হত্যাকারী। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে তারাই গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছিল। তারা সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে বিতর্কিত, নিন্দিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেছিল। এই ইতিহাস ভুলে শুধু শুধু অবাধ নির্বাচনের দাবি তুললে কি মানানসই হয়? আগে গণতন্ত্র হত্যাকারী অপরাধীদের বিচার শেষ করুন তারপর গণতন্ত্রের দাবি তুলুন। গণতান্ত্রিক দল বা শক্তিই তো গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার কথা।
তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে, ২০০৯ সালের নির্বাচনে ৩৬ বছর পর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসার পর আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘আমরা বাকশালি দর্শনে বিশ্বাস করি।’ এরপর দলের আরো কেউ কেউ বাকশালি শাসনব্যবস্থার পক্ষে কথা বলেছেন। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শুধু বাকশালের দর্শনের কথা বলেই থেমে থাকেনি, এটি কার্যকর করার জন্য দু-দুটো সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করেছে। জোটসঙ্গী দলগুলো এবং এমনকি সংসদে বিরোধী দলের ওপর নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এদের তারই অঙ্গ-সংগঠনের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। নিপীড়নমূলক আইনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং র?্যাব, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ অন্য সব বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে।’
যারা জানে না তাদের ক্ষমা করা যায় কিন্তু জেনেও যারা মিথ্যা তথ্য ছড়ায় সেরূপ গোয়েবলের শিষ্যদের ক্ষমা করা উচিত নয়। আসিফ এত পড়াশোনা করেছেন অথচ তিনি বাকশাল কর্মসূচি পড়ে দেখেননি, বাকশাল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানেন না তা মানা যায় না। বাকশাল কখনোই একদলীয় শাসনব্যবস্থা ছিল না। সেটি ছিল বহুদলের সমন্বয়ে একটি মহান বিপ্লব। যদি বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে বাংলাদেশ অনেক আগেই একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতো। বাকশাল যে শ্রেণিগোষ্ঠীর স্বার্থহানি করেছিল তারাই বাকশালকে গালিতে পরিণত করেছিল। বাকশাল কায়েম হলে দেশে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য থাকত না। দুর্নীতি থাকত না। সবকিছুই পরিচালিত হতো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে।
এরা বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার চোখ রাঙানিতে উৎফুল্ল। আজ আমেরিকার স্যাংশনের খবরে যখন বাঁশের কেল্লা এবং তার সাঙাতরা উল্লাস করে তখন বুঝতে বাকি থাকে না আসলে এদের মূল উদ্দেশ্যটি কী এবং কোন শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে এরা দল বেঁধে মাঠে নেমেছে।

কামরুল হাসান বাদল : কবি ও সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়