রাজধানীর ওয়ারীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শ্রমিকের মৃত্যু

আগের সংবাদ

মুখে স্বস্তির ভাব, মনে উদ্বেগ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড়

পরের সংবাদ

প্রযুক্তির গ্রাসে মননশীল সাহিত্য : নিশ্চিত করতে হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ > রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরীফা বুলবুল : বিশ্বে অন্যতম সাহিত্যধারা হিসেবে জনপ্রিয়তায় অনেক এগিয়ে বাংলা সাহিত্য। ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে এই সাহিত্যে নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। যেখানে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বাইরে এসে মানুষ, মানবতাবাদ আর মানব-মনস্তত্ত্বই প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে। ভারত ভাগ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালেও বাংলা সাহিত্যের আকাশে আবির্ভাব ঘটে বহু নক্ষত্রের। আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে সাহিত্যের নানা ধারা, উপধারা। তবে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর এসে সাহিত্যের সেই আলো অনেকটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। গেল কয়েক দশকে দেশে উল্লেখযোগ্য কিংবা বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় কোনো সৃজনশীল সাহিত্যের প্রকাশনা নেই। মানহীন বইয়ের ভিড়ে সৃজনশীল বইয়ের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর দেশে ও দেশের বাইরে নানা উপলক্ষে বইমেলা বা বই উৎসবের যেসব আয়োজন হয়; সেগুলোতে লেখক আর বইয়ের সংখ্যা বাড়ার আত্মতুষ্টি থাকলেও মানসম্পন্ন বইয়ের ঘাটতিতে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। বিশেষ করে ভাষার মাসে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশ হলেও মানসম্পন্ন, জনপ্রিয় সৃজনশীল বইয়ের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোও হয়ে পড়েছে বাণিজ্যনির্ভর। শখ করে নিজের পকেটের টাকায় মানহীন বই প্রকাশ করছেন অনেকে। যা অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। ফলে সৃজনশীল বইয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে দিন দিন কমে আসছে। একইসঙ্গে জনপ্রিয় সৃজনশীল লেখকের সংখ্যাও হাতেগোনা।
এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ, লেখক, প্রকাশকদের অভিমত- তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি বা চতুর্থশিল্প বিপ্লবের হাত ধরে বিশ্বে ভার্চুয়াল জগতের ব্যাপক প্রসারে ছাপাবই পড়ার প্রবণতা অনেকটা কমেছে। নতুন প্রজন্মও বইয়ের প্রতি দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তবে এখনও যারা বইপ্রেমী তারা সৃজনশীল, গবেষণাধর্মী বা জনপ্রিয় সাহিত্যের বই চাহিদামত মিলাতে পারছেন না। শিক্ষাবিদরা বলছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত বেশি উন্নতি হয়েছে- প্রতিমুহূর্তে সৃষ্ট জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। ফলে প্রথাগত মানসিকতারও বদল ঘটাতে হচ্ছে। নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্যের দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে, যা অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সৃজনশীল লেখক, প্রকাশকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা সময়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে সরকার বা রাষ্ট্রেরও দায় রয়েছে সৃজনশীল সাহিত্যের বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা করার। শুধু গ্রন্থাগারের সংখ্যা আর পরিসর বাড়ালেই হবে না, সৃজনশীল লেখক তৈরির পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সৃজনশীল লেখক এবং বইয়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। বইয়ের পাঠক এমনিতেই কমে গেছে। এখন যেটা হঠাৎ করে ঘটেছে, বইয়ের বদলে মানুষ ইন্টারনেটে বই পেয়ে যাচ্ছে। যখন ইন্টারনেটে দেখে ফেলে, তখন পড়ার আগ্রহ আর থাকে না। বই আলাদা জিনিস। যা নিজের সঙ্গে রাখতে হয়, ঘরে রাখতে হয়, সঙ্গি হিসেবে রাখতে হয়। যখন তখন যেন পড়া যায়, আর যা নেটে পাওয়া যায় তা তো বই না, বইয়ের একটা ছায়া। এখন ওই ঘটনাটা ঘটছে। যন্ত্র ঢুকে যাওয়ায় বইয়ের মর্যাদা এবং চাহিদা দুটোই কমে গেছে। সেই ক্ষেত্রে সৃজনশীল বইয়েরও চাহিদা কমে গেছে। চাহিদার ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে সৃজনশীল লেখাটা। এ ছাড়া মানুষ অন্য ধরণের বিনোদন পেয়ে গেছে। যেটা যন্ত্রের মাধ্যমেই পাচ্ছে। এই বিনোদনগুলো বইয়ের বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আগে বই থেকে যে আনন্দ পেতো তা অন্য জায়গা থেকে পেয়ে যাচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, এমন পরিস্থিতির জন্য যন্ত্রকে আমি দায়ি করছি না। যন্ত্রের মালিক যারা তাদেরই দায়ি করছি। কারণ যন্ত্রের মালিকরা সৃজনশীল কাজকে উৎসাহিত করে না। তারা ব্যবসার জন্য বইয়ের পরিবর্তে জাম্পিং বিনোদন সরবরাহ করে থাকে, এর মধ্যে থাকে বিজ্ঞাপণ। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই এর জন্য দায়ি। এই ব্যবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাবে। যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসবে। তখন তো বই পড়ার আনন্দ-আগ্রহ আরো কমে আসবে। মানুষের কল্পনা, হৃদয়ের অনুভূতির মূল্য হারাবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তো পণ্য ছাড়া আর কিছু চেনে না, বোঝে না। বইকেও পণ্য বানাতে চায়। লেখকের লেখা নির্ভর করে তার চাহিদার ওপরে। লেখক তো কেবল লিখে যাবে না, লেখক তো আর পাখি না যে গান গেয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৃজনশীল বই হয়তো তুলনামূলকভাবে কম আসছে। মূল কথা হচ্ছে পঠন-পাঠনের অভ্যাসটা বাড়াতে হবে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা

