সংসদে চুন্নু : সবাই বলে জাপা নাকি গৃহপালিত দল

আগের সংবাদ

অংশীদারত্ব বাড়ানোর প্রত্যয় > যুক্তরাষ্ট্রের চাপেও বাংলাদেশ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি সমুন্নত রেখেছে : ল্যাভরভ

পরের সংবাদ

উড়ালে উড়াকথা : অক্ষত পরিবহন নৈরাজ্য

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

উড়াকথা উড়াল দিয়েছে। আপাতত বন্ধ হয়েছে যত মন্দকথা। উড়ালসড়কের যুগে বাংলাদেশ। যানজটের শহর ঢাকায় স্বস্তির বাহক হয়ে যাত্রা শুরু হলো দেশের প্রথম উড়ালসড়ক ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এক সময় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, উড়ালপথ, উড়াল সেতু- এগুলো ছিল উড়াকথার মতো। এক সময় বিদেশফেরতরা এসব উড়াকথা শোনাতেন। স্রোতারা মাথা নেড়ে তা শুনতেন। বা ধারণা করে নিজেও দুয়েক কথা যোগ করতেন। আর আফসোসে বলতেন, আহা দেশে যদি কোনোদিন এমন হতো! সেই আফসোসের দিন ফুরিয়েছে। ফ্লাইওভারের পর মেট্রোরেল, এরপর উড়াল যাত্রাও চলছে। ১০/১২ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট। এসব মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ম্যাজিকের মতো যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, বিষয়টি মোটেই এমন নয়। আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছে। সামনে ফলোআপের বিষয় রয়েছে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশে চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ-পিপিপির ভিত্তিতে দ্রুতগতির উড়াল মহাসড়কের প্রকল্প বাস্তবায়নে ছিল বাংলাদেশ সেতু বিভাগ।
এক্সপ্রেসওয়ের চলমান অংশে যানবাহনকে চার শ্রেণিতে ভাগ করে টোল ঠিক করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এতে সর্বনিম্ন টোল ৮০ ও সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চার শ্রেণির যানবাহনের মধ্যে কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাকের (তিন টনের কম) টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ টাকা। ১৬০ টাকা টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা এর বেশি) ক্ষেত্রে। মাঝারি ধরনের ট্রাকের (৬ চাকা পর্যন্ত) টোল ফি ৩২০ টাকা। বড় ট্রাকের (৬ চাকার বেশি) ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা। প্রগতি সরণি এবং বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব। আরো পথ রয়েছে ঢাকা উড়ালসড়কে ওঠা-নামার।
দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহন ওঠার স্থান- ১. হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা। ২. প্রগতি সরণি এবং বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব। দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহন নামার স্থান- ১. বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ। ২. মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে। ৩. ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পাশে। উত্তর অভিমুখী যানবাহন ওঠার স্থান- ১. বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর ও দক্ষিণ লেন। ২. বনানী রেলস্টেশনের সামনে। উত্তর অভিমুখী যানবাহন নামার স্থান- ১. মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে। ২. বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর সামনে বিমানবন্দর সড়ক। ৩. কুড়িল বিশ্বরোড ৪. বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সামনে।
বলাবাহুল্য, আপাতত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুধু ঢাকায়। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত চালু হওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মূল পথ বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী। তাতে অনায়াসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতি লাইফলাইন, সেটি যুক্ত হয়ে যাবে আরো বৃহত্তর বাংলাদেশের সঙ্গে। বিমানবন্দর থেকে সাভারের ইপিজেড পর্যন্ত নির্মাণাধীন আরেকটি উড়ালসড়কের কাজ শেষ হলে এ প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল মিলবে। তখন ঢাকার যানজট এড়িয়ে দ্রুতগতিতে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেতে পারবে। আশুলিয়া পথের উড়ালসড়ক চালু হলে ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের যানবাহন ঢাকার যানজট এড়িয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পথে চলতে পারবে।
সরকারের করা একের পর এক সড়ক, উড়ালসড়কে ঢাকার চেহারাই বদলে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা এবং গোলমালটা ভিন্ন জায়গায়। সড়ক পরিবহন খাতটি যাদের হাতে তারা বদলাচ্ছে না। এরা পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি সড়কে চালাবে, উন্নতমানের ফ্র্যাঞ্চাইজ প্রথা করতে দিল না। দিল না সার্কুলার বাস সিস্টেম চালু করতে। গায়ের জোরে একের পর এক উদ্যোগ তারা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। ৫ বছর আগে সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনটিও তারা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। এই একটি খাত যেখানে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে মালিক-শ্রমিক এক হয়ে যায় এবং ক্ষমতা কাঠামো এদের পক্ষে অবস্থান নেয়। একটা