সম্পাদক পরিষদ : সাংবাদিক নির্যাতনের হাতিয়ার সাইবার নিরাপত্তা আইন

আগের সংবাদ

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র : সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পরের সংবাদ

ব্রিকস সম্মেলন ও বাংলাদেশের অবস্থান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২০০৬ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন- এই ৪টি দেশ নিয়ে ‘ব্রিক’ গঠিত হয়েছিল। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তির ফলে এটি ‘ব্রিকস’ নাম ধারণ করে। বিশ্ব জিডিপির ২৩ শতাংশ এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ এখন এ জোটের। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্যের ১৬ শতাংশের বেশি ব্রিকস প্রতিনিধিত্ব করে। এবারের ১৫তম শীর্ষ ব্রিকস সম্মেলন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের স্যান্ডটনের একটি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি বিষয়কে লক্ষ্য হিসেবে ধরে ব্রিকস এবারের সম্মেলন করেছে। একটি হচ্ছে এর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা; যা ছিল তাদের বড় এজেন্ডা। আরেকটি হচ্ছে ডলারের বিপরীতে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানো। নতুন করে তারা ৬টি দেশকে সদস্যপদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যা ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তবে বিকল্প মুদ্রা বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। কারণ অর্থনৈতিক কাঠামো এখনো পশ্চিমা দেশগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ব্রিকস সম্মেলনের সংবাদ বেশ গুরুত্বসহকারে প্রচার করেছিল। এর কারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবীতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, একটা বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রিকস এবং অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতিতে অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য সম্পদ সংস্থানে ২০১৫ সালে ব্রিকস তার নিজস্ব ঋণ সংস্থা ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশ ২০২১ সালে ওই ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে।
এবারের সম্মেলনের সেøাগান ছিল- ‘ব্রিকস অ্যান্ড আফ্রিকান সলিডারিটি’। অর্থাৎ ব্রিকসের সঙ্গে আফ্রিকার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার বিষয় ছিল। সেই দিক বিবেচনায় আফ্রিকার দেশ মিসর ও ইথিওপিয়াকে সদস্য করা হয়েছে। আবার তেলসমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবকে সদস্য করা হয়েছে। তাছাড়া লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে ব্রাজিলের পর বিকল্প হিসেবে আর্জেন্টিনাকে সদস্য করেছে। অর্থাৎ নতুন সদস্যভুক্ত করার ক্ষেত্রে অর্থনীতির দিক, আঞ্চলিকতার বিষয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকার বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। এটি ছিল বড় পরিসরে আয়োজিত প্রথম সম্মেলন, যেখানে প্রায় ৭০ জন বিশ্বনেতা একত্রিত হয়েছিলেন। বিশ্বরাজনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বসম্প্রদায়ের মোকাবিলা করা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব, বাণিজ্য, মুদ্রা পরিস্থিতি, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ প্রভৃতি বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা।
জি-৭ জোটে যে ৭টি শক্তিশালী পশ্চিমা দেশ আছে, এর বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো ব্রিকসের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। কিন্তু জি-৭ জোটকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থান ব্রিকস এখনো তৈরি করতে পারেনি। কারণ ব্রিকস জোটে যেসব দেশ আছে, সেগুলো বিশ্ববাণিজ্যে এখনো শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র ২৫ শতাংশ ব্রিকস জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর আর বাকি ৭৫ শতাংশ জি-৭ জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর। ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ ব্রিকস জোটের। বৈশ্বিক জিডিপিতে ভারতের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাত্র ২ শতাংশ করে এবং চীনের আছে ১৯ শতাংশ। একইভাবে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রাধান্য বেশি।
তবে এই সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা খুর বেশি আশাবাদী নয়। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেই এখনো ক্ষমতা রয়েছে। চীন এখনো খুব বেশি প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। তবে ব্রিকসকে এমন একটি সংস্থা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়; যার ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ব্রিকস সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। ব্রিকসে এতসংখ্যক দেশের যোগদানের মানে এই নয় যে, এই দেশগুলো চীনের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে ফেলবে এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে সহযোগিতার দরজা বন্ধ করে দেবে। তাছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণে ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং চীনের নেতৃত্বের কারণে চীন-ভারত বিভাজনটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে প্রতিদ্ব›িদ্বতা, নতুন করে এতে ভারত যুক্ত হওয়ায় দুই দেশের বিভাজনটা খুব বেশি