সম্পাদক পরিষদ : সাংবাদিক নির্যাতনের হাতিয়ার সাইবার নিরাপত্তা আইন

আগের সংবাদ

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র : সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পরের সংবাদ

ভয়টা যে কোথায় লুকিয়ে আছে

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের চারপাশে কেবল ভয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভয় তো পরিধানের কাপড়ের মতোই লেপ্টে আছে জাতির গায়ে। এই ভয় রাজনৈতিক সরকারের গায়ে কতটা লেগেছে বা লেগে আছে, তার পরিমাপ কে করবে? রাজনৈতিক সহিংসতার ভয় তো চিরকালীন সাবজেক্ট। অরাজনৈতিক ভয় যে আরো বেশি, সেটা আমরা খেয়াল করিনি কখনোই। সাংস্কৃতিকভাবে আমরা যে দখলের অধীনে চলে গেছি, তা একটু সচেতন হলেই চেনা ও বোঝা যায়। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা অতটা সজাগ ও সচেতন নই। আমরা ভীষণরকম আবেগী, তাই প্রকৃত সত্য নির্ণয় করতে পারি না। প্রকৃত শিক্ষার অভাবই এর জন্য দায়ী। একটি জাতি যখন অন্য দেশ ও সংস্কৃতির দখলে চলে যায়, তখন তা বোঝা কঠিন যে আমাদের আসল সংস্কৃতি বা কালচারাল ইমেজটা কী ছিল এবং তা বুঝতে না পারা। কারণ আমাদের সেই কালচারাল বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে শেখানো হয়নি। আর আমরা যারা আম পাবলিক আমরা সেটা বোঝার বা জানার চেষ্টা করিনি। এই সংকট এক ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের, আগামী দিনগুলো কেমন হতে যাচ্ছে।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সূত্র ধরে আমরা ব্যাংকে ডলার সংকট জানতে পেরেছি। তারা বড়ই বেকায়দায় পড়ে আছে। তারা প্রকৃত সত্য না পারছে বলতে না পারছে সইতে। বিশেষ ক্ষেত্রে তারল্য সংকট, মানে গ্রাহকদের যে টাকা দেবে, সেখানেও বিপুল ঘাটতি। তারাও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ করে সংকট মোকাবিলা করছে। এখন তো খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকই মহাসংকটের মধ্যে পড়েছে। সরকারের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তা কমে এসেছে ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। এ হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই। কারণ অর্থবছরের প্রথম মাসেই বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। যার পরিমাণ মাত্র ২৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার। গত বছরের এই সময়ে রিজার্ভ ছিল ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা ২১ দশমিক ৭ বিলিয়নে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিট। আবার উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে কেবল জাপান তার পুরনো প্রতিশ্রæতির টাকা ছাড় করছে। অন্য উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর নতুন ঋণের প্রতিশ্রæতি না থাকায় সংকট জেঁকে বসতে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘চীন, ভারত ও জাপান আশঙ্কা করুক বা না করুক এটি আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক। রিজার্ভ যেভাবে কমেছে, তাতে উদ্বেগের মাত্রা অনেক বেড়েছে। আমরা যে ঋণ নিয়েছি, সামনের দিনগুলোয় সেগুলোর কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ আরো বাড়বে। আমাদের রেমিট্যান্স সংকুচিত হলে, ইন-ফ্লো থেকে আউট-ফ্লো বেশি হলে সেটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। আগামী কয়েক মাসে এ অবস্থার নাটকীয় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। ডিসেম্বর নাগাদ রিজার্ভ ফ্লো ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার আশঙ্কা আছে। আমি জানি না পলিসি মেকাররা এটি নিয়ে কী চিন্তা করছে। বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে সফট ঋণ নেয়া গেলে তা ডলারের ইন-ফ্লো বাড়িয়ে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। এতে করে সাময়িক চাপ সামলানো যাবে হয়তো। কিন্তু এগুলো কোনো সমাধান না। সমাধান হতে হবে আমাদের মধ্যম মেয়াদে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে। বিদেশি বিনিয়োগ যদি বড় পরিমাণে আনা যায়, সেটি আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে।’
এই সংকট থেকে বাঁচার যে পথগুলোর কথা সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারেন অর্থমন্ত্রী। ডলারের আগমন স্রোত যে অনেকটাই কমে এসেছে, সেটা তো আমাদের জানা আছে। প্রথমত গার্মেন্ট রপ্তানির টাকাটা ডলার হয়ে কম আসছে। কী কারণে রপ্তানি মূল্যের সমপরিমাণ ডলার দেশে ঢুকছে না, তা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ধারণা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারকরা তাদের আয়ের কিয়দংশ বিদেশের ব্যাংকেই রেখে দিচ্ছে। না হলে টাকাটা আসছে না কেন? এটা মানতেই হবে যে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বড় আকারে আসে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে। তার সঙ্গে যোগ হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ। আর উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগ ও ঋণ। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিএ, জাইকা, আইএমএফ প্রভৃতি ঋণদাতারাও ঋণ প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে না। এমনকি আগের চুক্তি মোতাবেক ঋণের অংশও ছাড় দিতে গড়িমসি করছে। কারণ কী?
