ইসলামী আন্দোলন : নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা

আগের সংবাদ

কুরবানির পশুর দাম বেশি যে কারণে > আফতাবনগর হাট : এখনো জমেনি হাট গরুও উঠেছে কম

পরের সংবাদ

পশ্চিমবঙ্গের প্রাইভেট স্কুল রেগুলেটরি কমিশন : আমাদের জন্য কোনো মেসেজ বহন করে কি?

প্রকাশিত: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে লাগামহীন ফি বৃদ্ধিসহ নানা অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন অভিভাবকরা। এমনকি আদালতেও যেতে হয়েছে। সম্প্রতি আদালত এই অস্বাভাবিক হারে ফি বৃদ্ধির জন্য ভর্ৎসনা করেছে। রাজ্য সরকারের জবাবদিহিতাও জানতে চেয়েছে। জানা গেছে, বেসরকারি স্কুলের ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একজন বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ‘প্রাইভেট স্কুল রেগুলেটরি কমিশন’ গঠন করতে চলেছে। রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এখন থেকে বেসরকারি স্কুলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা এই রেগুলেটরি কমিশনে জানানো যাবে। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পরিষেবার অন্যান্য বিভাগেও এ ধরনের কমিশন রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে স্বাস্থ্য কমিশনে অভিযোগ জানানো যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে রেগুলেটরি কমিশনও অনেকটা সেরকম। এই কমিশনের নাম দেয়া হয়েছে ‘প্রাইভেট স্কুল রেগুলেটরি কমিশন’। এই কমিশনের শীর্ষে রাখা হবে একজন সাবেক বিচারপতিকে। এছাড়া কমিশনে থাকবেন রাজ্য সরকারের কয়েকজন প্রতিনিধি। তারা কোনো স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখবেন। সেক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট স্কুলের বিরুদ্ধে সুপারিশ করতে পারবে কমিশন। প্রয়োজনে কড়া পদক্ষেপ নিতে পারবে। প্রশাসনিক আধিকারিকরা মনে করছেন, এর ফলে যেমন বেসরকারি স্কুলের একরোখা মনোভাব রোখা যাবে, তেমনই অভিভাবকদের অভিযোগেরও অনেকটা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
২০২০ সালে কোভিডের সময় বেসরকারি স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে অভিভাবকরা ব্যাপক হারে অভিযোগ করতে শুরু করেন। লকডাউনের জেরে বিভিন্ন অফিস, ব্যবসাসহ সব কিছু বন্ধ থাকায় আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন সাধারণ মানুষ। সেই সময়ও বেসরকারি স্কুলগুলো তাদের ফি কোনোভাবে কমাতে রাজি হচ্ছিল না বলে অভিভাবকরা অভিযোগ করেছিলেন। এমনকি ওই সময় ফি না দেয়ায় বহু বেসরকারি স্কুল শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসতে অনুমতি দিচ্ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন অভিভাবক। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের মধ্যে সমস্যা মেটাতে অনেক সময় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল প্রশাসনকে। তাছাড়া প্রায়ই স্কুলে ভর্তির সময় এককালীন মোটা টাকা নেয়ার অভিযোগও জমা পড়েছিল রাজ্য সরকারের কাছে। করোনা সংক্রমণের সময়কার সেই অভিযোগ বেড়ে বর্তমানে হয়েছে কয়েকগুণ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এই অরাজকতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আসে। তাই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একতরফা মনোভাবে লাগাম টানতে তৈরি হচ্ছে রেগুলেটরি কমিশন। লাগামছাড়া ফি, পরিকাঠামোর অভাবের মতো অভিযোগে ব্যবস্থা নেবে কমিশন। ভর্তি ফি নাকি কখনো কখনো কয়েক লাখ টাকা। নতুন শ্রেণিতে ভর্তিতে বাড়তি টাকা, কসান ডিপোজিট ডেভেলপমেন্ট ফি নামে টাকা, স্পোর্টস ও কালচারাল অ্যাক্টিভিটির নামে টাকা, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পোশাক, জুতা, খাতা কিনতে বাধ্য করা। এটি বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম- দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি শিক্ষাকে আমরা নিরুৎসাহিত করতে চাই না, আবার লাগামহীনভাবে তারা যা ইচ্ছে তা করবে তাও কিন্তু কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে যে ‘রেগুলেটরি কমিশন’ গঠিত হতে যাচ্ছে সেটি একটি বাস্তব পদক্ষেপ। এখানে আর একটি বিষয় হচ্ছে বিচারক থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের প্রতিনিধিও থাকছেন উক্ত কমিশনের সদস্য হিসেবে। এটি একটি চমৎকার পদক্ষেপ। আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষাকে নিয়মানুবর্তিতা ও মানসম্পন্ন করার নিমিত্তে এ ধরনের কমিশন প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে এ ধরনের কমিশন গঠিত হলে সরকারি কিছু আমলা দ্বারা পরিচালিত হয়, যার অর্থ হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করার এক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। আর কারোর ক্ষেত্রে অবৈধ উপায়ে কিছু অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়া। পশ্চিমবঙ্গের রেগুলেটরি কমিশনে যারা সদস্য থাকবেন তাদের পদবীর উল্লেখ যেভাবে করা হয়েছে সেটি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে।