চোখে পড়ছে। তবে ব্রিকস বর্তমানে উত্তর আমেরিকার আধিপত্যের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির একটি নতুন বলয় হতে পারে। এটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষ্যে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারে। তবে এটা মানতেই হবে, এখানে আন্তঃব্রিকস রাজনীতি রয়েছে। অর্থাৎ চীন-রাশিয়া বোঝাপড়া বা ভারত-ব্রাজিলের অবস্থান এবং চীন-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা; যা ব্রিকসে চীনা প্রভাবকে বাস্তবায়িত হতে দেবে না। চীন ও ভারত যদি তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও অবস্থান বজায় রেখে কমন ইন্টারেস্টে তারা কাজ করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ আগস্ট ব্রিকসের ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর সদস্য হিসেবে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে (ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ ও ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। ব্রিকসকে বিশ্বের একটি বহুমুখী বাতিঘর হিসেবে দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত পছন্দ ও বিভাজনকে ‘না’ বলা উচিত। সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে আমাদের। নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে আমাদের এবং সব প্রকার হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে এসে বিশ্বে জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিশ্বশান্তি, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সবাইকে একসঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং জলবায়ু, ন্যায়বিচার, অভিবাসীদের অধিকার, ডিজিটাল ইক্যুইটি ও ঋণ স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ২৩ আগস্ট সম্মেলনের ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেন তিনি। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার গুরুত্ব, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, চীনা ঋণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জননেত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বারোপ করেন। চীনা প্রেসিডেন্ট চীন ও বাংলাদেশকে উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার ওপর জোর দেয়া এবং তাদের অর্থনৈতিক পরিপূরকতায় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, নতুন জ¦ালানি, কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ব্রাজিল, মোজাম্বিক, তানজানিয়া ও ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষ করে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়; যা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সহযোগিতা করবে। ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী আফ্রিকান ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানান। ওই দিন আফ্রিকার দেশগুলোতে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশনের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন। ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দিলমা ভানা রুসেফের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এই ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের জন্যও অনুরোধ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের জুন মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার বৈঠকে যোগ দেয়ার ফাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠকের সময় ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ জুন বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকস জোটে যোগদানের জন্য আবেদন করেন। তবে বাংলাদেশ এবারের সম্মেলনে সদস্যপদ লাভ করেনি।
ভারতের ব্রিকস সম্প্রসারণের বিষয়ে পিছপা হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নতুন সদস্যপদ পাওয়া রাষ্ট্রগুলো যদি চীনের বলয়ভুক্ত হয়ে পড়ে। যারা সমতা বজায় রেখে বৈশ্বিক পর্যায়ে ও ব্রিকসের কাঠামোতে কাজ করতে সক্ষম, তাদেরই এবারের সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্যভুক্ত করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রদান করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর জন্য সমতা প্রণয়ন করে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তনের যে প্রতিশ্রæতি ব্রিকস প্রদান করেছিল; তা অপূর্ণই রয়ে গেছে। এর জন্য অবশ্য ভারত ও ব্রাজিলই দায়ী। কারণ বৈশ্বিক পর্যায়ে এবং ব্রিকস ফোরামেও নিজ প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই মূলত দেশ দুটির এমন আচরণ। ব্রিকসের সম্প্রসারণ হয়েছে অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। ব্রিকস এমন ৬টি দেশকে বেছে নিয়েছে, যেগুলো বাণিজ্যিক সংযোগ, জ¦ালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিরাপত্তা ও কৌশলগত সহযোগিতা প্রদানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। ব্রিকসের প্রধান ৫ দেশের বর্ধমান অর্থনীতির জন্য এগুলো অপরিহার্য। তাছাড়া নতুন ৬ সদস্যের জন্য ব্রিকসের প্রধান ৫ সদস্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনাগুলো সম্পূরক ও সহায়ক হবে। ব্রিকসের সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত মূলত পারস্পরিক সম্পূরক স্বার্থ বিবেচনা করেই হয়েছে, এমন কথা আমরা বলতেই পারি।

ড. মো. মোরশেদুল আলম : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়