আছেন তাদের মধ্যেও পঠনপাঠনের অভ্যাস কমে গেছে। এটা বাড়াতে হবে। ছাত্রদের লেখাপড়া করার জন্য আরো বেশি উৎসাহিত করতে হবে। এখন বেশিরভাগই বই পড়ার চেয়ে দৃশ্য মাধ্যমের দিকে অনুরক্ত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া অনলাইনে লেখালেখির কারণে মেধার অপচয় হচ্ছে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে- পাঠাভ্যাস বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। প্রচুর পড়তে হবে। যদি লেখার ক্ষমতা থাকে পড়লেই সেটা প্রতিফলিত করতে পারবে। লেখার জন্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই। রামেন্দু মজুমদার বলেন, সরকারিভাবে প্রচুর গ্রন্থাগার করা হয়েছে। কিন্তু সেই গ্রন্থাগারে দেখা যায় সবাই গাইড বই পড়ছে। এদিকে সবাইকে আগ্রহী করে তুলতে হবে, যাতে জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়ে।
জানতে চাইলে কবি অসীম সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, মেধা থাকা আর মেধার যথার্থ কিংবা মৌলিক প্রকাশ এক কথা নয়। প্রতিভাবান বা মেধাবী অনেকেই হন, কিন্তু সেই মেধার মৌলিক প্রকাশের ক্ষেত্রে যদি তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটে, তা হলে সেই মেধার কোনো মূল্য থাকে না। আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ কথা তো বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বিজ্ঞান কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে মেধা বা প্রতিভার প্রকাশ আর সাহিত্যে তার প্রতিফলন একই রকম হয় না। এখন মেধাবীরাও সহজ পথের ভিখিরি হিসেবে অর্থ উপার্জনের দিকে যতোটা নজর দিচ্ছেন, সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে ততোটা নন। আর যারা সাহিত্যে নিবেদিত, তাদের মধ্যে মিডিওকারদের প্রাধান্য সৃজনশীলতার বদলে সাহিত্যে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।
অসীম সাহা আরও বলেন, এই জাতীয় জীবনে সৃজনশীলতার বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক। ফলে সার্বিকভাবে নৈরাজ্যের ক্ষেত্রটি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। মেধাহীনরা যখন নিজেদের নিকৃষ্ট সাহিত্য বা প্রকাশনা নিয়ে আত্মঅহমিকায় শূন্যে উড়তে থাকে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষকরা’ মূর্খতাকে প্রাধান্য দিয়ে নিকৃষ্ট ফষলের চাষই করে যাচ্ছে। এই শূন্যতা দূর করতে হলে প্রথমে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সৃজনশীল মানুষদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে আমাদের সাহিত্যে যদি একসময় মধ্যযুগীয় অন্ধকার নেমে আসে, তা হলে বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না!
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ভালো সৃজনশীল বইয়ের পাশাপাশি ভালো মানের পাঠকও থাকা চাই। আর লেখক পাঠকের পাশাপাশি বাজারও দরকার। বইয়ের প্রতি আগ্রহের চেয়ে দৃশ্য সংস্কৃতির প্রতিই মানুষের আগ্রহ বেশি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই দায়ি। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সংস্কৃতির শূন্যতা তৈরি হচ্ছে ভয়াবহরকম। একে একে সংস্কৃতির প্রকাশগুলো রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। মনজুরুল ইসলাম বলেন, মেধাকে জাগানোর জন্য পরিবেশও তৈরি করতে হবে। সব মিলিয়ে জটিল একটা সময় চলছে। তাই বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। কারণ পরিবেশটা অনুকূল থাকলে ভালো মানের সৃজনশীল সাহিত্য রচিত হবেই। এখন অনেক তরুণ ভালো গল্প কবিতা লিখছে। যা বেশ বিস্মিত এবং মুগ্ধ করে। আমি হতাশ নই, আশাবাদী।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কণ্ঠেও তারুণ্যের জয়গান শোনা গেল। তিনি বলেন, নবীণ লেখকদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাদের মধ্য দিয়ে আরেকটা সময় তৈরি হবে। এজন্য একটু সময় লাগবে। তবে নবীণদের একটু সিরিয়াসলি, সিনসিয়ারলি এবং ভালোভাবে চিন্তা করে লিখতে। তাদের বিষয় নির্বাচনও ভালোভাবে করতে। দেশের নানা পটভূমিতে বিষয় নির্বাচন করতে। তা হতে পারে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে নারীর আত্মত্যাগসহ গ্রামীণ পটভূমি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়