আমরা জানি যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৯ সালে ‘রাইট টু এডুকেশন আইন’ কার্যকর করে। ২০১২ সালে সেটি রাজ্যে চালু হলেও বেসরকারি শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ছিল না। কমিশনের মাধ্যমে প্রথমবার সেই সুযোগ তৈরি হলো। বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে যে, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা ও কোথাও কোথাও অস্বচ্ছতার প্রমাণ পাওয়া গেছে সেসব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসার আশা জোরদার হলো। এখানে একটি বিষয় বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিকের সঙ্গে তুলনীয়। সেটি হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা কোথাও কোথাও পঞ্চাশ, ত্রিশ এমনকি দশজনেরও নিচে অথচ চার-পাঁচজন করে শিক্ষক আছেন এসব বিদ্যালয়ে। এটি রাষ্ট্রীয় অপচয়। এটি বন্ধ করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, পাশাপাশি দু-তিনটি বিদ্যালয়ে একত্র করা হবে, সেটি কিন্তু বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও দেখা যায় এ ধরনের চিত্র বিদ্যমান। মনে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয় সেখানেও ঠিক পরিকল্পিতভাবে হয়নি। এসোসিয়েশন অব স্কুলস ফর আইএসসির সর্বভারতীয় সভাপতি সুজয় বিশ্বাসের কথায় শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু ধরে রাখা নয়, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এক কোটি ৬০ লাখ ৭৩ হাজার ২৫৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বেসরকারি স্কুলে যায় মোট ৮.৭ শতাংশ। যা সংখ্যার নিরিখে ১৫ লাখ ৭ হাজার ৩৫৪। আর সরকারি, সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত এবং সরকারি পোষিত স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৪৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০। শতাংশের হিসেবে এটি দাঁড়ায় ৮৫.৭। এখানে দেখা যায় যে, রাজ্যর সরকারি স্কুলগুলোতেই বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, মানের দিক থেকে বেসরকারির তুলনায় একটু পিছিয়ে আছে।
তবে দেশজুড়ে সরকারি ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (ইউ-ডাইস) ২০১৯ সালের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে করা সেন্টার স্কোয়ার ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ কোটি ১০ লাখ। সেই শিক্ষার্থীর অর্ধেকের সামান্য বেশি (১৩ কোটি ১০ লাখ) সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে। বাকি ১২ কোটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ে। উচ্চ প্রাথমিকের পর দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষকদের সংখ্যা, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষাকর্মীদের বেতন খাতে স্কুলে খরচ, স্কুলে খেলার মাঠ আছে কিনা এবং অন্য আর কী কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, স্কুলের ফলাফল কেমন হয়, এ সবই বেসরকারি স্কুলের ফি নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি স্কুলগুলোর চার-পাঁচটি ক্যাটাগরি বা স্তর থাকার কথা আলোচনায় এসেছে। প্রথম দিকে থাকা স্কুলের ফি তুলনামূলক বেশিই হবে। শুধু ক্যাটাগরি নয়, স্কুলের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ভিত্তিতে পৃথক ফির স্তর তৈরি করা হবে। বেসরকারি স্কুলের ব্যবসায়িক মনোভাবে ও দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন ও রেগুলেটরি বোর্ড গঠনের, সিপিসিআর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলে অভিভাবক-শিক্ষক এসোসিয়েশন গঠন এবং প্রতিটি স্কুলে অভিভাবক ফোরামের মান্যতার দাবিতে ‘ইউনাইটেড গার্ডিয়ানস এসোসিয়েশনের আহ্বানে অভিভাবক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন জেলার প্রায় ৫০টি স্কুলের দুই শতাধিক অভিভাবক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে গত ২৯ মে। এখানে বক্তারা বলেন, বেসরকারি স্কুলগুলোর প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন, তা মেরুদণ্ডসম্পন্ন নীতিনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি করার লক্ষ্যে নয়। প্রতি বছর নানা অজুহাতে লাগামছাড়া ফি বৃদ্ধি করা হচ্ছে, চলছে বই-খাতা নিয়ে ব্যবসা।
গত ৮ বছরে বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানোর খরচ বেড়েছে প্রায় ২০০ শতাংশ, যা মানুষের আয় বৃদ্ধির থেকে অনেক বেশি। ভারতের সব রাজ্যে না থাকলেও অনেক রাজ্যে বেসরকারি স্কুল নিয়ন্ত্রণের আইন রয়েছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা নেই। নেই কোনো রেগুলেটরি বডিও। তাই প্রথমবারের মতো প্রাইভেট স্কুল রেগুলেটরি কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথমে অভিভাবকরা স্কুলের গ্রিভান্স সেলে অভিযোগ জানাবেন, সেখানে ফল না পাওয়া গেলে কমিশনের দ্বারস্থ হওয়া যাবে। সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখে স্কুলকে নির্দেশ দিতে পারবে কমিশন। কমিশন অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে রাজ্যকে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারবে। ফি কাঠামোয় বৈষম্য, শিক্ষকদের বেতন সংক্রান্ত বিষয় নিয়মিত খতিয়ে দেখবে কমিশন। শিক্ষায় এই রেগুলেটরি কমিশন সব অর্থেই দৃষ্টান্ত হতে চলেছে বলে মনে করছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। আমাদের দেশেও আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারি।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়