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন ঋণদাতাদের মধ্যে এই শঙ্কা জেগেছে যে, আগামীতে বাংলাদেশ ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করতে পারবে না। এর কারণ বৈদেশিক মুদ্রার ইন-ফ্লো কমে গেছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার আউট-ফ্লো অনেক বেশি। এত কী কেনা হচ্ছে যে ডলারগুলো চলে যাচ্ছে বিদেশি পাওনাদারদের হাতে? একমাত্র খাদ্যশস্য কেনা বাদে বাদবাকি ক্ষেত্রে তো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পারমিশন সীমিত। সেই সরকারি নির্দেশ কি মানা হচ্ছে না?
বিস্ময়কর হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত ও চীন তেমন উৎসাহী নয় ঋণ বা উন্নয়ন প্রতিশ্রæতি দানের ক্ষেত্রে। এমনকি আগের ঋণের কিস্তিও ছাড় করার ক্ষেত্রে তারা ঢিলেমির আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে গোটা পরিস্থিতিকে ইতিবাচক বলা যাচ্ছে না। আগামী ডিসেম্বর বেশি দূরে নয়। যদি ডিসেম্বরের মধ্যেই আউট-ফ্লো বেড়ে যায় বা এই বর্তমান গতিতেই চলে তা হলে রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসবে, যা কেবল শঙ্কারই নয়, আমাদের চিন্তাকে উদ্বেগের মধ্যে নিক্ষেপ করবে।
আমাদের রেমিট্যান্স যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি রপ্তানি বাণিজ্যের ডলারগুলো যাতে বিদেশেই পড়ে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্সের প্রবাহ তেমন ভালো নয়। বরং অবৈধপথে, মান হুন্ডির মাধ্যমে বেশি টাকা আসছে দেশে। সে ক্ষেত্রে ডলারগুলো বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। আবার হুন্ডির টাকার প্রভাবে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই বেড়ে যাবে। আসলে টাকার মান কম নয়, পণ্যের বা সেবার মান ভেদে দাম বা মূল্য বেড়ে যায়। এই হুন্ডি চক্রের অবৈধ স্রোত বন্ধ করতে হলে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, তা সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। এবং তা করতে হবে এখনই। কারণ দিন যত গড়াবে, ততই বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা।
দ্বিতীয় পথ হতে হবে রপ্তানি বাণিজ্যের সব ডলার যেন দেশে ঢুকে তা নিশ্চিত করা। যারা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে খেলবে বা ওই পথে যাবে তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশেষ করে গার্মেন্ট রপ্তানিকারকদের মধ্যে অবৈধ তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যারা দেশেরটা খায়, ভোগ করে সরকারের দেয়া সুযোগ সুবিধা আর টাকাটা পাচার করে বিদেশে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই তারা তো সরকারেরই নিজস্ব লোক। ধরলে বা আইনের আওতায় আনলে ওইসব ব্যবসায়ী ক্ষেপে যাবেই। তখন সরকারের দীর্ঘকাল থাকার যে প্ল্যান, তা ভণ্ডুল হবে, এটা কি মানা যায়? সরকার কেবল বিএনপি আর তার অ্যালি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখেই কেবল পড়েনি, তার আরো বড় সংকট ভেতরে ভেতরে এমন বড় হয়ে উঠেছে যে তাকে সামাল দেয়াই হবে তার প্রধান কর্তব্য।
হঠাৎ করেই এক সভায় কৃষিমন্ত্রী বলে ফেললেন আমাদের খাদ্যশস্যের কোনো রকম ঘাটতি নেই। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য আছে। এ রকম প্রশ্ন তো আমজনতার মধ্যে কখনোই ছিল না। মন্ত্রী বলার পর তাদের মনে শঙ্কা জাগল তাহলে তো খাদ্যের সংকট আছে! এই যে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন সোয়া ৪০০ টনেরও ওপরে, সেখানে তো খাবারের সংকট হওয়ার কথা নয়। তাহলে খাদ্যসংকটের মূলে কারা?
ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের পকেটে। বিএনপির ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে কি নেই জানি না। তাহলে কি মিয়ানমার চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় পরিস্থিতি এমন হচ্ছে? বন্ধ তো করেনি ভারত। তারা শুধু চাল রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ কর বসিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশই হচ্ছে এ দুটি দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের ক্রেতা। ব্যাংকে ডলার নেই, তাই আমদানি ঋণপত্র খুলতে পারছে না। সরকার কী করছে সেটা জানা দরকার। নাকি সরকারপ্রধান বিদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে যোগ দিয়েই সময় পার করে দেবেন। আর তিনি সব দায় অর্থমন্ত্রীর কাছে অর্পণ করেই জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গেছেন?

ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়