আইজিপি : সিআইডি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছে

আগের সংবাদ

উন্নয়ন ঘিরে শোডাউন : কয়েকটি মেগা প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় বড় সমাবেশের পরিকল্পনা

পরের সংবাদ

সর্বজনীন পেনশন স্কিম : একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বেশ কিছুদিন আগেই সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করার সহায়ক আইন প্রণয়ন করেছে, যার নাম সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩। সন্দেহ ছিল আসন্ন নির্বাচনের আগে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যাবে না বা প্রবর্তন হবে না। তাই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এই স্কিমের উদ্বোধনের সূচনাতে অনেকে খুশি আর অনেকে বেজার হয়েছেন, মুখে যখন ট্যাক্স নেই, তখন যে যা কিছু বলতে পারেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে সর্বজনীন পেনশন স্কিম কী, কেন এবং তাকে কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা সঙ্গত। এটা একটা সামাজিক নিরাপত্তা জাল, যার মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জনগোষ্ঠীকে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য মাসিক স্টাইপেন্ড বা বৃত্তি দেয়া হবে। এই স্কিমের অধীনে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা প্যাকেজ রয়েছে। এগুলো যথাক্রমে প্রবাসী, বেসরকারি চাকরি, স্বকর্মে নিয়োজিত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত কিংবা আয় উপার্জনবিহীনদের জন্য প্রবর্তিত হয়েছে।
প্রবাস প্যাকেজ : বিদেশে কর্মরত বা বসবাসরত যে কোনো বাংলাদেশি এই প্যাকেজে অংশ নিতে পারবেন। প্রবাসীরা ৫ হাজার, ৭ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি ১০ বছর ধরে প্রদান করে যথাক্রমে ৭ হাজার ৬৫১, ১১ হাজার ৪৭৭ এবং ১৫ হাজার ৩০২ টাকা মাসিক পেনশন পেতে পারেন।
প্রগতি প্যাকেজ : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের কিংবা মালিকদের জন্য এই প্যাকেজ। এই উপস্কিমে কর্মচারী ও নিয়োগকর্তা সমহারে কিস্তি দেবেন ২ হাজার টাকা, ৩ হাজার টাকা বা ৫ হাজার টাকা মাসিক প্রদানসাপেক্ষে প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাবে। মাসিক ২ হাজার টাকা করে ১০ বছর কিস্তি দিয়ে যে কেউ মাসে ৩ হাজার ৬০ টাকা পেনশন পাবেন।
সুরক্ষা প্যাকেজ : অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতরা যথা- কৃষক, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিদের জন্য এই প্যাকেজ। সুরক্ষা প্যাকেজে ১০০০, ২০০০ ও ৩০০০ টাকা প্রদান করা যাবে এবং মাসে ১ হাজার টাকা করে ১০ বছর কিস্তি প্রদান করে একজন অংশগ্রহণকারী মাসিক ১৫৩০ টাকা পাবেন।
সমতা প্যাকেজ : সর্বোচ্চ বার্ষিক ৬০ হাজার উপার্জনভোগী মাসিক প্রিমিয়াম ৫০০ টাকা দিলে, তাতে সরকার দেবে ৫০০ টাকা। ১০ বছর পর তিনি মাসিক পেনশন ১৫৩০ টাকা পাবেন।
যেহেতু সরকারি-আধাসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৬ লাখ কর্মজীবীর পেনশন সুবিধা রয়েছে, তাই তাদের আপাতত বাদ দিয়ে দেশের অন্য সব মানুষ যাদের বয়স ১৮-৫০ ক্ষেত্রভেদে ৫০ বছরের অধিক বয়সিরা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্যাকেজে অংশ নিতে পারবেন।
প্রতিটি প্যাকেজের জন্য সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম হচ্ছে যথাক্রমে ১ হাজার টাকা ও ১০ হাজার টাকা। কেউ তার বেশি দিতে চাইলেও ব্যবস্থা রয়েছে। কারো বয়স ৬০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে গেলে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন। তবে তার আগে মৃত্যু হলে তার নমিনি ৭৫ বছর পর্যন্ত সে সুবিধা ভোগ করবেন। বর্তমানে দেশে গড় আয়ু ৭৪ বছরের মতো আর অধিকাংশ লোকই ৬০ বছরের আগেই কর্মহারা হয়ে সন্তানাদির গলগ্রহ বা সরকার নির্ভর হয়ে অনেকটা অসহায়, অমানবিক ও অমর্যাদাকর জীবনযাপন করেন। এই দুঃসহ পরিস্থিতির উত্তরণের পথ এই পেনশন স্কিম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একজন চাকরিজীবী ৫০ শতাংশ প্রিমিয়াম আর বাকিটা নিয়োগকর্তা দেবেন। ব্যবসায়ীদের মতে প্রায় ৭০ মিলিয়ন মানুষ এই প্যাকেজে উপকৃত হবে। সঞ্চয় স্থিতির সুদের হার ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। বিদেশিদের ক্ষেত্রে যা ২.২৫ শতাংশ বেশি, চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে। বিদেশে কর্মরত কেউ সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম দিলে মেয়াদ শেষে তিনি প্রতি মাসে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা পেনশন পাবেন। মোটকথা কেউ ১৮-৪২ বছর প্রিমিয়াম দিয়ে সর্বনিম্ন ২.৩ গুণ আর সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৩ গুণ উপকার ভোগ করবেন। প্রতিদান নিঃসন্দেহে লোভনীয়, প্রিমিয়াম উদ্ভূত সঞ্চয় থেকে ঋণও নেয়া যাবে।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বিরোধীদের বিরূপ সমালোচনায় ব্যথিত হয়েছেন। এই স্কিমটি সর্বজনীন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য মনে করেন হাছান মাহমুদ। সূচনার দিনেই অনেকে অংশ নিলেও রাজনৈতিক, সুশীল ও শিক্ষাবিদদের সমালোচনা কিন্তু থেমে নেই। তারা বহুবিধ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, তন্মধ্যে অব্যবস্থাপনা, মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি প্রসঙ্গ থাকলেও বিরোধী এক বা একাধিক নেতা তাকে নির্বাচনে অর্থায়নের উপায় বলেছেন; যদিও বেসরকারি চাকরিদাতারা এটাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