নৈরাজ্য চালাচ্ছে এরা। এবং নৈরাজ্যের পক্ষে পরিবহন মালিক শ্রমিকের যে ভয়ংকর ঐক্য সেটা আর কোনো খাতে দেখা যায় না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল সিস্টেম নিয়েও কিছু কথা থেকে যাচ্ছে। সেই পুরনো পদ্ধতি, গাড়ি থামিয়ে ক্যাশ লেনদেন। ম্যানুয়ালি টোল দিতে গিয়ে টোল প্লাজার সামনে লম্বা ট্রাফিক হওয়ার দৃষ্টান্ত মেঘনা, গোমতী ঘাট ও যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদে প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালে এসে ১৯৫২ সালের টোল সিস্টেম বেমানান। এর আপডেট আনার কথা উঠেছে। কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি এ ব্যাপারে আগ্রহী বলে শোনা যাচ্ছে। তা শোনা কথার মধ্যে না রেখে দ্রুত কার্যকর অত্যন্ত প্রত্যাশিত।
এখানে প্রাসঙ্গিক আরো কিছু চলে আসে। আগের উড়ালসড়কগুলোর নিচের জায়গাগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। এদের দ্রুত উচ্ছেদের বিকল্প নেই। মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়কের বাতিগুলো জ্বলছে না। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অন্ধকার থাকছে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালসড়কটি। এর কারণ উড়ালসড়কের বৈদ্যুতিক তার ও বাক্স চুরি হয়ে যাওয়া। এতে ঝুঁঁকিতে চলাচল করতে হয় যানবাহনগুলোকে। কুড়িল বহুমুখী ফ্লাইওভারেও একই অবস্থা। সেখানে অধিকাংশ বাতিই জ্বলছে না। কিছু বাতি জ্বললেও তা চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর এই অন্ধকারের সুযোগে ছিনতাই-রাহাজানিসহ ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। আর নিচের জায়গা দখল করে আছে অবৈধ দখলদাররা। কুড়িল থেকে পূর্বাচল যাওয়ার পথে চোখে পড়ে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি। যা দখল করে রেখেছে উড়ালসড়কের নিচের জায়গা। এ ছাড়াও সন্ধ্যা হলেই আড্ডা জমায় নেশাখোররা। এতে একটু রাত হলেই এ পথে হাঁটতে ভয় পান সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে এ ফ্লাইওভারের নিচে ফার্নিচারের দোকানও চোখে পড়ে। যারা দীর্ঘদিন ধরে এখানে ব্যবসা করে আসছেন। তাদের এই দখলের কারণে গড়ে তোলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও নষ্ট হচ্ছে। ফ্লাইওভারগুলোর নিচে ময়লা আবর্জনায় ভরা, মল-মূত্র ত্যাগের আখড়া। সদিচ্ছা ও চেষ্টা করলেই তা সরানো যায়।
একের পর এক রাস্তা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এই আধুনিক রাস্তায় চলাচলের যে যানবাহন সব লক্কড়-ঝক্কড়। মান্ধাতা আমলের। কোনো নিয়ম-কানুনও তারা মানে না। আইন না মানলে ১১ তলা রাস্তা নির্মাণ করেও যানজট সমাধান হবে না। ডিজিটাল বাংলাদেশে সিগন্যাল বাতি ডিজিটালাইজড হলো না। রাস্তায় ট্রাফিকের হাত?ই একমাত্র ভরসা। তিলোত্তমা রাজধানীর গণপরিবহন একেতো লক্কড়-ঝক্কড় বাস, তার ওপর উপরন্তু সিটিং সার্ভিসের নামে চিটিং ব্যবসা। বিআরটিসি ভলভো ডাবল ডেকার যেভাবে চলছিল। ঢাকা শহরে তারা ভালো সার্ভিস ধরে রাখতে পারলে বেসরকারি লক্কড়-ঝক্কড় সার্ভিস ঢাকা শহর থেকে উধাও হয়ে যেত। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য সমাধানের বিষয়টি খুব সরল নয়, অনেক পক্ষের স্বার্থ এখানে জড়িত। সিন্ডিকেটভিত্তিক মুনাফার প্রশ্নে মালিক-শ্রমিকের দুর্নিবার ঐক্য এবং সে লিপ্সু ঐক্যে নতজানু হতে হতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে সড়ক আইন বাস্তবায়ন করতেই হবে। এ জন্য নাগরিক সমাজকে জেগে উঠতে হবে। কোনো সরকারের পক্ষেই এককভাবে আইন বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
গত এক যুগে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া খাত গণপরিবহন। কিন্তু চাঁদাবাজিতে ঢের এগিয়ে। এখানে কোনো কিছু চাঁদাবাজদের নির্দেশ ছাড়া হয় না। হেলপার এক পর্যায়ে চালক হয়, মালিক হয়, মালিক সমিতির নেতাও হয়, আত্মা তাদের একাত্ম। তাদের ঐক্য অবিভাজ্য। এরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে। মুনাফার প্রশ্নে সরকারি দল-বিরোধী দলের কয়েক নেতার এ ঐক্য ভয়ংকর। এ ভয়ংকরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার কাঠামো নমনীয় হয়ে থাকছে। বাস্তবতাটা বড় কঠিন। এ খাত থেকে অনেক টাকা চাঁদা উঠে। বোবা বা কাঠের পুতুলেরও এদিকে খুব নজর।
এ ছাড়া পুরান ঢাকাসহ বেশ কিছু এলাকার বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে রাতের ব্যস্ততা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে মূল রাজধানীকে কেন্দ্র করে এ ব্যস্ততা এখন অনেক বেশি। নানা প্রয়োজন কিংবা বিনোদনেও এখন রাতে বের হতে আগ্রহী নগরবাসী। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়াও সারা দিনের যানজটে পূর্ণ কর্মব্যস্ত নগরীতে একটু স্বস্তির প্রত্যাশায় অনেকেই বের হন রাতে। রাতের ঢাকায় চলাচলে সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে মেট্রোরেল-উড়ালসড়কের সুখ থাকবে একেবারেই খণ্ডিত। সড়কের নিরাপত্তা, নাগরিকদের যাতায়াত নির্বিঘœ না হলে গণপরিবহন ব্যবস্থাও সাবলীল হবে না। সড়ক ও ফ্লাইওভারও তখন মার খাবে। যানজট সমস্যার সমাধান না হওয়ার পরিণতির উদাহরণ রয়েছে জাকার্তা, ব্যাংককে। সিউলে অনেক ফ্লাইওভার কেন ভেঙে ফেলতে হয়েছে সেই তথ্য জানা ও বিশ্লেষণ আবশ্যক।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়