মুদ্রাস্ফীতির কথাটা মনে রাখতে হবে। তা না হলে প্রাপ্ত টাকা পাতায় পর্যাবেসিত হয়ে যাবে বলে অনেকে ধারণা করছে। মুদ্রাস্ফীতি কি এতটা বেড়ে যাবে যাতে কোনো উপকারই পাওয়া যাবে না? আগামী ৪২ বছরে মুদ্রা মূল্য বেড়েও যেতে পারে। দেশের খনিজসম্পদ ও সামুদ্রিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে আমাদের বর্তমানের ১ টাকা ৪২ বছরে ৫০০ টাকার সমান হয়ে গেলে বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকবে না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা কি ভালো নয়! দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল রাখার পরামর্শ দেবে অনেকে, তার মধ্যে রাজনীতিবিদ ও সুশীলও রয়েছে। রাজনীতিবিদ সবকিছুতে গ্রহণ বা বর্জনে আছেন। তাদের মতে সরকার এসব অর্থ নিজেদের নির্বাচনে জয়ের কাজে লাগাবে।
বিরোধীদের অপপ্রচারের কারণে শুরুতে খুব বেশি টাকা সরকারি কোষাগারে আসবে না, তাই এই টাকা নির্বাচনে ব্যবহারের সুযোগ অতি সীমিত, তবে বিভ্রান্তির মাত্রা বাড়বে। আমাদের দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে লাগলে বিশ্বাসই করে, আর অবিশ্বাস করতে লাগলে অবিশ্বাসই করে। বাসন্তী এক জালের দামে ৬টা শাড়ি কিনতে পারত। তাও সে জালই পরেছিল বলে বিজ্ঞ সাংবাদিক ও তার পৃষ্ঠপোষক পত্রিকা মালিকরা এমন রিপোর্ট করেছিল। রাষ্ট্রপতির ছেলে সদলবলে অতি সুরক্ষিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুট করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, সে কথাও মানুষ বিশ্বাস করেছিল। আমাদের লোকেরা পরের মুখে ঝাল খেতে পছন্দ করে, স্বদেশির চেয়ে পরদেশির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তা কার্যকর করে। এ বিষয়গুলো মনে রাখতে হয়। এসব বলছি এ কারণে যে, আমাদের সমাজ, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবন বোধ মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।
তদুপরি প্রিমিয়ামের টাকা সরকার একসঙ্গে নেবেও না, আবার একসঙ্গে ফেরতও দেবে না। তাই নির্বাচনের আগে চাইলেও ব্যয়যোগ্য কোনো অর্থ হাতে থাকবে না। সঠিক বিনিয়োগ হলে এ নিয়ে চিন্তার অবকাশ কম। তবে প্রতি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিনিধিত্ব না থাকলে অব্যবস্থার সম্ভাবনা থেকেই যাবে; যদিও এসব কার্যকর হলে বহুবিধ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। যেমন- বর্তমানে প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিহার করা যাবে, বিনিয়োগ বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়বে আর ভুক্তভোগীরা দুশ্চিন্তামুক্ত হবে, সমাজে মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবেন, কারো গলগ্রহ বা ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিতে হবে না।
এই স্কিমটা জীবন বিমার বিকল্প হতে যাচ্ছে। জীবন বিমা কোম্পানির দাবি পরিশোধের হারের দিকে তাকালে দেখব বেসরকারি খাত সরকারি খাতের চেয়ে প্রতারণার দিক থেকে এগিয়ে আছে। অনেক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে লাল বাতি জ্বলবে। দেশে বর্তমানে বৃদ্ধের হার এক দশক পর কমপক্ষে দ্বিগুণ হবে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের এই পদক্ষেপটি তার আরো অনেক পদক্ষেপের মতো দূরদৃষ্টি ও মমতায় ভরা, তাই তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার পরও এই স্কিমটিকে ঐতিহাসিক বা যুগান্তকারী ব্যবস্থা বলা যেতে পারে।
বিলেতি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখেছি। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা কখনো প্রবর্তন হতে পারে তা আমি কখনো ভাবিনি। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা একদিন সুচারুরূপে চালু হবে, যদি না কেউ তা ছুড়ে ফেলে দেয়। যাদের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে না, তাদের জন্য ব্রিটেন বা অন্য উন্নত দেশের মতো বেকার ভাতা প্রবর্তন করা যাবে, সরকারের চিন্তায় তা আছে দেখে প্রীত হচ্ছি।
উপসংহার : আগেই বলেছি এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে জীবন বিমা কোম্পানি রসাতলে যেতে পারে, বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা জাল গুটিয়ে নেয়া যাবে, বয়স্কজনরা দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারবেন, অন্যায় বা বঞ্চনা থেকে নিষ্কৃতি পাবেন, মন-মানসিকতায় স্বাধীনতা বাসা বাঁধবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ ও পূর্ণ বিনিয়োগের জন্য সরকারি কোষাগারে জমা হবে। বিদেশি মুদ্রার প্রবেশ বাড়বে ও সাবলীল হবে। এমন একটি ব্যবস্থাকে যুগান্তকারী বলাটা কি ভুল হবে?

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়